নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে ডেঙ্গু কমার যে আশা স্বাস্থ্য বিভাগ দেখিয়েছিল, তাতে বালি ঢেলেছে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং।
Published : 27 Oct 2022, 01:37 AM
বছরের শেষে এসে এমনিতেই মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল ডেঙ্গু; ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সারা দেশে ভারি বৃষ্টি হওয়ায় এ ভাইরাসের বাহক এইডিস মশার বিস্তার নতুন করে বাড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও আরও সচেতন হতে হবে।
এ বছর বুধবার পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৩ হাজার ৯২৩ জন। আর এখন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩ হাজার ৩৮০ জন। সরকারি হিসাবে এ বছর ডেঙ্গুতে ১২০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগী এবং মৃত্যুর এই সংখ্যা বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর ২০১৯ সালে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, সে বছর মৃত্যু হয়েছিল ১৬৪ জনের।
ভর্তি রোগী এবং মৃত্যুর এই তথ্য ঢাকার ৫৪টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল এবং দেশের বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে পাঠানো হয়। আক্রান্ত হলেও হাসপাতালে ভর্তি হননি বা হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন এমন রোগীরা এই হিসাবের বাইরে থেকে যান।
ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এইডিস মশা ডিম ছাড়ার জন্য বেছে নেয় স্বল্প গভীরতার পানি, যেমন বোতল, কাপ, টব, টায়ারের মত স্থান।
এ মশা মানুষের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। সেজন্য ঘর, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি স্থানে এদের দেখা মেলে বেশি। আর তাদের ওড়াউড়ি জন্মস্থানের কাছাকাছিই সীমাবদ্ধ থাকে।
এক দিনে হাজারের বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি, ঢাকার বাইরেই প্রায় অর্ধেক
ডেঙ্গু বাড়ায় শয্যা সংকটের শঙ্কা স্বাস্থ্য সচিবের
নভেম্বরে শুরুতে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমার আশা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের
এ বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ কম থাকলেও অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে বাড়তি বৃষ্টি এইডিস মশার প্রজননের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেয়। তাতে রোগী বাড়তে থাকে হু হু করে।
অগাস্টে যেখানে ৩ হাজার ৫২১ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে হয় ৯ হাজার ৯১১ জন। আর অক্টোবরের ২৬ দিনেই ১৭ হাজার ৮৩১ হন এ রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গেছেন। গত দশ মাসে মারা যাওয়া ১২০ জনের মধ্যে সেপ্টেম্বরেই ৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত সপ্তাহে জানিয়েছিল, বৃষ্টিপাত না হলে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসতে পারে। তাদের সেই আশার গুড়ে বালি ঢেলেছে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং।
সোমবার সন্ধ্যার পর দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে মাঝারি মাত্রার এ ঘূর্ণিঝড়। কিন্তু এর প্রভাবে গত তিন দিনই সারা দেশে ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছে।
মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় ২৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করার কথা জানায় আবহাওয়া অধিদপ্তর, যা এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের ওপর ঘুর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দু ধরনের প্রভাবই রয়েছে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে কবিরুল বাশার বলেন, প্রচণ্ড বাতাসে ৮০ শতাংশ মশা মারা যায়। আর ব্যাপক বৃষ্টিপাতের ফলে জমে থাকা পানি উপচে পড়ায় লার্ভাও মারা পড়ার কথা।
“বাইরে যে মশাটা রয়েছে, ঝড়ে সেগুলোর পাখা ভেঙে যাবে। আর ঘরে যেগুলো থাকে, সেগুলো বেঁচে আছে। সেজন্য আগামী সাত দিন মশার উপদ্রব কম থাকবে।”
কিন্তু বৃষ্টির ফলে যে পানি জমেছে, তা অপসারণ না করলে আগামী ১০ দিন পর মশা আবার বাড়তে শুরু করবে বলে সতর্ক করেন এই গবেষক।
তিনি বলেন, “মশা জন্মাতে পারে এমন যেসব স্থানে পানি জমেছে, তা ফেলে দিতে হবে। নইলে সিত্রাং আরও ভোগান্তি বয়ে আনবে।
“প্রতিটি বাড়িতে বিভিন্ন পাত্রে জমে থাকা পানি অপসারণে বাসিন্দাদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। আর যেসব জায়গা নাগরিকদের আয়ত্তে নেই, যেমন রাস্তাঘাট, সরকারি স্থাপনা, খোলা জায়গা– সেগুলো সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা পরিচ্ছন্ন করবে।”
ঢাকার ১২ শতাংশের বেশি বাড়িতে এইডিস মশার লার্ভা
কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরীও বলছেন, ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়াটা ‘স্বাভাবিক’। বৃষ্টির কারণে বহু জায়গায় নতুন করে পানি জমেছে।
“ওখানে এইডিস মশার ডিম থাকলে তা থেকে মশা জন্ম নেবে। আবার মশা জন্মালেই হবে না, ডেঙ্গু ছড়ানোর জন্য মানুষকে কামড়াতে হবে। যদি শীত নেমে যায়, তাহলে মশা তেমন কামড়াবে না। তবে শহরের অনেক জায়গা আছে, যেখানে তাপমাত্রা বেশি থাকে, সেসব জায়গায় মশা বাড়বে।”
সিত্রাংয়ের প্রভাবে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ডা. ফজলে শামসুল কবিরও।
বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, বৃষ্টিতে নতুন করে শহরের আনাচে কানাচে পানি জমে গেছে। এই জমা পানি ভবিষ্যতে বিপদের কারণ হতে পারে।
“আগামী এক-দুই সপ্তাহের পরিস্থিতি দেখে বোঝা যাবে আসলে সিত্রাং মশার ওপর কোনো প্রভাব ফেলেছে কি না। তবে আমি আশঙ্কা করছি…। আমাদের সব কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। বছরব্যাপী আমরা যে কার্যক্রম চালাই তা আরও বেগবান করা হয়েছে।
“মশা নিধনে আমরা গত দুই সপ্তাহ ধরে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালাচ্ছি, এটা আরও এক সপ্তাহ চালাব। নাগরিকদের প্রতি আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, প্রতিটি বাড়ির আনাচেকানাচে যেখানেই পানি জমে আছে তা ফেলে দিন। কোথাও যেন পানি জমতে না পারে। এই একটা কাজ করলে আমরা সবাই নিরাপদ থাকতে পারব।”
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমানও বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আরও কিছুটা প্রলম্বিত হওয়ার শঙ্কার কথা বললেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ভারি বৃষ্টিপাত হলে মশা বাড়ার আশঙ্কা থাকে। এই আশঙ্কা আমরাও করছি। গতকালই আমাদের চিরুনি অভিযান শেষ করেছিলাম। নতুন করে অভিযান আমরা ডিক্লেয়ার করিনি, কিন্তু ওই একই আদলে কার্যক্রম আমরা চলমান রাখব।”