দেশের একদল গবেষক দেখেছেন, এইডিস মশা এখন রাতেও দংশন করে। আর নর্দমার নোংরা পানিতেও বংশবিস্তার করে।
Published : 12 Jul 2023, 01:30 AM
বলা হয়, ডেঙ্গুর বাহক এইডিস মশা কেবল দিনের শুরুতে এবং সন্ধ্যার আগে, অর্থাৎ আলো-আঁধারিতে দংশন করে। কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র।
বাংলাদেশের একদল গবেষক দেখেছেন, এইডিস এজিপ্টি মশা কেবল দিনে নয়, রাতেও সক্রিয় থাকে।
শুধু তাই নয়, ঘরের মধ্যে ও আশপাশে জমে থাকা পরিষ্কার পানিকে এইডিস মশার প্রজননস্থল হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এই গবেষকরা দেখেছেন, নোংরা পানিতেও এই মশা ভালোভাবে বংশবিস্তার করতে পারে।
তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশারের নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে কীটতাত্ত্বিকদের মধ্যেও।
একজন কীটতত্ত্ববিদ মনে করছেন, উপযুক্ত বিশেষজ্ঞদের দ্বারা মূল্যায়িত (পিয়ার রিভিউ) হওয়ার আগে এ ধরনের গবেষণাকে আমলে নেওয়ার সুযোগ নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসির ডেঙ্গু সংক্রান্ত নানা তথ্যে বলা হয়, এইডিস এজিপ্টি মশা সকালে এবং বিকালে সূর্যাস্তের আগের সময়টায় বেশি দংশন করে।
এই মশা সাধারণত থাকে শহরাঞ্চলে মানুষের বসবাসের আশপাশে, ঘরের ভেতরের অন্ধকার জায়গা-আলমারি, খাটের নিচে, দরজা বা জানালার পর্দার পেছনে বেশি থাকে।
আর ডিম পাড়ে ঘরের আশপাশে ফুলের টব, টায়ারসহ ছোট ছোট স্থানে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে; সেই ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মশায় রূপ নেয় সাত থকে ১০ দিনে।
স্ত্রী এইডিস এজিপ্টি মশা ডেঙ্গু আক্রান্ত কারও রক্তে চোষার সময় জীবাণু তার মধ্যে সংক্রমিত হয়। সেই মশা অন্য কাউকে দংশন করলে সেই প্রাণীও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়।
এই মশাটির উদ্ভব আফ্রিকায় হলেও এখন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বিভিন্ন দেশকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে এই ক্ষুদ্র কীট। বাংলাদেশে ১৯৬৪ সালে প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হলেও ২০১৯ সালে তা সবচেয়ে ভয়াবহ হয় উঠেছিল।
এবার রাজধানীর এইডিস মশার বিস্তার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তোলার আশঙ্কা জাগিয়ে তুলেছে। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন শহরেও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। এর মধ্যে দিনে হাসপাতালে রোগী ভর্তি হাজার ছাড়িয়েছে।
নতুন গবেষণায় যা মিলেছে
২০২১ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত চলমান ‘Adaptation of Aedes aegypti mosquito larvae in Sewage, Sea, Brackish & Drain Water: A new challenge for dengue control’ শীর্ষক এই গবেষণায় দেখা গেছে, বৃষ্টির পানি, সমুদ্রের পানি এবং নর্দমার পানিতেও এইডিস মশা বংশবৃদ্ধি ঘটায়। এমন পানিতে এই মশার বেঁচে থাকার ক্ষমতা পরিষ্কার পানির প্রায় সমান, ৯৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ। শুধু নর্দমার পানিতে এই ক্ষমতা একটু কম, সেটাও প্রায় ৯২ শতাংশ।
কোন মশা কখন কামড়ায়, তা জানতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সাভার এলাকার মোট ১ লাখ ৩৪ হাজার ৯০৪টি মশার উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান গবেষক দলটি।
তারা মশাগুলো ধরেন বিকাল ৪ টা থেকে রাত ৯ টার মাঝে। তারা দেখেছেন, এইডিস মশাগুলো যেমনভাবে বিকাল ৪টার সময় সক্রিয়, ঠিক একইভাবে রাত ৯টার সময়ও সক্রিয়।
গবেষক দলের প্রধান ড. কবিরুল বাশার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মশাগুলো ‘কামড়াতে’ আসার পর তারা এগুলো ধরে কাপের মধ্যে বন্দি করেন। তারপর ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে ল্যাবে নিয়ে পরীক্ষা করে প্রজাতির ব্যাপারে নিশ্চিত হন।
“আমরা মানুষকে মশারির ভেতর রেখেছি। মশা মশারির ওপর বসলে সেগুলো ধরে কাপের মাঝে রাখতাম। প্রতি ঘণ্টায় যে মশাগুলো পেয়েছি, সেগুলো আমরা ল্যাবে নিয়েছি এবং চিহ্নিত করেছি। আমরা দেখতে চেয়েছিলাম, কোন ঘণ্টায় কোন মশা বেশি পাওয়া যায়। এটা করতে গিয়ে দেখলাম যে এইডিস মশা রাতেও কামড়ায়।”
যেখানে নগরায়ন হয়, সেখানেই এইডিস মশা বাড়তে থাকে: ড. কবিরুল বাশার
রাতে এইডিসের দংশনের মাত্রা বেশি হয় কি না- জানতে চাইলে তিনি বলে, “রাতের বেলায় এইডিস মশার ঘনত্বটা একটু কম। কিন্তু রাতের বেলায়ও কামড়ায়। অথচ এক সময় এই মশা শুধুমাত্র দিনের বেলায়, মানে সকালে এবং বিকালে কামড়াত। শুধু তাই না, নোংরা পানিতেও এখন এইডিস মশা হয়।”
এই গবেষণা নিয়ে ভিন্নমত জানালেন বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই মশা সবচেয়ে বেশি কামড়ায় সকালে এবং বিকালে। অন্ধকারে এই মশা কখনও কামড়ায় না। রাতে কামড়ানোর জন্য দিনের মতো প্রচণ্ড আলো থাকতে হবে।”
ড. মনজুর বলেন, “যারা এগুলো গবেষণা করে পেয়েছেন বলছেন, তারা সেই গবেষণাটা কোনো পিয়ার রিভিউ জার্নালে অথবা কোনো অ্যান্টোমোলজিক্যাল মিটিংয়ে উপস্থাপন করেছেন? না করে আন্দাজে বললে তো হবে না।”
আচরণ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যুক্তি কী?
এইডিস মশার আচরণগত পরিবর্তনের যে কথা কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলছেন, তার পেছনে আধুনিক জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ উজ্জ্বল আলোকে কারণ হিসেবে দেখাচ্ছেন তিনি।
তার ভাষ্যে, “এইডিস মশা রাতে কামড়ানোর কারণ আলো দূষণ। একসময় মানুষ এত উজ্জ্বল আলো ব্যবহার করত না। কিন্তু এখন আধুনিক জীবন যাপনের জন্য মানুষ বেশি লাইট ব্যবহার করে। আপনার ঘরে যে পরিমাণ লাইট দরকার, তার চেয়ে বেশি আছে। মার্কেটগুলোতে যান, দেখবেন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি লাইট আছে।"
এই যুক্তি উড়িয়ে দিতে পারছেন না এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডো) সাধারণ সম্পাদক পরিবেশবিদ ড. শাহরিয়ার হোসেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা হতে পারে। কীট পতঙ্গ আলোর দিকে আকৃষ্ট হয় বেশি। সেজন্যই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে কীটপতঙ্গের মুভমেন্ট কমে যায়।
“তবে ওরা কিন্তু ইয়েলো আলোর দিকে যায় না। ওইটাকে তারা মনে করে যে আগুন। নিরাপদ মনে করে না। ওদের মুভমেন্ট হয় ফ্লুরোসেন্ট বাতি, মানে যে লাইটগুলো উজ্জ্বল আলো দেয়, সেদিকে।”
ড. শাহরিয়ারের কথায় সায় দেন ঢাকার মুগদা হাসপাতালের পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামানও। এবছর ডেঙ্গু সংক্রমণ বেশি হওয়ার দিকটি দেখিয়ে তিনি বলেন, “সোডিয়াম লাইটের সময় কিন্তু এত ডেঙ্গু রোগী ছিল না।”
বাস্তবে কী দেখা যাচ্ছে?
সম্প্রতি এইডিস মশা নিয়ন্ত্রণে চলমান অভিযানে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, শুধু পরিষ্কার পানি নয়, অনেকটা নোংরা পানিতেও এইডিস মশার লার্ভা মিলছে।
সোমবার কারওয়ানবাজার এলাকায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অভিযানের সময় পাঁচটি ভবনের বেইজমেন্টে এইডিস মশার লার্ভা পায়।
এর মধ্যে যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ভবনের লিফটের জন্য নির্ধারিত খালি জায়গায় জমে থাকা পানিতে লার্ভা পাওয়া যায়। ওই পানি ছিল নোংরা, কালো। এছাড়া বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন ভবনের বেইজমেন্টে যে পানিতে লার্ভা পাওয়া গেছে, তাও ছিল নোংরা, হলদেটে।
এবার নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রমে অংশ নেওয়া সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এখন নোংরা পানিতেও এইডিস মশার লার্ভা পাচ্ছেন, যা তাদের ধারণায়ও ছিল না।
ডিএনসিসির উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পানিটা নোংরা, নিচে কংক্রিট সেখানে অনেক আবর্জনা আছে, এমন জায়গায় আমরা অনেক লার্ভা পাচ্ছি।
“আজকেও (মঙ্গলবার) মিরপুরে ১৩ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় একটি নির্মাণাধীন বাড়ির বেইজমেন্টের বিভিন্ন পিটে পাওয়া গেছে। সেখানে যে পিটগুলোর নিচে কাদা জমে আছে সেখানে লার্ভা নেই। কিন্তু যে পিটগুলোতে নিচে কংক্রিট আছে, পানিটা নোংরা, সেখানে লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। এমনটা আগে দেখিনি।”
শুধু স্বচ্ছ পানিতে এইডিসের ডিম ছাড়ার যে কথা প্রচলিত রয়েছে, তা ঠিক নয় বলে মনে করেন ড. মনজুরও, যিনি গবেষণাটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।
তিনি বলেন, “একেবারে টলটলে পানিতে এইডিস মশা খাবে কী? পানি অনেকদিন এক জায়গায় আটকে থাকলে সেটার রং কিছুটা হলুদ হয়ে যায়। সেগুলোতে এইডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। তবে সেই নোংরা পানিটা কোনো পাত্র বা বদ্ধ জায়গায় হতে হবে।”
এই কীটতত্ত্ববিদ আরও বলেন, এইডিস মশা সাধারণত পাত্রের গায়ে ডিম পাড়ে। কোনো পাত্রে পানি জমে থাকলে ব্যাকটেরিয়া হয়, ফাংগাস হয়, জু-প্লাংকটন ও ফাইটোপ্লাংকটন হয়, যেগুলোকে বলা হয় মাইক্রোবায়োটা। এ অবস্থায় এমন একটা পরিবেশ তৈরি হয় যে লার্ভাগুলো ডিম ফুটে বের হয়ে আসে। লার্ভাগুলো জু-প্লাংকটন, ফাইটোপ্লাংকটনকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে বড় হয়। এজন্য লার্ভা একদম টলটলে পানিতে হয় না।
‘চিন্তা করতে হবে ভিন্নভাবে'
মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার নগর কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করে আসা ড. কবিরুল বাশার মনে করেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনগুলোকে গঁৎ বাঁধা চিন্তার বাইরে গিয়ে ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, “২০১৯ সালে সারাদেশে এক লাখের উপর ডেঙ্গু রোগী ছিলো। গতবছর ছিল ৬২ হাজার রোগী। এই বছর ডেঙ্গু সংক্রমণ গত বছরের চেয়ে বেশি হবে। তাই, এই মশাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ভিন্নভাবে চিন্তা করার সময় এসে গেছে।
“মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাড়ি বাড়ি যেতে হবে। প্রত্যেকটা ওয়ার্ডকে ছোট ছোট ব্লকে ভাগ করে, প্রত্যেকটা ব্লকে এক বা দুইজন কর্মী নিয়োগ দিতে হবে। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে এইডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করবে এবং বাড়ির মালিকদেরকেও এটা নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত করবে।”
পরিবার পরিকল্পনা বা ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে সফলতার উদাহরণ দেখিয়ে তিনি বলেন, “পরিবার পরিকল্পনা প্রোগ্রাম সফল হয়েছিল স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্যাম্পেইন করার কারণে।
“এই মশা কমাতেও এইভাবে কাজ করতে হবে। আমাদের সিটি করপোরেশন বলে যে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে করতে পারবে না। কিন্তু তারা যতদিন পর্যন্ত এটা করতে পারবে না, ততদিন পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।”
ডেঙ্গু থাকছে সারা বছর, বাঁচতে চাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা: ড. কবিরুল বাশার