দামাল: খেলা আর দেশপ্রেমের মিশেলে অনুপ্রেরণা জাগানিয়া এক সিনেমা

“যখন আমাদের দেশ আর মানচিত্র ছিল না, জার্সি কিংবা পতাকা ছিল না, তখন আমরা দেশের জন্য জানবাজি রেখে খেলেছিলাম।”

আহসান কবিরআহসান কবিরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Nov 2022, 06:23 AM
Updated : 4 Nov 2022, 06:23 AM

খেলা ও দেশপ্রেমের মিশেলে চূড়ান্ত এক আবেগের সিনেমা ‘দামাল’। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলার স্মৃতি নিয়ে একালের মেয়েদের খেলাধুলাতে অনুপ্রেরণা জোগানোর এক খেলাময় সিনেমা দামাল। চোখের জল মুছে মা-বাবা-ভাই-বোন কিংবা হৃদয়ে বাংলাদেশকে পুষে রেখে সর্বোচ্চ উজাড় করে দেওয়ার এক উত্তেজনাময় সিনেমার নাম দামাল। আবেগ ও দেশপ্রেম নিয়ে একাত্তরের দিনগুলোকে স্বাভাবিক ভাবে ফুটিয়ে তোলার সিনেমাও দামাল। এ সময়ের ফুটবল বা ক্রিকেটে যারা কমিটিতে আছেন বা বড়তারকা বনে গেছেন, তাদের জন্য এই দেশের জন্ম সময়ের ঋণ স্মরণ করিয়ে দেওয়ার এক অনুপ্রেরণাময় সিনেমা দামাল। খেলা ও প্রেমের টানটান উত্তেজনার এক সিনেমা দামাল।

এই সিনেমায় সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হয়নি। বলা হয়নি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের কথা। কিন্তু ফুটবল পাগল দুই যুবকের খেলা ও প্রেমকে ঘিরে উঠে এসেছে সবকিছু। আছে পঁচিশে মার্চের ক্র্যাকডাউনের দৃশ্য। আছে দুর্জয় নামের স্ট্রাইকারের যে প্রেমিকা, তার বাবার ফিরে না আসার দুঃখ। আছে ছোট্ট ডায়ালগে অনেক ভারী দুঃখের বয়ান। প্রেমিকা যখন জানতে চায় দুর্জয়ের কাছে- ‘বাবাকে পেয়েছ? বাবা লাল হাতমোজা পরেছিলেন। গায়ে..’ দুর্জয় উত্তর দিতে পারে না।

সনাতন ধর্মের প্রেমিকা ভোর সকালে পরিবারের সঙ্গে চলে যায় কলকাতা। পঁচিশে মার্চ কালরাত্রির ক্ষত আর প্রেমিকা হারানোর স্মৃতি নিয়ে ফুটবল ভুলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে দুর্জয় চলে যায় আগরতলা। শুরু হয় তার জীবনের অন্যযুদ্ধ।

আরেক পাগল ফুটবলার মুন্না। সেও নাছোড়বান্দা প্রেমিক। ফুটবল নারকেল গাছে লেগে ফিরে আসার সময় সে দুর্দান্ত ব্যাকভলি মারে, পায়ে আঘাত পায়। বিয়ের দিন আলহামদুলিল্লাহ বলেই ছুটে যায় ফুটবল বাছাইয়ের এক খেলায়। দেশের অবস্থা ভিন্ন ভাবনায় ঠেলে দেয় মুন্নাকে। জীবনের প্রয়োজনে তাকেও জড়িয়ে যেতে হয় যুদ্ধে। কিন্তু নিয়তি আবারও তাদের এক করে দেয়। গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। মুন্না সেই টিমকে নেতৃত্ব দেয়। তাদের সঙ্গে একদিন দেখা হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের অন্য অপারেশানে থাকা স্ট্রাইকার দুর্জয়ের সঙ্গে। জমে ওঠে খেলা। কিন্তু গোল মেশিন দুর্জয় গোল দিতে পারছিল না। ব্যর্থতার এক পর্যায়ে তার কান্না ফুটে ওঠে ডায়ালগে- “যে দৃশ্য আর লাশের সারি দেখে এসেছি, তাদের পাশ কাটিয়ে আমি গোল দিতে পারছি না!” তবু সিনেমাটিক ট্রিটমেন্ট আর গল্পের ধারাবাহিকতায় গোল পায় দুর্জয় আর মুন্না।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দামাল ছেলেদের নিয়ে গড়া স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের এক আবেগ আর অনুপ্রেরণার গল্প দামাল। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের এই অনুপ্রেরণার গল্প বলেন একাত্তরের স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজার। উজ্জীবিত করার জন্য এই গল্প তিনি বলেন এ কালের কিশোরী মেয়েদের, যারা বাংলাদেশ জাতীয় দলে ফুটবল খেলে। বেদনা লুকিয়ে তিনি তাই অনায়াসে বলতে পারেন-“যখন আমাদের দেশ আর মানচিত্র ছিল না, জার্সি কিংবা পতাকা ছিল না, তখন আমরা দেশের জন্য জানবাজি রেখে খেলেছিলাম। স্বাধীন দেশে তোমরা অন্তত হৃদয় দিয়ে খেল…!”

দামাল সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে শিশু সাহিত্যিক ফরিদুর রেজা সাগরের গল্প নিয়ে। এর আগেও তার গল্পে একটি সিনেমা তৈরি হয়েছে। দামালের চিত্রনাট্য লিখেছেন নাজিম উদ দৌলা ও রায়হান রাফি নিজে। পরাণ-এর পরে রায়হান রাফি পরিচালিত দামাল সিনেমাটিও আলোচনায় এসেছে।

Also Read: এই ইতিহাস নিজেই হিরো: দামাল নির্মাতা

Also Read: ‘সব রেকর্ড’ ভাঙবে দামাল, আশায় নির্মাতা রাফী

সিনেমায় ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন মুন্নার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শরীফুল রাজ। তার প্রেমিকা ও স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিদ্যা সিনহা মিম। পরাণের পর রাজ ও মিমের এটা দ্বিতীয় সিনেমা। দুর্দান্ত স্ট্রাইকার দুর্জয় এর চরিত্রে অভিনয় করেছেন সিয়াম আহমেদ। তার প্রেমিকা চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাহনাজ সুমী। শরীফুল রাজ বরাবরই পাগলাটে অভিনয় সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন। অভিনয়ের এই বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে এই সিনেমায় যুক্ত করেছেন খেলোয়াড়সুলভ দৃঢ়তা। নারকেল গাছ থেকে নেমে আসা ফুটবলে ব্যাকভলি করার মতো আসল ম্যাচে ব্যাকভলি মেরে গোল করার দৃশ্য ছিল মনকাড়া। পাকিস্তানি কোচের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া, যুদ্ধের অপারেশন শেষে নিজের পকেট থেকে ছোট্ট পতাকা বের করে পাকিস্তানি মেজরের টেবিলে থাকা ছোট্ট পতাকা মাটিতে ফেলে পিষে ফেলে সেই জায়গায় বাংলাদেশের পতাকা স্থাপন, গোল না পাওয়ার বেদনা কিংবা ফ্রি কিক থেকে গোল করার জায়গাগুলোতে সিয়াম আহমেদ খুবই ভালো অভিনয় করেছেন।

রাজ ও মিম, সিয়াম ও সুমীর প্রেমের দৃশ্যগুলোও ছিল মজার। মিম এই সিনেমায়ও ভালো অভিনয় করেছেন।

এই চারজনের সঙ্গে অন্য চারজন মানুষ আলাদাভাবে নিজেদের চিনিয়েছেন। প্রথমজন প্রয়াত অভিনেতা, নাট্যকার ও শিক্ষক শ্রদ্ধেয় কায়েস চৌধুরী। সিনেমার শুরুতেই তাকে স্মরণ করা হয়েছে। রাজের চিকিৎসক বাবার ভূমিকায় খুব ভালো অভিনয় করেছেন তিনি। দ্বিতীয় জন হচ্ছেন ইন্তেখাব দিনার। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজার হিসেবে তিনি ছিলেন দুর্দান্ত। তৃতীয়জন রাশেদ মামুন অপু। রাজাকার চরিত্রে রাশেদ মামুন অপুর পরিমিতিবোধ এবং অভিনয় ছিল তার আগের অভিনয়ের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। রাজাকার চরিত্রে ঘৃণা কিংবা মৃত্যু দৃশ্যে দর্শকদের হাসির রোল অন্য অপুকেই উপস্থাপন করে। চতুর্থজন সাইদ বাবু। পাকিস্তানি মেজরের ভূমিকায়ও তিনি ভালো অভিনয় করেছেন।

এই সিনেমার অন্য অভিনয় অভিনয় শিল্পীরা যেমন নারী ফুটবল দলের মেয়েরা, সিয়ামের বাবার চরিত্রে সমু চৌধুরী, কোচের চরিত্রে রবিউল রবি (টাইগার রবি) ফুটবল দলের গোলকিপার এবং মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের চরিত্রে সেতু ভালো অভিনয় করেছেন।

সিনেমার গানগুলো শ্রুতিমধুর। পাঁচটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন মমতাজ, কনা, ইমরান ও প্রীতম। শুধু প্রচারণার জন্য করা গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন ‘ক্রিপটিক ফেইট’ ব্যান্ডের ভোকালিস্ট সাকিব চৌধুরী।

দামালের পরিচালকের মুন্সিয়ানার সঙ্গে ফটোগ্রাফি এবং আর্ট ডিরেকশানও দুর্দান্ত। একাত্তরের রাস্তাঘাট, মানুষের পোশাক, লাইট, ফ্যান, বিদ্যুতের সুইচ, তৈজসপত্র কিংবা ক্যালেন্ডাররকে সেই সময়ের উপযোগী করেই সাজানো হয়েছে। প্রেমের দৃশ্যগুলোতে রাজের ফুটবল খেলার প্র্যাকটিস কাম পাগলামী যেমন মজার তেমনি ডায়ালগও হৃদয়গ্রাহী। গোল না পাওয়ার সময়ে সিয়ামের ডায়ালগ, ফ্রিকিকে সিয়ামের গোল দেওয়ার দৃশ্য যেমন ইমোশনাল, তেমনি ইমোশনাল যুদ্ধে মা ও স্ত্রীকে হারানো গোলকিপারের পেনাল্টি ঠেকিয়ে দেওয়া।

দেশ স্বাধীন হয়নি তাই কোনো আর্ন্তজাতিক ম্যাচে পতাকা নিয়ে ঢোকা যাবে না এই নির্দেশ পাওয়ার পর খেলোয়াড়দের প্রতিবাদ ও পতাকা নিয়ে ঢোকা, ১৪ই অগাস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে অনুষ্ঠিত খেলাটাতে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে সংবাদ জন্ম দেওয়া, কোচের পদত্যাগের পরেও ইমোশনাল খেলায় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের দুর্দান্ত কামব্যাক দর্শকদের নিয়ে যায় এক চরম আবেগঘন মুহূর্তে। ফিল্মী এই ইমোশনাল ট্রিটমেন্টই দরকার সাধারণ মানুষের খেলার অনুভব কিংবা দেশ প্রেমের ব্যঞ্জনায়!

ধন্যবাদ ও শুভকামনা পরিচালক রায়হান রাফির জন্য।

জয় হোক বাংলা সিনেমার।