পুঁথির পুঁতি গাঁথছেন ফজলুর রহমান বাবু

ঢাকার নিউ এলিফ্যান্ট রোডের এক গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা বাড়ির নিচতলা থেকে বাঁশীর মিহি সুরে থমকে যেতে হল। উৎসুক মন নিয়ে গেল বাড়ির ভেতর। বাড়িটি দেখে মনে হয় অফিস, তবে ঠিক অফিসও যেন নয়। দরজার সামনে সাইনবোর্ড ঝোলানো- ‘জলপুতুল পাপেট স্টুডিও’। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই জানালেন, ভেতরে অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু পুঁথি পাঠের রিহার্সালে ব্যস্ত। ‘নোনা জলের কাব্য’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য সবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ফজলুর রহমান বাবু। তার নাটকের দল আরণ্যক প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পালন করছে। এসব রেখে তিনি কেন পুঁথি পাঠের রিহার্সালে? সেই কথাই হল গ্লিটজের সঙ্গে। সঙ্গে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও আরণ্যকের কথাও।

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Feb 2023, 03:25 AM
Updated : 10 Feb 2023, 03:25 AM

এই স্টুডিওতে কী করছিলেন?

পুঁথি পাঠের রিহার্সাল করছিলাম।

হঠাৎ পুঁথি?

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত হোপ ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশের জন্ম ও দীর্ঘ পথচলার ইতিহাস এবং উন্নয়নকাজে ব্রাকের ভূমিকা তুলে ধরে ১৫ মিনিটের একটি পরিবেশনা আছে। আমরা পুঁথির সুরে এই ইতিহাস তুলে ধরব।

[এই সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর বৃহস্পতিবার সেই অনুষ্ঠানে পুঁথি পাঠ করেন ফজলুর রহমান বাবু]

দেশের ইতিহাস তুলে ধরতে পুঁথির আশ্রয় কেন?

পুঁথি আমাদের লোকজ সংস্কৃতির আদিফর্ম। যেটা প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে দেশ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি পুঁথি পাঠ করেছিলাম। সেটা শুনে প্রধানমন্ত্রী খুবই আপ্লুত হয়েছিলেন। এরপর আইপিডিসির আয়োজনে আরও একটি পুঁথি পাঠ করেছিলাম। সেটাও শ্রোতারা পছন্দ করেছেন। এরপর আকিজ গ্রুপের একটা অনুষ্ঠানে পুঁথি পাঠের অনুরোধ এসেছিল। বিকাশের একটা অনুষ্ঠানে পুঁথি পাঠ করলাম। সেগুলোও দর্শক খুবই পছন্দ করেছেন, আবেগ আপ্লুত হয়েছেন। আমাদের আদি সুর খুব সহজেই মানুষকে কানেক্ট করতে পারে।

বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই পুঁথির সঙ্গে পরিচিত না। তাদের যদি পুঁথির সঙ্গে পরিচিত করে দিতেন...

বাউল গান, জারি গান, সারি গান যেমন আমাদের গ্রাম বাংলার আদি শিল্পচর্চার মাধ্যম। পুঁথিও তেমনি। পুঁথি মানে বই। গায়ক বই থেকে একটি গল্প সুরে সুরে গাইতে থাকেন। পুঁথির সুরের ঢঙ খুবই আকর্ষণীয় ও কথা সহজবোধ্য বিধায় খুব সহজে মানুষকে কানেক্ট করতে পারে। ইউসুফ জুলেখার পুঁথি, গাজী সালাউদ্দিনের বীরত্বগাথা, বিষাদ সিন্ধুর পুঁথিসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ঘটনা, যুদ্ধের ইতিহাস কিংবা লোককাহিনীর পুঁথিগুলো গ্রাম বাংলায় জনপ্রিয় ছিল। কালের বিবর্তনে পুঁথি প্রায় হারিয়েই গেছে। বহুদিন পুঁথির চর্চাটা ছিল না। আব্দুল লতিফ নামে একজন শিল্পী খুব ভালো পুঁথি পাঠ করতেন।  

পুঁথির সঙ্গে আপনার সম্পৃক্ততা কিভাবে?

পুঁথি নিয়ে আমার জ্ঞান গরিমা নেই। ছোট বেলা শুনেছি। সুর আর ধাঁচটা মনে ছিল। আর যেহেতু থিয়েটার করি- নানা মানুষ, সংস্কৃতির নানা ধরনের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে। সেই সাহস থেকেই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে পুঁথিটা পাঠ করি। সেটা দর্শক থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সবাই পছন্দ করেছেন। এখন বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান হলে পুঁথি পাঠের প্রস্তাব আসে। যেহেতু এটা আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি জনপ্রিয় ধারা ছিল, এটাকে পুনর্জীবিত করার তাড়নাও আমার ভেতরে কাজ করে। এটাই কারণ। আমি কিন্তু পুঁথি বিশেষজ্ঞ টাইপের কেউ না।

যেমনটা বললেন, গ্রামীণ সংস্কৃতির বড় একটা মাধ্যম ছিল পুঁথি। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেল। এখন তো নিত্যনতুন প্রযুক্তি আসছে। পুরনো ধারার কাজগুলোও জনপ্রিয় হচ্ছে। পুঁথিকে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় নতুন জীবন দেওয়া যায় না?

এটা একটা গবেষণার বিষয়। অবশ্যই নতুন করে ফিরিয়ে আনা যায়। তবে আদি জিনিসটা আগের সেই ফর্মে হয়ত থাকবে না। এখন ফিউশন হচ্ছে। পুঁথি নিয়েই ফিউশন করা যায় কি না, সেটা ভাবা যেতে পারে। আমরা যেমন পুঁথিতে যন্ত্র যোগ করেছি। আদি পুঁথিতে কিন্তু যন্ত্র ছিল না। যার গলা সুর আছে, তিনি হয়ত বিষাদ সিন্ধু পাঠ করতেন। একটা বাড়িতে দশটা ঘর, সেই দশ ঘরের মানুষজন উঠোনে হারিকেন বা কুপি জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসে শুনত। হাসান হোসেন, কারবালার গল্পগুলো বুঁদ হয়ে শুনতেন। তখন মানুষের গল্পের প্রতি ছিল মনযোগ। যেহেতু গত দুই বছরে পুঁথিটা একটু একটু করে আগাচ্ছে। তারমানে আমরা এটাকে অল্প হলেও পুনর্জীবিত করতে পেরেছি মনে হয়।
এখন তো নতুন নতুন অনেক কিছু এসেছে। এখন সেই বাস্তবতা যেহেতু নেই, পুঁথিকে নতুন রূপ দিয়ে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে।

ষষ্ঠবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলেন। এখনও কি প্রথমবার পাওয়ার সেই অনুভূতি হয়?

যতবারই পেয়েছি কাজের প্রতি উৎসাহিত হয়েছি। দায়িত্ব বেড়েছে। আমি মনে করি, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলে শিল্পীর দায়িত্ব বেড়ে যায়। আরও বেশি ভালো কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার দায়িত্ববোধ জন্ম নেয়। কারণ, একজন অভিনেতার এর চেয়ে বড় পুরস্কার পাওয়ার সুযোগ নাই। এছাড়া স্বাধীনতা পুরস্কার আছে, একুশে পদক আছে; কিন্তু সেগুলো তো অন্য বিষয়। শিল্পীর কাজের পরিপ্রেক্ষিতে বড় পুরস্কার এই জাতীয় পুরস্কারই। এটা সমাজের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি, মানুষের প্রতি দায়িত্বের অনুভব তৈরি হয়। সেগুলো পালনের চেষ্টা করি। আর প্রতি বারই প্রথমবার পাওয়ার মতো অনুভূতি হয়।

আপনার নাটকের দল আরণ্যকের বয়স হল ৫০ বছর। দেশের প্রেক্ষাপটে একটা নাটকের দল হিসেবে ৫০ বছর টিকে থাকাটা বড় অর্জন।

হ্যাঁ এটা অনেক বড় অর্জন। একটি নাটকের দল বাংলাদেশের সমান বয়সী। এবং এই নাটকের দলের যারা প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমাদের মামুনুর রশিদ ভাইয়ের কথা উল্লেখ করা যায়, তিনি ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধ করে এসে আর কোনো কাজ করেন নাই। মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতায় নাটক দেখেছেন। গ্রুপ থিয়েটার কনসেপ্টের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। এবং দেশে এসে এই গ্রুপ থিয়েটার নিয়েই কাজ করেছেন। এখন পর্যন্ত নাটকই করেছেন। আমার সৌভাগ্য এমন একটা দলের সঙ্গে ৪০ বছর ধরে যুক্ত আছি।  

আরণ্যক যে প্রত্যাশা নিয়ে গঠিত হয়েছিল তা কি পূরণ করতে পেরেছে?

আরণ্যক শুধু শিল্পের জন্য শিল্পচর্চা করে তা না; মানুষের জন্যও করে। আরণ্যকের মূল স্লোগান, ‘নাটক শুধু বিনোদন নয়; শ্রেণি সংগ্রামের হাতিয়ার’। স্লোগানটাই বুঝিয়ে দেয় আরণ্যক কী ধরনের কাজ করতে চেয়েছে, কী ধরনের কাজ করে। আরণ্যক মানুষের মুক্তির কথা বলে, সমতার কথা বলে, সমাজতন্ত্রের কথা বলে, অধিকারের কথা বলে। সেই ধারা এখনো বজায় রেখেছে। আরণ্যক এমন একটি দল টানা ৫০ বছর নাট্যচর্চা করে আসছে। তবে দেশের বৈরি পরিবেশের কারণে ১৯৭৫-৭৬ সালের দিকে বছর দুয়েকের একটা গ্যাপ ছিল। এছাড়া আর কখনো গ্যাপ দেয়নি; বরং বিভিন্ন সময় জাতীর সংকটে আরণ্যক নাট্যদল তথা আমাদের গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন সবসময় মানুষের পাশে থেকেছে। যেমন ১৯৭৩ সাল থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত সেনা শাসনের সময়ে আমরা পথনাটকের ভেতর দিয়ে দেশের মানুষের মুক্তির কথা বলেছি, গণতন্ত্রের কথা বলেছি। এমনও দেখা গেছে- দোয়েল চত্বর, টিএসসি, শহীদ মিনার কিংবা বাহাদুর শাহ পার্কে স্বৈরাচারবিরোধী পথনাটক করছি, অফিস পাড়ার লোকজন অফিস থেকে ফেরার পথে ভিড় বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের নাটক দেখছে। আমাদের বক্তব্যের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছে।
এছাড়া আপনি যদি ‘রাঢ়াঙ’ দেখেন, দেখবেন আমরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শাঁওতালদের অধিকারের কথা বলছে। যদি ‘ওরা কদম আলী’ দেখেন, দেখবেন ঘাটের বোবা কদম আলীর মধ্য দিয়ে সংগ্রাম ও দেশের কথা বলছে। এভাবে ‘জয় জয়ন্তী’র মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গল্প, মানুষের অধিকার ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলছে।

আপনাকে ফজলুর রহমান বাবু হিসেবে গড়তে আরণ্যকের ভূমিকা জানতে চাই।

আরণ্যকই আমার স্কুল। সেখান থেকেই সব শিখেছি। তারপরও আমরা যারা অভিনয় করি, সমাজের নানা জায়গা থেকে আমাদের শিখতে হয়। তবে মূল শিক্ষালয় হচ্ছে আরণ্যক। আর আরণ্যক যে শুধু অভিনেতা তৈরি করছে তা না। মানুষ হওয়ার শিক্ষাটাও সেখান থেকেই পাওয়া। একটা নাটকের দলে মানুষ হওয়াটা আগে শেখানো হয়।

আপনি, চঞ্চল চৌধুরী, আ খ ম হাসান, বৃন্দাবন দাসসহ দেশে জনপ্রিয় অনেক শিল্পীই আরণ্যক থেকে এসেছে। আরণ্যকের এই সফলতার রহস্য কী?

শুধু আরণ্যকের শিল্পীরাই ভালো কাজ করছে তা না। অন্য অনেক দলের শিল্পীরাও ভালো করছে। দেশের মানুষ হয়তো নাটক-সিনেমায় যারা অভিনয় করেন তাদেরই চেনেন, এর বাইরেও আরণ্যকে অনেক ভালো ভালো শিল্পী আছেন। এর মূল কারণ হলো প্রপার স্কুলিং। শিল্পীর প্রধান কাজ অভিনয়, এই অভিনয়টা তো শিখতে হবে। শিক্ষা, অনুশীলন, চর্চা ও সাধনার ভেতর দিয়ে আসে বলেই আপনি যাদের নাম বললেন তারা এত জনপ্রিয়। এরা এখনো এই প্রক্রিয়ার ভেতরেই আছে। এটা হঠাত করে তৈরি হয় না, দীর্ঘ চর্চার মধ্য দিয়ে চঞ্চলদের মতো শিল্পীর জন্ম হয়।

সিনেমার সঙ্গে আপনার সম্পৃক্ততা কেমন, থিয়েটার করার সময় সিনেমা দেখতেন?

আমি যখন থিয়েটার করি তখন দেশের সিনেমার অবস্থা খুব ভালো ছিল সেটা বলা যাবে না। এমন অনেকেই আছেন তখন ২০-২৫ বছর সিনেমা হলে যায়নি। স্বাধীনতার পর খুব বেশি ভালো সিনেমা তৈরি হয়নি। বছরে একটা দুইটা ভালো সিনেমা আসত। সেটা দিয়ে তো আর সমগ্র সিনেমাকে বিবেচনা করা যায় না। তখন প্রায় দুই হাজার হল ছিল। সিনেমার টার্গেটেড দর্শকও ছিল অন্য এক শ্রেণির দর্শক। যার কারণে খুব বেশি সিনেমা দেখা হয় নাই। ভালো ছবি হলে অবশ্যই দেখতাম।

প্রথম হলে বসে সিনেমা দেখার কথা মনে আছে?

আমার যদ্দুর মনে পড়ে ১৯৬৬ সালে আমার মায়ের কোলে বসে রূপবান ছবি দেখেছিলাম।

আপনি এখন নাটক, চলচ্চিত্র ও ওটিটি কনটেন্টে অভিনয় করছেন। নতুন এ মাধ্যম নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

সব জায়গায় তো আমরা অভিনয়ই করি। মঞ্চে অভিনয় করতে হয়, চলচ্চিত্রের অভিনয় করতে হয়, এখন ওটিটিতে অভিনয় করছি। খুব বেশি পার্থক্য নেই। তবে মাধ্যমটাকে একটু বুঝে অভিনয় করলে ভালো হয়। পার্থক্য ওই বোঝার জায়গাটাই।