Published : 19 Sep 2024, 02:12 PM
ঢাকাই সিনেমার প্রয়াত নায়ক সালমান শাহ মাত্র যে চারটি বছর কাজ করেছিলেন, তাতেই হয়েছিলেন খ্যাতিমান, নব্বইয়ের শুরুতে দেশের সিনেমাঙ্গনকে দেখিয়েছিলেন নতুন দিশা। সেই নায়কের কর্ম ও ব্যক্তিজীবনের নানা ঘটনা তুলে ধরতে তার জীবনী নিয়ে সিনেমা তৈরি হতে চলেছে।
এই বায়োপিক নির্মাণ করবেন পরিচালক ছটকু আহমেদ, যিনি সালমানের জনপ্রিয় সিনেমা ‘সত্যের মৃত্যু নেই’র নির্মাতা।
ছটকুর ভাষ্য, বায়োপিক নির্মাণের এই কাজটি হাতে নিয়েছি প্রয়াত পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে।
তিনি বলেন, “সোহানই সালমানকে পর্দায় এনেছিলেন। তিনিই ইমনকে (সালমান শাহ) সালমান বানিয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষের কাছে।সোহানের ইচ্ছা ছিল সালমানের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা দেশের মানুষ জানুক।“
ছটকু গ্লিটজকে বলেছেন, বায়োপিকের চিত্রনাট্যের কাজ প্রায় শেষ, নাম ঠিক করা হয়েছে ‘স্বপ্নের রাজকুমার’।
অভিনয়শিল্পী চূড়ান্ত করে শিগগিরই 'স্বপ্নের রাজকুমার' সিনেমার কাজ শুরু করবেন বলে জানিয়েছেন পরিচালক ছটকু।
বেঁচে থাকলে সালমানের বয়স হত ৫৩, কিন্তু মাত্র ২৫ বছর বয়সে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ায় তিনি আটকে আছেন যুবা বয়সেই।
বৃহস্পতিবার সালমানের জন্মবার্ষিকী, তার পারিবারিক নাম শহীদ চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন। নায়কের মৃত্যুদিনও গেছে চলতি মাসের ৬ তারিখে।
দুটি দিনেই নায়ককে স্মরণ করেছেন তার সতীর্থ ও অনুজরা। 'মৃত্যু রহস্য, অভিনয়, ফ্যাশন' নিয়ে সব প্রজন্মের কাছেই এখনো চর্চিত নাম সালমান শাহ।
চার বছরের অভিনয় ক্যারিয়ারে সালমান সিনেমা করেছেন ২৭টি।
নায়কের জীবনী নিয়ে পরিচালক ছটকু বলেন, “সালমানকে নিয়ে সিনেমা করব, তাই নানা বিষয় জানা দরকার ছিল।সালমানের স্ত্রী সামিরা হকের কাছ থেকে তার গল্প শুনেছি আমি, সে আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছে। এছাড়া সালমানের জীবনের ঘটনা, অভিনয় জীবন সব কিছুর গল্প রেকর্ড করে আমাকে পাঠিয়েছিল সামিরা। সেই রেকর্ড শুনে শুনে, সেখান থেকে নির্যাস নিয়ে সিনেমার গল্প লিখেছি।”
সিনেমায় সালমানের চরিত্রে বা অন্যান্য অভিনয় শিল্পী নির্বাচনে এখনকার অল্পবয়সী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ছটকু।
তিনি বলেন, “যারা সালমানের খুব ভক্ত এবং সালমানকে এখনো আইডল মানেন, এরকম কিছু আর্টিস্ট খুঁজে বের করা হবে।”
বায়োপিকের মূল স্বপ্নদ্রষ্টা প্রয়াত পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানকে নিয়ে ছটকু বরেন, ”উনি (সোহানুর রহমান সোহান) সামিরাকে রেকর্ড নিতে সাহায্য করেছিলেন। সোহানের ইচ্ছে ছিল এই সিনেমাটা করার। যেহেতু সে বেঁচে নেই, তাই সোহানের স্বপ্নটা পূরণ করতে সিনেমাটা করার দায়িত্ব আমি নিয়েছি। আমার সব ধরনের প্ল্যানিং এবং সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। এখন অভিনয়শিল্পী বাছাই করে সিনেমার কাজে হাতে দিব।"
কথায় কথায় গ্লিটজকে ছটকু জানালেন, ১৯৯৬ সালে সালমান শাহর মৃত্যুর ঠিক এক সপ্তাহ পর ১৩ সেপ্টেম্বর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল ওই সময়ে সাড়া তোলা সিনেমা ‘সত্যের মৃত্যু নেই’।
তাদের পরিকল্পনা ছিল সালমানের জন্মদিনের ছয়দিন আগে সিনেমাটি মুক্তি দেওয়ার এবং সেটাই করা হয়েছিল। কিন্তু সিনেমা মুক্তির আগেই না ফেরার দেশে চলে যান এই নায়ক।
“প্রায় দুই মাস আগে থেকেই পরিকল্পনা অনুযায়ী পোস্টার, ব্যানার প্রস্তুত করে জেলায় জেলায় পাঠিয়েছিলাম। সিনেমার প্রমোশনেও যাওয়ার কথা ছিল সালমানের। কিন্তু সালমানের মার মৃত্যুর খবরে স্তব্ধ হয়ে যাই”, বলেন ছটকু।
ওই সময়ের স্মৃতিচারণ করে ছটকু বলেন, “১৩ সেপ্টেম্বর সিনেমার মুক্তির দিনে তাকে নিয়ে কোথায় কোথায় যাব সেসব নিয়ে সালমানের সঙ্গে কথা হয়েছিল। আগেতো সিনেমা মুক্তির প্রস্তুতি শুরু হত দুই মাস থেকে আগে থেকে। হলে বুকিং দেওয়া, ট্রেনে করে বিভিন্ন জায়গায় প্রিন্ট চলে যেত, পোস্টার, ব্যানার সবই চলে গিয়েছিল। ছেলেটা এমন কিছু করে বসবে আন্দাজও করতে পারিনি।”
সালমানের মৃত্যুর খবর কখন পান জানতে চাইলে এই পরিচালক বলেন, “সালমান যেদিন মারা গেল সেদিন ছিল আমার স্ত্রীর জন্মদিন। বাসায় বসে আমরা জন্মদিন উদযাপনের প্রস্তুতি নিয়ে প্ল্যান করছিলাম। ওইদিন পাকিস্তান-ইন্ডিয়ার ক্রিকেট খেলাও ছিল। আমি খেলা দেখছিলাম সোফায় বসে। ওই সময়টায় কিন্তু একদিকে 'সত্যের মৃত্যু নেই' মুক্তির প্রস্তুতি এবং আরেকদিকে 'বুকের ভিতর আগুন' সিনেমার শুটিং হচ্ছিল।
“আমার সিনেমার পার্টনার সালোয়ার মোর্শেদ আমাকে ওইদিন ফোন করে প্রথমেই ওর মৃত্যুর খবর দেয়নি।জানতে চাইল যে সালমানের সঙ্গে আমার আর কয়দিনের শুটিং বাকি আছে।আরো বলল যদি সালমান কোনো কারণে শুটিংয়ে আমাকে সময় না দেয় তখন কী হতে পারে, সেসব জিজ্ঞাসা করছিল। আমি বললাম কেন সময় দিবে না, সালমানের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো, কোনো লেনদেন বাকি নেই। তখন আমি আসল ঘটনা জানতে চাই।এরপর মোর্শেদ জানাল সালমান আত্মহত্যা করেছে। আমি একদম শকড হয়ে গেলাম।"
সালমানের মৃত্যুর পর ‘সত্যের মৃত্যুর নেই’ মুক্তিতে কোনো জটিলতা তৈরি হয়েছিল? উত্তরে ছটকু বলেন, “সালমান শাহ তখন এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে, সে সময় যদি সিনেমার রিলিজ বন্ধ রাখতাম তাহলে পাবলিক আমাকে মেরে বারোটা বাজিয়ে দিত।”
পরিচালক ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ সিনেমাটিকে ‘ব্যবসাসফল’ বর্ণনা করে বলেছেন, এই চলচ্চিত্রটি কোটি কোটি টাকা ঘরে তোলে।
তিনি বলেন, “সিনেমায় আব্দুল মান্নানের কণ্ঠে 'চিঠি এল জেলখানাতে' গানটি শুনে হাজার হাজার দর্শক কাঁদতে কাঁদতে হল থেকে বের হত। গানের কথাগুলো ছিল মৃত্যু নিয়ে। প্রিয় নায়কের মৃত্যু মানতে না পেরে দর্শকের মধ্যে কান্নার রোল পড়েছিল।“
সালমান শাহ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাননি কেন
তবে শুটিংয়ের কাজ অর্ধেক হয়ে থাকায় 'বুকের ভেতর আগুন' সিনেমা মুক্তি নিয়ে নিয়ে ‘বিপদে পড়েছিলেন’ এই পরিচালক।
সালমানের প্রয়াণের পরে তার অভিনীত কয়েকটি অসমাপ্ত সিনেমা অর্ধেক ‘ডামি অভিনেতা’ দিয়ে সারতে বাধ্য হন পরিচালকরা। কিন্তু সে পথে হাঁটতে পারেননি ছটকু।
তিনি বলেন, "আমার নিজের প্রোডাকশন থেকে তৈরি ছিল 'বুকের ভেতর আগুন' সিনেমাটি। অনেকে বলেছিলেন বাকি শুটিং ডামি দিয়ে কাজ সারতে। কিন্তু আমি রাজি হইনি। অনেকদিন আটকে ছিল সিনেমার কাজ।
“তারপর অনেক ভাবনা চিন্তার পর আমি ফেরদৌস আহমেদকে সিনেমায় যুক্ত করে গল্প পরিবর্তন করে সিনেমা শেষ করি। ওই সময়ে কী যে পেরেশানি আমার গিয়েছে সেটা আসলে এখন বলে বোঝানো যাবে না।"
এই ইন্ডাস্ট্রিতে সালমানের মত এত অল্প সময়ে এত জনপ্রিয়তা এখন পর্যন্ত কেউ ‘অর্জন করেনি ‘বলে মনে করেন পরিচালক ছটকু।
ছটকুর ভাষ্য, "জাফর ইকবালের পর দারুণ একজন হ্যান্ডসাম নায়ক ছিলেন সালমান একজনই। সে ছিল রোমান্টিক হিরো, তার মত স্টাইল, অভিনয়, লুক কারো ছিল না। চার বছরে ২৭টি সিনেমা করা কিন্তু সহজ কথা না। চার বছরে অনেক নায়কের সর্বোচ্চ দুইটা তিনটা সিনেমা হত,
“সে জায়গা থেকে ২৭টা কাজ করে সে ঢাকাই সিনেমায় এক অন্য ইতিহাস তৈরি করেছিল ছেলেটি। তাই এত বছর পরেও সব প্রজন্মের কাছেই চর্চিত নাম সালমান শাহ।"
১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেটের দারিয়াপাড়ায় নানাবাড়িতে সালমান শাহের জন্ম।
বিনোদনজগতে সালমানের যাত্রা শুরু হয় বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেল হিসেবে। গানও গাইতেন, ছায়ানটের পল্লীগীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন এ নায়ক।
সোহানুর রহমান সোহানের পরিচালনায় নায়িকা মৌসুমীর বিপরীতে প্রথম সিনেমা 'কেয়ামত থেকে কেয়ামত' করে ১৯৯৩ সালে বাজিমাত করে দেন সালমান। এই সিনেমার মাধ্যমে ঢাকাই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি উপহার পায় সালমান-মৌসুমী জুটি।তবে সালমানের ক্যারিয়ারের ২৭টি সিনেমার ১৩টির নায়িকাই ছিলেন শাবনূর।
'তুমি আমার’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘সুজন সখী’, ‘বিক্ষোভ’, ‘স্নেহ’, ‘প্রেম যুদ্ধ’, ‘কন্যাদান’, ‘দেনমোহর’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ‘আঞ্জুমান’, ‘মহামিলন’, ‘আশা ভালোবাসা’, ‘বিচার হবে’, ‘এই ঘর এই সংসার’, ‘প্রিয়জন’, ‘তোমাকে চাই’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’, ‘জীবন সংসার’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’, ‘প্রেমপিয়াসী’, ‘স্বপ্নের নায়ক’, ‘শুধু তুমি’, ‘আনন্দ অশ্রু’ ও ‘বুকের ভেতর আগুন’ সালমানের উল্লেখযোগ্য কাজ।
সিনেমায় আসার আগেই সামিরা হককে বিয়ে করেছিলেন সালমান। ১৯৯৬ সালে ৬ সেপ্টেম্বর ইস্কাটনে সালমান শাহর বাসা থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনায় মামলা করেন সালমান শাহর বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী। পরিবারের পক্ষ থেকে বরাবরই দাবি করা হয়েছে সালমানকে খুন করা হয়েছে।কিন্তু সালমান শাহর মৃত্যু এখনো তার ভক্তদের কাছে রহস্যজনক।