আগামী চার মাসের মধ্যে বিশেষ একটি কমিটি গঠন করা হবে, যেখানে ফেডারেশনসহ সব গিল্ডের বর্তমান নিয়মনীতি সংস্কার করা হবে।
Published : 31 Jul 2024, 12:54 PM
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে অচল দশা কাটতে চলেছে বাংলা সিনেমার ইন্ডাস্ট্রির।
মমতার নির্দেশে বুধবার থেকেই টলিপাড়ায় ফের শুটিং শুরু হতে চলেছে বলে জানিয়েছেন পরিচালক গৌতম ঘোষ, অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এবং দীপক অধিকারী দেব।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বরাতে এই নির্দেশক-অভিনেতারা বলেছেন, চাইলেই কাউকে নিষিদ্ধ করার এখতিয়ার কোনো সংগঠনের থাকছে না।
এছাড়া আগামী চার মাসের মধ্যে বিশেষ একটি কমিটি গঠন করা হবে যেখানে ফেডারেশনসহ সব গিল্ডের বর্তমান নিয়মনীতি সংস্কার করা হবে বলে লিখেছে কলকাতার বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার।
ঢাকার ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকির সিনেমা ‘লহু’র ভারতীয় নির্মাতা রাহুল মুখার্জিকে নিয়ে ডিরেক্টরস গিল্ড এবং টেকনিশিয়ান ফেডারেশনের বিভক্তির কারণে গত সপ্তাহ থেকে স্টুডিওপাড়া অচল হতে শুরু করে।
এরপর রাহুলের সঙ্গে কাজ করতে টেকনিশিয়ানরা সরাসরি অস্বীকৃতি জানালে পরিচালকদের সঙ্গে তাদের রেষারেষি চরমে পৌঁছায়। ওই অবস্থায় সোম ও মঙ্গলবার পরিচালকরা কর্মবিরতির ডাক দিলে তাদের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে ফেডারেশনের বিরুদ্ধে জোট বাঁধে ছোট পর্দার প্রযোজকদের সংগঠন ডব্লিউএটিপি ও আর্টিস্ট ফোরাম।
ফলে তালা পড়ে যায় টালিগঞ্জের এনটি ওয়ান, টেকনিশিয়ান ও ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে। নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীদের কাজের ভিড়ভাট্টাও উধাও হয়ে যায় স্টুডিওপাড়া থেকে।
এই পরিস্থিতিতে সমস্যার সমাধানে পৌঁছাতে পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক করেন। তারা ফেডারেশনকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানালেও তাতে সাড়া মেলেনি। বরং রাহুলকে ‘বয়কট’ করার সিদ্ধান্তে নিজেদের আটল অবস্থানের কথা জানিয়ে দেন ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস।
কর্মবিরতির দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার পরিচালক এবং ফেডারেশন কর্তৃপক্ষ প্রথমে আলাদা আলাদা বৈঠকে বসেন।
তারপর রাজ্য সচিবালয় নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পরিচালক গৌতম ঘোষ, অভিনেতা প্রসেনজিৎ, দেব এবং মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। বৈঠক শেষে সংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তারা জানিয়ে দেন, বুধবার থেকে শুটিং শুরু হবে।
গৌতম ঘোষ বলেন, “আমরা কৃতজ্ঞ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। তিনি আমাদের সময় দিয়েছেন এবং আমাদের সমস্যা শুনেছেন। সমাধানের পথও বলে দিয়েছেন। বুধবার থেকে শুটিং হবে বলে আশা করছি।”
সাংসদ অভিনেতা দেব বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছেন আর কাউকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা যাবে না। জরিমানা হতে পারে। কিন্তু কারও অন্নসংস্থান ছিনিয়ে নেওয়া যাবে না।”
বিশেষ কমিটি গঠন ও নীতি সংস্কার নিয়ে প্রসেনজিৎ বলেন, “পরিচালকদের আগের দাবি মেনে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হবে। এবং ফেডারেশনের আগের নিয়মকানুন থাকছে না। ফেডারেশনসহ সব গিল্ডের নিয়মনীতি নতুন করে পর্যালোচনা এবং সংস্কার করা করবে ওই বিশেষ কমিটি। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, নভেম্বর মাসের মধ্যে এ সংক্রান্ত নতুন নিয়ম কার্যকর করতে হবে। নতুন আইনে সিনেমার বাজেট, রাজ্যের বাইরে থেকে আসা শুটিং ইউনিটের কাছে বেশি টাকা দাবি না করাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংস্কার করা হবে।
“আমরা বা ওরা নয়, সবটাই আমরা। আমরা সবাই মিলে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির কিসে ভাল হয়, তার জন্যই চেষ্টা চালিয়ে যাব।”
এই অভিনেতারা জানিয়েছেন, বিশেষ কমিটিতে থাকবেন পরিচালক গৌতম ঘোষ, মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, ইন্দ্রনীল সেন, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এবং দেব।
এছাড়া রাহুলই যে পূজার সিনেমার পরিচালক থাকবেন, সে বিষয়েও মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানান প্রসেনজিৎ। এসভিএফের প্রযোজনায় প্রসেনজিৎ ও অনির্বাণ ভট্টাচার্যকে থ্রিলারধর্মী ওই সিনেমার শুটিং শুরু হবে আর সাত দিন পর।
এদিকে আর্টিস্ট ফোরামও মঙ্গলবার একটি বিবৃতি দিয়ে পরিচালকদের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। এই সংগঠনের কথা হল, শিল্পীদের যেন অবজ্ঞা না করা হয়। সেইসঙ্গে তারা মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে গঠন হতে চলা বিশেষ কমিটিতে অংশগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
এরপর রাতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ফেডারেশন সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে ফোন করেছিলেন। আমরা কিছু নির্দেশ পেয়েছি। আগামী দিনে আমরা সেই মত কাজ এগিয়ে নিয়ে যাব।’’
কিন্তু রাহুলকে তারা পরিচালক হিসেবে মেনে নিচ্ছেন কী না, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও স্পষ্ট করেনি ফেডারেশন।
স্বরূপ বলেন, “বুধবার আমাদের সদস্যদের বৈঠকে এই প্রসঙ্গে আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।’’
সমস্যার উৎস কোথায়
গত বছরের অক্টোবরে ভারতে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’। তখন রাহুল ঢাকার অভিনেতা আরিফিন শুভ এবং কলকাতার নায়িকা সোহিনী সরকারকে নিয়ে ‘লহু’ নামের সিনেমার কাজ শুরু করেন। শুটিং কাজ শুরু হয় ডিসেম্বর মাসে।
তারপর খবর আসে, টেকনিশিয়ান ফেডারেশন চরকির কাছে কাজের জন্য অতিরিক্ত টাকা দাবি করায় চারদিনের শুটিং করে চরকি টিম কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে আসে। বন্ধ হয়ে যায় ‘লহু’র কাজ।
সিনেমার কাজ ফের শুরু করতে এর মাঝে ঢাকায় এসে চারদিন কাজ করে কিছু শুটিং শেষ করেন রাহুল। এই খবর জানাজানি হলে তৈরি হয় জটিলতা। ঢাকায় শুটিংয়ে কলকাতার টেকনিশিয়ানদের না নেওয়ায় তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
রাহুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তিনি ডিরেক্টরস গিল্ড এবং ফেডারেশনের অনুমতি না নিয়ে ‘লহু’র শুটিং করতে ঢাকায় গিয়েছিলেন। এ নিয়ে পরিচালককে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয় হয়। রাহুল প্রথমে ঢাকায় এসে কাজ করার কথা অস্বীকার করলেও পরে নিজের ভুল স্বীকার করে শুটিংয়ের কথা স্বীকার করেন।
এর পরে রাহুলের ওপরে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা দেয় ডিরেক্টরস গিল্ড। আর টেকনিশিয়ান ফেডারেশন তাকে ‘নিষিদ্ধ’ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
পরে রাহুল নিজেকে নির্দোষ দাবি করে তার পক্ষে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ ডিরেক্টরস গিল্ডের হাতে তুলে দেন।
এরপর তদন্ত করে শুক্রবার ডিরেক্টরস গিল্ড আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়, রাহুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ‘ভুল প্রমাণিত হওয়ায়’ তারা এই পরিচালককে নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি দিচ্ছে। এবং রাহুল পূজার সিনেমার কাজ শুরু করতে পারেন বলেও জানিয়ে গেয় ডিরেক্টরস গিল্ড।
এই খবরে ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস ঘোষণা দেন, রাহুলের পরিচালনায় কোনো টেকনিশিয়ান কাজ করবেন না। তবে সৃজনশীল পরিচালক হিসেবে তিনি কাজ করতে পারবেন।
ডিরেক্টরস গিল্ডের সম্পাদক সুদেষ্ণা রায় বলেন, “পরিচালনায় রাহুলের কাজ করতে বাধা নেই। তবে পূজা উপলক্ষে তিনি তার নতুন সিনেমার পরিচালনায় থাকতে পারবে না। এর বদলে তিনি কাজ করবেন সহকারী প্রযোজক হিসেবে।”
তাই বাধ্য হয়ে তখন পরিচালক সৌমিক হালদারকে সিনেমার পরিচালনার দায়িত্ব দেয় এসভিএফ।
ডিরেক্টরস গিল্ডের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের পর শনিবার রাহুলের পূজার সিনেমার শুটিংয়ে যোগ দিতে সেটে পৌঁছে যান অভিনেতা প্রসেনজিৎ, অনির্বাণ, প্রযোজক শ্রীকান্ত মেহতা এবং এই টিমের অন্যান্যরা। কিন্তু সেদিন সেখানে পরিচালকের ভূমিকাতেই রাহুলকে দেখা যায়। এতে বেঁকে বসেন কলাকুশলীরা। তার কাজ গুটিয়ে সেটের বাইরে চলে যান।
টেকনিশিয়ান ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস বলেন, “কলাকুশলীরা কাজ করতে চাইছে না কারণ আমরা মনে করি রাহুল নিয়ম ভেঙেছে। এবং সংগঠনের নিয়ম যারা ভাঙবেন তাদের সঙ্গে কোনো দিন কাজ করবেন না ফেডারেশনের সদস্যরা। কলাকুশলীরা ন্যায্য পাওনা পেলে, সকলে সঠিক পথে চললে সমস্যা হবে না।”
এরপর বিষয়টি নিয়ে পরিচালকরা চুপ থাকতে পারেননি। ক্ষুব্ধ হয়ে কর্মবিরতিতে যান রাজ চক্রবর্তী, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, অনীক দত্ত, অনিরুদ্ধ চৌধুরী, অপর্ণা সেন, অঞ্জনত্ত, অতনু ঘোষ, দেবালয় ভট্টচার্য, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টচার্যসহ আরো অনেকে।
এদিকে এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাহুলের পূজার সিনেমার প্রযোজনা সংস্থা এসফিএফ এর কর্ণধার শ্রীকান্ত মেহতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, প্রয়োজনে রাহুলের সিনেমা বন্ধ করে দেওয়া হবে।
তবে পরে তিনি বলেছেন, প্রসেনজিৎ ও অনির্বাণকে নিয়ে রাহুলই সিনেমাটি বানাবেন। এসভিএফ রাহুলের পাশে আছে।
টেকনিশিয়ানদের কর্মবিরতি অব্যাহত থাকলে সিনেমা পূজায় প্রেক্ষাগৃহে আসবে কী না প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “ধৈর্য্য ধরুন। রাহুলের পরিচালনাতেই সুন্দর করে সব কাজ হবে। পূজায় সিনেমা মুক্তি পাবে। প্রেক্ষাগৃহ উপচে পড়বে দর্শকে।”
পুরনো খবর
ঢাকা-কলকাতার সিনেমা ঘিরে 'অচল' টালিগঞ্জ
অচলাবস্থা কাটেনি টালিগঞ্জে, মধ্যস্থতা চাইছেন নির্মাতারা