প্রায় এক যুগ আগে 'আজব কারখানা' সিনেমার ভাবনা তৈরি হয় নির্মাতা শবনম ফেরদৌসীর।
Published : 15 Jul 2024, 10:12 PM
এক শীতের শেষে দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দুয়েকটা গাছ দেখতে দেখতে যে ফ্রেমটি মনের ছবিতে দেখে ফেলেছিলেন পরিচালক শবনম ফেরদৌসী, সেই ছবিই এখন ‘আজব কারখানা’ সিনেমা হয়ে ধরা দিয়েছে, যা চলছে দেশের পাঁচটি প্রেক্ষাগৃহে।
প্রায় এক যুগ আগের এই সিনেমা তৈরির ভাবনা শবনমের মাথায় আসে। গত শুক্রবার সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষার সমাপ্তি হয়েছে নির্মাতার। রাজধানীর স্টার সিনেপ্লেক্সের বসুন্ধরা ও সনি স্কয়ার শাখা, যমুনা ফিউচার পার্কের ব্লকবাস্টার সিনেমাস, কেরানী গঞ্জের লায়ন্স সিনেমা এবং চট্টগ্রামের সিলভার স্ক্রিনে ‘আজব কারখানা’ চলছে।
রাজধানীর বনানীতে একটি স্টুডিওতে গ্লিটজের সঙ্গে আলাপে একজন রকস্টারের জীবন নিয়ে সংগীত নির্ভর সিনেমা বানানোর গল্প বলেন শবনম। তার ভাষ্য, ‘আজব সিনেমা’ কোনো কল্পনা প্রসূত কাজ নয়, জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ একটি সিনেমা।
শুরুর দিকের স্মৃতি হাতড়ে শবনম বলেন, ২০১২ সালে শিল্পী বাপ্পা মজুমদারকে নিয়ে নেত্রকোণায় 'গানের টানে' শিরোনামে মিউজিক ট্রাভেল শো করতে গিয়ে এই সিনেমার গল্প তার মাথায় আসে।
“ওই ট্রাভেল শোর দ্বিতীয় পর্বের শুটিং শেষ করে সবাই তখন চা খাচ্ছিল, আর আমি সেখানকার একটা মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে গ্রামের দৃশ্য দেখতে দেখতে আর গান নিয়ে নানা কথা ভাবতে ভাবতে সিনেমার গল্প কিছুটা ভেবে ফেলি।
"বাংলার আদি ও অকৃত্রিম উৎস লোক গানের শিল্পীরা আজও যার যার নিজের এলাকায় যেমন জনপ্রিয়, তেমনি আবার পপ ঘরানার আধুনিক শিল্পীরা জনপ্রিয় শহরের মানুষের কাছে। পপ শিল্পীদের গান শুনতে শহরে এত এত ভিড়, উন্মাদনা। এই তাদের অস্তিত্বটা ঢাকা থেকে কিছুটা দূরে তেমন একটা নেই।
“যেমন লোকশিল্পী কিতাব আলী বাউল, সাইদুর রহমান বয়াতি, হেলিম বয়াতি, বিনু বয়াতির কথা যদি বলি, তারা তাদের এলাকায় সুপারস্টার। তারা যে ধরনের গান গায়, তাদের যে সুর, সেটা কিন্তু আধুনিক শিল্পীদের থেকে ভিন্ন। অর্থাৎ গ্রাম ও শহরের বিশাল একটা গ্যাপ আছে। এটা সিনেমায় দেখিয়েছি।”
শিল্পী বাপ্পা মজুমদার এবং 'মাইলস' ব্যান্ডের হামিন আহমেদের সঙ্গেও এ সিনেমার ভাবনা নিয়ে আলাপ করেছিলেন শবনম। তাদের কাছ থেকে পাওয়া কিছু পরামর্শ এবং নিজের চিন্তাভাবনা থেকে পরে রকস্টারের জীবন নিয়ে সিনেমা বানাতে লেগে যান।
শবনম বলেন, " বাপ্পা মজুমদারতো ভালো পপ সিঙ্গার, খুবই সহযোগিতা করেছেন। আমার মনে হল সিনেমাটি যখন নির্মাণ করব এই গ্রামের লোকসংগীত শিল্পী এবং শহরের পপতারকা এই দুই ঘরানা নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব জাগিয়ে তুলি। কারণ পপ বা রক এসব শিল্পীরা একটু ইমোশনাল হয়, তাদের মধ্যে এটিটিউড, ভাবের একটা ব্যাপার থাকে৷ আমি চরিত্রটা একজন রকশিল্পীর ফর্মেই নিলাম। তারপর গল্পটা নিয়ে মাইলসের হামিন আহমেদের সঙ্গেও আলাপ করলাম। হামিন ভাই পরামর্শ দিলেন গল্পটা যেন রক শিল্পী হিসেবেই দেখানো হয়।”
সিনেমার নাম 'আজব কারখানা' দেওয়ার কারণ নিয়ে শবনম বলেন, "লালন সাঁই 'আজব কারখানা' শব্দটি যে অর্থে ব্যবহার করেছেন সেটা হল মিস্ট্রি। যেখানে আধ্যাত্মবাদের একটা ব্যাপার আছে। এটা শুধু অদ্ভুত, আশ্চর্য নয়৷ আজব মানে কিছু একটা মিরাকল হয়ে যাওয়া। যেটা ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না।
“আর কারখানা মানে হল এই যে মানুষের পৃথিবী, তাদের চিন্তা ভাবনা, তাদের জগৎ সব মিলিয়ে যে অদ্ভুত এক কারখানা। সেই চিন্তা থেকেই এই নাম দেওয়া। এই সিনেমায় ক্ষেত্রে এই যে শিল্পের জগত, শিল্পী সত্তা, মিডিয়া এই জায়গাটাতেই সবসময় কিছু না কিছু ঘটমান থাকে। সেইখানে শিল্পের যে উপস্থিতি এটাই আসলে আজব কারখানা।"
এ সিনেমায় ‘রকস্টার’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন কলকাতার অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু পরমব্রতই কেন?
শবনম বলেছেন, ২০১৭ সালে সিনেমাটি বানানোর জন্য অনুদান পাওয়ার পর প্রায় এক বছর তিনি দেশের শিল্পীদের নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছেন।
“কিন্তু আমরা ব্যর্থ হই। একজন রকস্টারের চরিত্রে অন্য সবার চরিত্র থেকে ভিন্নতা আছে। গিটার বাজিয়ে গান গাওয়ার ব্যাপার আছে। অনেক জায়গায় তাকে মিউজিক করতে হবে, গান গাইতে হবে। যাদের নিয়ে আমাদের ভাবনা ছিল তাদেরকে নতুন করে তৈরি করা সম্ভব ছিল না।
“বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আনা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। সংগীতটাকে ভেতরে ধারণ করার একটা যে বিষয় থাকে, সেটা আমরা পাইনি। আবার অনুদানের সিনেমা যেহেতু নির্মাণের একটা সময় বেঁধে দেওয়া থাকে। তারপর শেষ মুহূর্তে গীতিকবি আসিফ ইকবাল ভাই আমাকে পরামর্শ দেন পরমব্রতকে নেওয়ার জন্য। যোগাযোগ করিয়ে দেন।
“পরমব্রতকে যখন ফোনে গল্পটা বলা হয় তখন তিনি বলেন, 'এটা তো আমার জীবনেরই গল্প'। কারণ সে নিজে গান গায়, পপ, রক, ফোক নিয়ে ফিউশন করে এসেছেন। সিনেমায় প্লে ব্যাকও করেছেন। উনি চরিত্রটা খুব সুন্দর করে ধারণ করেছেন।"
এই দীর্ঘ সফর, সিনেমা নিয়ে প্রত্যাশা কেমন? শবনম বলেন, "ভয়টা বেশি,তবে প্রত্যাশা কম। প্রত্যাশা কম থাকলে হারানোর কিছু থাকে না। আমার সিনেমা তো ব্লকবাস্টার, বাণিজ্যিক সিনেমা নয়, খুব বেশি প্রচার করিনি। সেই অর্থও নেই। সেই জায়গা থেকে আমাদের এই সিনেমার যে কিছু দর্শক আছে। যারা এটা সম্পর্কে জানে, দেখার অপেক্ষায় ছিল। তাদের বাইরে যদি কেউ দেখে তাহলে সেটা হবে আমার অনেক বড় পাওয়া৷"
তবে দর্শক সিনেমাটি দেখে ‘হতাশ হবেন না’ বলেই পরিচালকের বিশ্বাস।
তিনি বলেন, “শিল্পীর গল্প বলে হলেও গল্পটা আমাদের প্রত্যেকেরই। আমাদের জীবনের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো সময় আসে যখন আমরা একটুর জন্য আটকে যাই, থমকে যাই। আমরা নিজেদেরকে আবার লুক ব্যাক করি, কিংবা রিয়েলাইজ করার চেষ্টা করি। মানুষের সঙ্গে মিশতে মিশতে একসময় নিজের ভিতরের সত্তাটা পরিবর্তন হয়ে যায়, সে সময় যে ব্যাপারটা ঘটে, এটা দর্শক সিনেমায় দেখতে পারবে।”
প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে জনপ্রিয়তা পেলেও ‘আজব কারখানা’ নির্মাতার প্রথম ফিকশন সিনেমা। অনেকটা চ্যালেঞ্জ নিয়েই নির্মাণ করেছেন।
শবনম বলেন, “ডকুমেন্টরি ফিল্মে অনেক চ্যালেঞ্জ উৎরে গেছি। এই সিনেমার ক্ষেত্রে ও পুরো টিম নিয়ে একটা দৌড়ের ওপরে ছিলাম বলা যায়। তবে পুরো জার্নিটা আমার জন্য আনন্দময় ছিল। কস্টিউম থেকে শুরু করে মিউজিক সাউন্ড প্রত্যেকটি জায়গায় আমি ছিলাম। সব এক প্রকার পার করেই দর্শকের সামনে হাজির হলাম। কারণ এই সংগীত নিয়ে সিনেমা, তাদের নিয়ে সিনেমা খুব একটা এদেশে হয়নি।"
এই সিনেমায় পাঁচটি মৌলিক গান রয়েছে। কবি হেলাল হাফিজের চারটি কবিতা থেকে চারটি গান তৈরি হয়েছে। হেলাল হাফিজের যে কবিতাগুলো সিনেমায় গান হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলোর শিরোনাম হল, 'একবার ডাক দিয়ে দেখ আমি কতোটা কাঙাল', 'কষ্ট নেবে কষ্ট', 'কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো', 'তোমাকেই শুধু তোমাকেই চাই'।
এই গান ভাবনা কীভাবে এল? নির্মাতা বলেন, "আমি প্রচুর গান শুনি। 'ওয়ারফেজ' ব্যান্ডের খুব ভক্ত আমি। অনেক গান খুঁজলাম, শুনলাম। আইয়ুব বাচ্চু, জেমস থেকে শুরু করে সব রকশিল্পীর গানই। একবার মনে হয়েছিল তাদের গানই ব্যবহার করি। কিন্তু পরে প্রযোজক সামিয়া আপার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সিনেমায় নতুন গান তৈরি করে ব্যবহার করব। তারপর অনেক জন গানের লিরিক্স লিখল, কিন্তু কোনোটাই পছন্দ হয় না৷"
"কবি হেলাল হাফিজের বইটা আমার খুব ভালো করে পড়া। লিরিক্যাল লাগে খুব। উনার কবিতায় তারুণ্য আছে। অনেক গতিময়তা আছে। উনি খুব তরুণ অবস্থায় কবিতাগুলো লিখেছিলেন৷ উনার কবিতার মধ্যে বাংলাদেশের যে তারুণ্য সেটা পাই। তারপর এই লিরিকগুলো প্রযোজক সামিয়া আপাকে প্রিন্ট করে দিয়েছিলাম। উনি বলেন, 'এই তো, এটা হচ্ছে লিরিক'। তারপর বই ঘেটে তন্ময় তানসেন, লাবিব কামাল গৌরব তাদের উপর দায়িত্ব দিই। তারা সেগুলো পছন্দ করে। এভাবেই গানগুলো সিলেক্ট করা হয়। গাওয়া হয়। দর্শক গানগুলো পছন্দ করবে।"
সিনেমায় পরমব্রত ছাড়াও অভিনয় করেছেন অভিনেত্রী দিলরুবা দোয়েল ও শাবনাজ সাদিয়া ইমি, অভিনেতা খালিদ হাসান রুমি, হেলিম বয়াতী, কিতাব আলীসহ অনেকে। অভিনেত্রী শাবনাজ সাদিয়া ইমিরও প্রথম চলচ্চিত্র এটি। সাংবাদিক চরিত্রে দেখা যাবে দোয়েলকে।