কবীর সুমন প্রতুল হারনোর শোক প্রকাশ করে ফেইসবুকে বলেছেন, গান যে একটা ‘পারফরম্যান্স’, সেটা নাগরিকদের মধ্যে প্রতুলও প্রথম ‘সিরিয়াসলি দেখালেন’।
Published : 16 Feb 2025, 10:37 AM
এক সময়ের নকশাল আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী এবং সাবেক অধ্যাপক ও ব্যাংক কর্মকর্তা প্রতুল মুখোপাধ্যায় গানকেই সমাজ বদলের হাতিয়ার করেছিলেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সেই শিল্পীর প্রয়াণে স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করছেন কলকাতার শিল্পী কবীর সুমন, লোপামুদ্রা মিত্র, অনুপম রায়সহ আরো অনেকে।
তারা শোকে মুহ্যমান হয়েছেন, স্মরণ করছেন প্রতুলের গায়কীর কথা। তারা বলেছেন গণ মানুষের কথা বলার জন্য সুরে-কথায় যে ভিন্ন ঘরানা প্রতুল তৈরি করে গেছেন তাতেই তিনি হয়ে থাকবেন ‘অবিস্মরণীয়’।
কবীর সুমন প্রতুল হারনোর শোক প্রকাশ করে ফেইসবুকে বলেছেন, গান যে একটা ‘পারফরম্যান্স’, সেটা নাগরিকদের মধ্যে প্রতুল প্রথম ‘সিরিয়াসলি দেখালেন’।
কলকাতার সংবাদমাধ্যম সংবাদ প্রতিদিনের কাছে প্রতুলকে সুমন বর্ণনা করেছেন একজন ‘আনপ্যারালাল পারফর্মার’ হিসেবে।
দেশভাগের আগে বরিশালে জন্ম নেওয়া এ শিল্পীর সুরের সঙ্গে পরিচয় ১২ বছর বয়সে; ওই সময়ে কবি মঙ্গলচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি ধান কাটার গান গাই’ কবিতায় প্রথম সুর দেন প্রতুল ।
তিনি সুর দিয়েছেন- বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষের মত কবিদের কবিতায়।
সুমন বলেন, “এমন কিছু কবিতায় উনি সুর দিয়েছেন যেমন ‘বাবরের প্রার্থনা’, যেগুলো প্রতুলদা ছাড়া অন্য কেউ ভাবতে পারবেন না। প্রকৃত নীরিক্ষামনস্ক বাঙালি নাগরিক, বাংলাভাষী সঙ্গীতকার যদি এজীবনে দেখে থাকি, তিনি প্রতুল মুখোপাধ্যায়।"
গান পরিবেশনে হারমোনিয়াম, তবলা এমনকি কোনো ধরনের বাদ্যযন্ত্রেরই প্রয়োজন হত না প্রতুলের।
কলকাতায় কয়েকটি অনুষ্ঠানে প্রতুলের সঙ্গে সঙ্গতের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে সুমন বলেন, “তার সঙ্গে একটি দুটি অনুষ্ঠানে আমি কিবোর্ডও বাজিয়েছি। সে বহুদিন আগের কথা। অনেকে হয়তো জানেনও না। উনি খালি গলাতেও সুরে গাইতেন। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানের কোনও রিমেক নেই। করা যাবেও না।”
‘ছোকড়া চাঁদের’ সঙ্গে আফ্রিকার শ্রমিকের রাতভর কী কথা- সে গল্প প্রতুল তাদের শুনিয়েছেন। ‘ছোট্ট দুটি পায়ে’ চার্লি চ্যাপলিনের সঙ্গে তিনি শ্রোতাকে দুনিয়া ঘুরিয়েছেন; ‘স্লোগান’ গানে বুঝতে শিখিয়েছেন, কে ভাই, আর কে দুশমন।
তবু ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গানেই প্রতুল বেশি মিশে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের দর্শকদের মাঝে। আর এই গানকে যেন জাতীয় সঙ্গীতের মত মনে করেন লোপামুদ্রা মিত্র।
আনন্দবাজারকে লোপামুদ্রা বলেন, “প্রতুলদাকে নিয়ে আজ বলছি, আপনি তাদের মধ্যে একজন, যাদের জন্য আমি বাংলায় গান গাই।”
প্রতুলের সঙ্গে ১৯৯৩ সাল থেকে পরিচয় লোপামুদ্রার। স্মৃতি হাতড়ে গায়িকা বলেন, “প্রতুলদা আমাদের থেকে অনেকটা বড়। অনেক দিন ধরে চিনি। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই তিনি আমার কাছে ‘প্রতুলদা’। ১৯৯৩ সালের বইমেলায় প্রতুলদার সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল। বইমেলায় খালি গলায় গানের আসর বসত। পরে আবার রবীন্দ্রসদনের একটি অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে একই মঞ্চে গান গাওয়া। সেই অনুষ্ঠানে সুমন-নচিকেতা-অঞ্জনও ছিলেন। প্রতুলদা নিজে কবিতায় সুর দিয়ে গান তৈরি করতেন। সব মিলিয়ে আমার কাছে বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন তিনি।”
লোপামুদ্রা বুঝেছিলেন, গান ছিল প্রতুলের নেশা।
“নিজের মতো গান গেয়ে যেতেন। প্রচার নিয়ে ভাবতেন না। প্রচারবিমুখ ছিলেন বরাবরই। এ জন্য ওঁকে হিংসে হত।”
প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের ‘আমি বাংলার গান গাই’ অনুপম রায়ের কণ্ঠেও শুনেছে মানুষ।
অনুপমের কথায় প্রতুলের গান গাওয়ার ধরন অথবা গান নিয়ে ভাবনাচিন্তা আর পাঁচজনের চেয়ে ভিন্ন ছিল।
“তাকে হারানো আমাদের কাছে বড় ক্ষতি। শুধু একটি গান নয়। তার বহু ভাল অ্যালবাম ছিল। আমি সামনে বসেও তার অনুষ্ঠান শুনেছিলাম। গানের সঙ্গে গল্প করে বলতেন। সেই দৃশ্য আমার আজও মনে আছে।”
অনুপম মনে করেন, প্রতুলের মত শিল্পী আর হবে না।
অনুপম বলেন, “তিনি যে সময়ের মানুষ বা তার যা ভাবনাচিন্তা, তা বর্তমানের শিল্পীদের মধ্যে নেই। এখন হয়ত অন্য রকমের কাজ তৈরি হচ্ছে। তার সময়েও কিন্তু উনি ব্যতিক্রমী ছিলেন।”
৮৩ বছর বয়সে প্রতুল চলে গেছেন শনিবার সকালে। কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রতুলের মৃত্যু হয়।
জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে সরকারি এই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন শিল্পী। হাসপাতালের বিছানায় বসেও ‘আমি বাংলায় গান গাই’ শুনিয়েছেন প্রতুল। এর মধ্যে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের শরীরে একটি অস্ত্রোপচার হয়। এরপর তার হার্ট অ্যাটাকও হয় এবং তিনি আক্রান্ত হন নিউমোনিয়াতেও।
চেতনা হারালে গত মঙ্গলবার তাকে হাসপাতালের আইটিইউতে নেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে আর ফেরানো যায়নি গানে গানে মানুষের কথা বলে যাওয়া এই শিল্পীকে।
প্রথাগতভাবে গানের তালিম না নেওয়া এই শিল্পী তিনি প্রথম গান লেখেন ১৯৬২ সালে । যদিও এর আগে বিভিন্ন কবির কবিতায় সুর দিতেন তিনি। তারপর এক দশক ধরে বেশ কয়েকটি গণসংগীত রচনা করেছেন। নকশালদের মধ্যে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘সেজদা কমরেড’ নামে।
একদিন ব্যাংকে বসে কাজ করতে করতে লিখেছিলেন ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গানটি, তখন সময় ১৯৯৪ সাল।
প্রতুলের প্রথম একক অ্যালবাম ‘যেতে হবে’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে।
তার অ্যালবামগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘পাথরে পাথরে নাচে আগুন’, ‘যেতে হবে’, ‘ওঠো হে’, ‘কুট্টুস কাট্টুস’, ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’, ‘তোমাকে দেখেছিলাম’, ‘স্বপনপুরে’, ‘অনেক নতুন বন্ধু হোক’, ‘হযবরল’, ‘দুই কানুর উপাখ্যান’, ‘আঁধার নামে’।
‘গোঁসাইবাগানের ভূত’ সিনেমায় প্লেব্যাক করেছেন প্রতুল।
আরও পড়ুন
'আমি বাংলায় গান গাই' গানের শিল্পী প্রতুলের প্রয়াণ
প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার
ভালো নেই প্রতুল মুখোপাধ্যায়, চিকিৎসা চলছে হাসপাতালে