বার বার উদ্যোগ নিয়েও মহড়া করা গেল না। আলী যাকের এক পর্যায়ে রামেন্দু মজুমদারকে বলেন, “আপনারা শুরু করুন, আই উইল জয়েন।”
Published : 04 May 2023, 05:21 PM
অভিনেতা আলী যাকের তখন ক্যান্সারে আক্রান্ত; কিন্তু মঞ্চে অভিনয় করার আকাঙ্ক্ষা প্রবল। তাকে মঞ্চে ফিরিয়ে আনার চিন্তা থেকেই পরিকল্পনা করা হয় ‘লাভ লেটারস’ নাটকের। কিন্তু সে নাটকে আর অভিনয় করা হয়নি আলী যাকেরের, তিনি পাড়ি জমিয়েছেন অনন্তলোকে।
আলী যাকেরকে ছাড়াই মঞ্চে আসছে ‘লাভ লেটারস’। আলী যাকেরের প্রিয় সহ-অভিনেতা ফেরদৌসী মজুমদার থাকছেন নাটক। আলী যাকের বেঁচে থাকলে যে চরিত্রটিতে অভিনয় করতেন, সেই চরিত্রে মঞ্চে থাকছেন রামেন্দু মজুমদার।
নাট্য সংগঠন থিয়েটার এর ৪৮তম প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চে আসছে মার্কিন নাট্যকার এ আর গার্নির বিখ্যাত নাটক ‘লাভ লেটারস’ এর বাংলা রূপান্তর।
আবদুস সেলিমের করা বাংলা রূপান্তরের পাঠ-অভিনয় করবেন থিয়েটারের দুই জ্যেষ্ঠ শিল্পী রামেন্দু মজুমদার ও ফেরদৌসী মজুমদার। তাদের সহকারীর ভূমিকায় আছেন রবিন বসাক ও নাজমুন নাহার নাজু।
নাটকটির প্রথম দুটি মঞ্চায়ন হবে শুক্র ও শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় বাংলাদেশ মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।
বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মহিলা সমিতি ভবনের থিয়েটার স্কুলে মহড়ার ফাঁকে নাটকটির নির্দেশক ত্রপা মজুমদারের সাথে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তিনি মেলে ধরলেন স্মৃতির ডালা। বললেন, মহড়ায় না থেকেও আলী যাকের যেন এই নাটকের সাথে জড়িয়ে আছেন নিবিড়ভাবে। ‘লাভ লেটারস’ নাটকের প্রদর্শনীও উৎসর্গ করা হয়েছে প্রয়াত আলী যাকেরকে।
ত্রপা মজুমদার গ্লিটজকে বলেন, “যাকের কাকা তখন কর্কট রোগে আক্রান্ত, তখন আমাদের মনে হয়েছিল, এমন কোনো প্রযোজনা যদি তাকে নিয়ে করা যায়, যেখানে তার শারীরিক পরিশ্রম কম হবে, অথচ আমরা মঞ্চে আরও একবার প্রিয় এই অভিনেতাকে পাব, আর সঙ্গী হবে যাকের কাকার প্রিয় সহ-অভিনেতা ফৌরদৌসী মজুমদার- তাহলে সকলের জন্যই এক অনন্য প্রাপ্তি হতে পারে। এই ভাবনা থেকেই ‘লাভ লেটারস’ নির্বাচন এবং অধ্যাপক আবদুল সেলিমকে রূপান্তরের অনুরোধ।”
২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর এ নাটকটি অধ্যাপক আবদুস সেলিম প্রথম পড়ে শোনান অভিনেতা আলী যাকেরের বাড়িতে। দ্রুত রূপান্তর হল বটে, কিন্তু বাধ সাধলো নির্মম ব্যাধি। বার বার উদ্যোগ নিয়েও মহড়া করা গেল না। আলী যাকের এক পর্যায়ে রামেন্দু মজুমদারকে বলেন, “আপনারা শুরু করুন, আই উইল জয়েন।”
ত্রপা মজুমদার বলেন, “এমনই দুর্ভাগ্য আমাদের, সেই জয়েন করা আর হয়ে উঠল না। ২৭ নভেম্বর ২০২০ আমরা হারালাম মঞ্চ নাটকের অদ্বিতীয় নট- আলী যাকেরকে। লাভ লেটারস প্রযোজনাটি আমরা মঞ্চে আনছি এবং আলী যাকেরের স্মৃতির প্রতি উৎসর্গ করছি।”
মহড়া কক্ষে
বর্ষিয়ান সাংস্কৃতিক সংগঠক রামেন্দু মজুমদার সন্ধ্যা ৭টায় মহড়া দেখতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু পথে হঠাৎ বৃষ্টিতে আটকে যাওয়ায় কিছুটা দেরিতেই পৌছানো গেল। থিয়েটার স্কুলের মহড়া কক্ষের দরজা থেকেই দেখা গেল, ‘লাভ লেটারস’ পাঠে মগ্ন রামেন্দু মজুমদার ও ফেরদৌসী মজুমদার।
মহড়ায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে যখন দ্বিধায়, তখন অভিনেতা রবিন বসাক ও ত্রপা মজুমদার ডেকে নিলেন ভেতরে। এরপর টানা ৩০ মিনিট বসে দেখা গেল দুই খ্যাতিমান শিল্পীর পাঠ অভিনয়।
মঞ্চের দু’পাশে বসে একের পর এক চিঠি পাঠ করে চলেছেন নাটকের দুই চরিত্র অনন্ত শাহেদ চৌধুরী ও মাইশা ইসলাম। তাদের চিঠির বয়ানে উঠে আসছে সময়ের নানা চিত্র।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তী দিনেও অনন্ত-মাইশার অমর বন্ধুত্ব। দুজনের দুটি পথ, কিন্তু চিঠিতে কেমন একই সুতোয় বাঁধা। এই নাটকে চিঠির সেই হারানো সময় নস্টালজিক করে তুলবে অনেককেই।
বহু দেশে বিভিন্ন ভাষায় অসংখ্য প্রযোজনা হয়েছে নাটকটির। বাংলা এই রূপান্তরে যুক্ত করা হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি। নাটকের দুই চরিত্র মাইশা ও অনন্তর জীবনের চলার পথের নানা বাঁক উন্মোচিত হয় পরস্পরকে লেখা চিঠির মাধ্যমে।
তাদের প্রধান প্রধান পর্যায়- কলেজ জীবন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, কর্মজীবন আর সবশেষে আত্ম-অনুধাবন স্তরে উপনীত হওয়ার ছবি ফুটে ওঠে নাটকটিতে।
মহড়ার ফাঁকে রামেন্দু মজুমদার জানালেন, নাটকের গল্পের প্রেক্ষাপট এবং তাদের বয়স সমান্তরাল। ৬০/৭০ বছর আগে থেকে শুরু করে এই সময় পর্যন্ত দুটি মানুষের চিঠির আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে জীবনের নানা বাঁক উঠে এসেছে নাটকটিতে।
মেরাজ ফকিরের মা নাটকে এর আগে একসঙ্গে অভিনয়ে করেছিলেন রামেন্দু মজুমদার ও ফেরদৌসী মজুমদার। অনেক বছর পর এই দম্পতিকে একসঙ্গে দেখা যাবে মঞ্চে। সেই নাটকের নির্দেশক তাদের কন্যা ত্রপা মজুমদার।
অবশ্য রামেন্দু মজুমদার মনে করেন, মঞ্চে তাদের পরিচয় শিল্পী এবং নির্দেশক। গ্লিটজকে তিনি বলেন, “যখন মহড়া কক্ষে প্রবেশ করি, তখন থেকেই আমরা নির্দেশকের কথা মেনে চলার চেষ্টা করি। সেখানে বাবা-মেয়ে সম্পর্কটা ভুলে যাই।”
একই রকম কথা বললেন ত্রপা মজুমদারও। তিনি বলেন, “তারা মহড়ায় নির্দেশক হিসেবে আমাকে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা দেন। যার ফলে আমার নির্দেশনা দেওয়ার কাজটি সহজ হয়ে যায়। আমি তো ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি, উনারা যখন যার নির্দেশনায় কাজ করেছেন, মহড়া কক্ষে নির্দেশককে সর্বোচ্চ সম্মানটা দেন।”
মেয়ের নির্দেশনায় অভিনয় করাটা বিরল প্রাপ্তি বলে মনে করেন ফেরদৌসী মজুমদার। গ্লিটজকে তিনি বলেন, “কোনোদিন ভাবিনি মেয়ের সাথে অভিনয় করব, সেটাও করলাম। ভাবিনি মেয়ের নির্দেশনায় কাজ করব, সেটাও করলাম। এটা আমার জন্য বিরল প্রাপ্তি।”
লাভ লেটারস এর নেপথ্য কুশিলব
ত্রপা মজুমদার নির্দেশিত ‘লাভ লেটারস’-এর মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা করেছেন পলাশ হেন্ড্রি সেন। সৌরেন্দ্র ও সৌম্যজিৎ আবহ সংগীত হিসেবে তাদের একাধিক অনবদ্য সৃষ্টি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন।
আপন আহসান নির্মাণ করেছেন ভিডিও চিত্র। পোশাক পরিকল্পনায় গুলশান আরা মুন্নী। ডিজাইন ও অলংকরণ করেছেন প্রদীপ চক্রবর্তী। মঞ্চ ও সামগ্রী ব্যবস্থাপনায় সামিয়া মহসীনম ধ্বনি সংযোজনায় আবদুল্লাহ আল মামুন জুয়েল।