পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নাট্যচর্চার রূপরেখা নির্ধারণে শনিবার মতবিনিময় সভায় নাট্যকর্মীরা তাদের প্রস্তাব তুলে ধরেন।
Published : 08 Sep 2024, 01:08 AM
প্রবল সমালোচনার মধ্যেও ঢাকাই থিয়েটারসহ সারা দেশে নাট্যচর্চার পথে ‘মূর্তিমাণ একনায়ক’ হয়ে ওঠা লিয়াকত আলী লাকীর কায়দায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আর যেন কেউ শেকড় গজাতে না পারে, সে ব্যবস্থা করতে নাট্যকর্মীদের মধ্য থেকেই এসেছে একগুচ্ছ প্রস্তাব।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের নেতৃত্বের আসন আঁকড়ে ধরে থিয়েটার চর্চায় বিভাজন ও বাধার প্রসার ঘটানোর অভিযোগ থাকা লাকীর মত আর কোনো তথাকথিত নাট্য ব্যক্তিত্বকে এসব শীর্ষ পদে দেখতে চান না তারা।
সেই পথ খোঁজার তাগিদ নিয়ে এবং পেশাদার ন্যাটদল তৈরি করা ও নাটকের মহড়া-প্রদর্শনী সংক্রান্ত সমস্যাগুলো দূর করতে শনিবার বসেছিল এক মতনিবিময় সভা।
এ দিন সন্ধ্যায় ঢাকার মহিলা সমিতি মিলনায়তনে সভাটি ডাকে 'বিক্ষুব্ধ থিয়েটারকর্মীগণ' নামে একটি প্ল্যাটফর্ম। তাদের মধ্যে অনেকে লাকীর দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ‘সাধারণ নাট্যকর্মীবৃন্দ’ ব্যানারে আন্দোলনে নেমেছিলেন।
লিয়াকত আলী লাকী শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল। সবশেষ ২০২৩ সালের ২৯ মার্চ সপ্তমবারের মত তার মেয়াদ বাড়ানো হয়। এত দীর্ঘসময় এই দায়িত্বে থাকার নজিরবিহীন নজির স্থাপন করেন তিনি।
দীর্ঘদিন ধরে লাকীর শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে থাকা নিয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ক্ষোভ তৈরি হয়। দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল তাকে।
সরকার পতনের পর পরিবর্তনের ধাক্কায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের পদ ছেড়ে যান লাকী।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নাট্যচর্চার রূপরেখা নির্ধারণে শনিবার মতবিনিময় সভায় নাট্যকর্মীরা তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ প্রস্তাব তুলে ধরেন। কেউ কেউ ই-মেইলেও পাঠান তাদের মতামত।
সভা আহ্বানকারী প্ল্যাটফর্মের পক্ষে লিখিত প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন নাট্যদল বটতলার সংগঠক মোহাম্মদ আলী হায়দার।
আলোচনায় অংশ নেন নাটকের মানুষ আজাদ আবুল কালাম, বাকার বকুল, সুদীপ চক্রবর্তী, কাজী রোকসানা রুমা, ঋতু সাত্তার, সামিনা লুৎফা নিত্রা, নাহিদ স্মৃতিসহ বিভিন্ন নাট্যদলের অভিনয়শিল্পী, নাট্যকার ও নির্দেশক।
হায়দার প্রস্তাব করেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে যেন দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ না দেওয়ার সুযোগ বন্ধ করা হয় এবং একবারের বেশি যেন মহাপরিচালক পদে কেউ থাকতে না পারেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মোর্চার প্রধানের দায়িত্ব এবং শিল্পকলার মহাপরিচালক যেন একই ব্যক্তি না হন- এমন প্রস্তাবও রেখেছেন তিনি।
এই দুই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে নাট্যচর্চায় ‘লাকী-কায়দা’র বাধা অপসারণের পথ সুগম হবে বলে মনে করেন থিয়েটার ও মঞ্চকর্মীরা।
নাটকের প্রদর্শনী মিলনায়তনের লাইট, সাউন্ডসহ নানা প্রতিবন্ধকতা দূর করার প্রস্তাব আসে সভায়। একই সঙ্গে শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তন বরাদ্দের অনিয়ম দূর করারও দাবি উঠে আসে নাট্যকর্মীদের কাছ থেকে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে জুলাইয়ে অনেক নাট্যদল মিলনায়তন বরাদ্দ নিয়েও পরে মঞ্চায়ন বাতিল করে। ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনে ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক মাস পেরিয়ে গেলেও শিল্পকলা একাডেমিতে এখনও বন্ধ রয়েছে নাট্যপ্রদর্শনীসহ সব ধরনের সাংস্কৃতিক আয়োজন।
মতবিনিময় সভা থেকে শিল্পকলা একাডেমি অনতিবিলম্বে খুলে দেওয়ার দাবি তোলা হয়েছে।
হায়দার বলেন, "ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিল্পকলা একাডেমিতে ভাঙচুর-লুটপাট করা হয়েছে। দ্রুত সেগুলো সংস্কার করতে হবে।"
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মঞ্চের অভাবে নাট্যপ্রদর্শনী সম্ভব হয় না বলে তুলে ধরে নাট্যকর্মীরা বলেন, তাই প্রতিটি জেলা শহর এবং ঢাকায় অঞ্চলভিত্তিক নাট্যপ্রদর্শনীর জন্য মিলনায়তন এবং উন্মুক্ত মঞ্চ তৈরি করতে হবে।
সভা আয়োজনের অন্যতম সমন্বয়ক কাজী রোকসানা রুমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এই মতবিনিময় সভার জন্য আমরা সকল নাট্যকর্মীর কাছেই প্রস্তাবনা চেয়েছিলাম। অনেকেই আমাদের ই-মেইল করে তাদের ভাবনা জানিয়েছেন। সবারটা নিয়ে আমরা একটি সমন্বিত প্রস্তাবনা সরকারের দায়িত্বশীলদের কাছে তুলে ধরব।"
"সকলের ভাবনা-চিন্তাকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা আমাদের নাট্যাঙ্গনকে গড়ে তুলব। আমাদের শিল্পকলা একাডেমি যেন সত্যিকারের শিল্পচর্চার স্থান হয়ে উঠে, সেজন্য গঠনমূলক সংস্কারের জন্য এই ধরনের মতবিনিময় অব্যাহত রাখব, " বলেন রুমা।
থিয়েটারপাড়ায় অসন্তোষ
লাকী বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সভাপতির পদেও রয়েছেন। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজীদকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘটনায়ও সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন তিনি। তার প্রতিক্রিয়ায় ফেডারেশন ছেড়ে বেরিয়ে যায় ঢাকা থিয়েটার।
গত বছরের জুনেও ‘সাধারণ নাট্যকর্মীবৃন্দ' ব্যানারে লাকীকে অপসারণের দাবিতে আন্দোলন করে সংস্কৃতিকর্মীদের একটি অংশ। তখনও নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন তিনি।
গণবিক্ষোভে গত ৫ অগাস্ট সরকারপতনের পর সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে পরিবর্তনের ঢেউ লেগে যায়। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, বিচারপতি, আইনি কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্যরাও দায়িত্ব ছাড়ছেন।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পরদিনই শিল্পকলা একাডেমিতে মহাপরিচালকের দপ্তরসহ অন্তত ১৫ জন কর্মকর্তার কক্ষে তালা দেন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিক্ষুব্ধ একটি অংশ। মহাপরিচালক লাকীর ‘দুর্নীতির’ নথি যেন সরিয়ে ফেলা না যায়, বিক্ষুব্ধরা সেটি প্রতিহত করার কথাও বলেন।