ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ বলেন, “ছায়ানটের জীবিত শেষ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য উনি। উনাকে ছায়ানটে নিয়ে যাব আমরা কাল। সবাই দেখতে চায়, গান গাইতে চায়, শোনাতে চায়।”
Published : 25 Mar 2025, 09:55 PM
বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের আলোকবর্তিকা সন্জীদা খাতুনের মরদেহ বুধবার দুপুরে শেষবারের মত নেওয়া হবে তার হাতে গড়া ছায়নটে। সেখানেই তার প্রতি জানানো হবে শেষ শ্রদ্ধা।
তার পুত্রবধূ এবং ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা মঙ্গলবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, “উনার মরদেহ রাতে হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হবে। বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ মরদেহ ছায়ানটে নেওয়া হবে।”
এরপর বেলা আড়াইটায় কফিন নেওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে, সেখানে বিকাল ৪টা পর্যন্ত তাকে শেষ বিদায় জানাবে সর্বস্তরের মানুষ। সেই পর্ব শেষে কফিন আবার নিয়ে যাওয়া হবে হিমঘরে। তবে, এর পরের কার্যক্রম নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন লিসা।
৯১ বছর বয়সী সন্জীদা খাতুন বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। গত কয়েক দিন ধরে তিনি ভর্তি ছিলেন স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে। মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
তার ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ বলেন, “সন্জীদা খাতুন মুক্তি নিয়েছেন। কাল বুধবার বেলা সাড়ে ১২টায় ছায়ানটে তার শেষ দেখা মিলবে।”
সন্জীদা খাতুনের মৃত্যুর খবরে দেশের সাংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। অনেকেই হাসপাতালে ছুটে যান তাকে শেষবারের মত দেখতে।
বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে কিংবদন্তিতুল্য, গবেষকের চোখে বিস্ময় জাগানিয়া ব্যক্তিত্ব ছিলেন সন্জীদা খাতুন; তার জীবন কেটেছে বাঙালির আত্ম পরিচয়ের সুলুক সন্ধানে।
সন্জীদা খাতুন পড়েছেন কামরুন্নেসা স্কুল, ইডেন কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শান্তি নিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করে ১৯৭৮ সালে সেখান থেকেই পিএইচডি করেন। দীর্ঘদিন অধ্যাপনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে তিনি অবসর নেন।
সন্জীদা খাতুনের লেখার একটি বড় অংশ জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্যাপক পরিসরে জনমানসে কবিগুরুকে পৌঁছে দেওয়ার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় শুদ্ধ সংগীতের চর্চার পাশাপাশি বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় ছিলেন সন্জীদা খাতুন, তখন সহযোদ্ধাদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘মিনু আপা’ নামে।
গত শতকের ষাটের দশকের শুরুর দিকে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি নিবেদিত প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সন্জীদা খাতুন। তার তত্ত্বাবধানে ছায়ানট এখন বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান, যা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও নৃত্যের প্রসারে কাজ করছে।
ছায়ানটের পাশাপাশি জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। প্রচলিত ধারার বাইরে ভিন্নধর্মী শিশুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নালন্দার সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। এশিয়াটিক সোসাইটির সাম্মানিক ফেলোও ছিলেন তিনি।
একাধারে শিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সংগীতজ্ঞ ও শিক্ষক সন্জীদা খাতুন ভারত সরকারের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন।
একুশে পদক, বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কারে (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) ভূষিত সন্জীদা ১৬টি বই লিখেছেন।
জীবনের ৯২ বছর পূর্ণ করার মাত্র দশ দিন আগে তিনি বিদায় নিলেন। সন্জীদা খাতুন এমন এক সময়ে চলে গেলেন, যখন বাঙালির চিরায়ত উৎসব হয়ে ওঠা পহেলা বৈশাখের বাকি আর মাত্র তিন সপ্তাহ। রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবে আর কখনো তাকে দেখা যাবে না।
লাইসা আহমেদ লিসা হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, “উনি ২০১৭ সালের নববর্ষে বলেছিলেন আমরা যেন গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ি। এবং এই যে বিশ্বায়নের যুগে আমরা কেন ডিজিটালি সকলের কাছে যেতে পারছি না, সেটা নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন।
“সেটা কিন্তু অনেকদিন পরে হল। আমরা ডিসেম্বরের এক তারিখে সেটা শুরু করতে পেরেছি। সেটা জেনে উনি খুবই খুশি হয়েছিলেন; যে অন্তত আমরা এই ভবন কিংবা কিছু গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশে-বিদেশে যারা আছেন তাদের সাথে যোগসূত্র তৈরি করতে পেরেছিলাম। তিনি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন।”
ধরা গলায় লিসা বলেন, “এরকম অভিভাবক তো আর হবে না। আমরা আসলে অভিভাবকহীন হয়ে পড়লাম। কিন্তু, আমাদেরও তো যেতে হবে। উনি যে চেতনাটা আমাদের মধ্যে দিয়ে গেছেন, সেটা যেন ধরে রাখতে পারি সকলে মিলে। তাহলে এই ছায়ানট, এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন একটা দিক পাবে, এগিয়ে যাবে।
“প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কেউ আসেন, তার সেই চেতনাটা কারও মধ্যে সঞ্চারিত করে যান। এভাবেই আবহমান কাল ধরে চলতে থাকে।”
সন্জীদা খাতুনকে শেষবারের মতো দেখতে ছুটে এসেছিলেন ছায়ানটের সহসভাপতি ও গবেষক মফিদুল হক, নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী, সাংস্কৃতিক কর্মী সোহরাব হোসেনসহ অনেকে।
নৃত্যশিল্পী শর্মিলা বন্দোপাধ্যায় বলেন, “আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না। এটা শূন্যতা, বিশাল শূন্যতা। উনি যে কি ছিলেন আমাদের কাছে; উনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন, আমাদের দিয়ে গেছেন; যে তোমরা কাজটা এগিয়ে নিয়ে যাবে। সবার কাছে আমরা কামনা করি, আমরা যেন সেই কাজটা আপার মত করে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।”
ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ বলেন, “ছায়ানটের জীবিত শেষ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য উনি। উনাকে ছায়ানটে নিয়ে যাব আমরা কাল। সবাই দেখতে চায়, গান গাইতে চায়, শোনাতে চায়।”
আরো পড়ুন