“তার একটা বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি অসংখ্য অনুসারী সৃষ্টি করে যেতে পেরেছেন। যারা তার আদর্শকে, তার চেতনাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে লালন করবে।”
Published : 25 Mar 2025, 08:05 PM
নব্বই বছরের জীবনে তিনি হয়ে ছিলেন ‘মহীরূহ’। তার ছায়া থেকে সুস্থ, শুদ্ধ শিল্পচর্চায় বেড়ে উঠেছে কয়েক প্রজন্ম। সন্জীদা খাতুন নামের এই মহীয়সী নারীর প্রয়াণে শোকাতুর হয়ে পড়েছেন তারই কাছের মানুষগুলো।
মঙ্গলবার বিকালে তার প্রয়াণের খবরে তাদের অনেকেই ছুটে আসেন পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালে, শেষবারের মতো তাকে দেখতে।
মঙ্গলবার বিকেল ৩টার রাজধানীর পান্থপথে স্কয়ার হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বাঙালি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সভাপতি সন্জীদা খাতুন। তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।
তার মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে আসেন নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী, ছায়ানটের সহসভাপতি ও গবেষক মফিদুল হকসহ অনেকে।
সন্জীদা খাতুনের দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা ও অনুজপ্রতীমদের একজন গবেষক ও প্রকাশক মফিদুল হক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একজন মানুষ এতো বিপুলভাবে সমাজকে দিয়ে গেছেন, এটার আমি কোনো তুলনা খুঁজে পাই না। অনেক রকম পরিচয়তো। এখন কোন পরিচয়টা বড়, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী এটা খুব বড় পরিচয় এবং রবীন্দ্রনাথের গানের পরিবেশন এবং ব্যাখ্যা, তার তুলনীয় আসলে এই গোটা বাংলায় সমকক্ষ কেউ নেই। আবার তিনি সঙ্গীতের শিক্ষাদান করে গেছেন আজীবন।
“মানুষকে গান শেখানোর আনন্দের সঙ্গে আর্থিক কোনোরকম সংযোগ কোনো সময়ই ছিল না। সেটা যে কেবল ছায়ানটকে ঘিরে, তা নয়। রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের হয়ে সারাদেশের কত জায়গায় উনি গেছেন, ছেলেমেয়েদেরকে গান শিখিয়েছেন। তার বাড়িতে যখন যে আসত গান শিখতে, সবার জন্য দরজা খোলা ছিল।”
তিনি বলেন, “সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ আন্দোলন, পাকিস্তান আমলে যেটা খুব দৃঢ়তার সঙ্গে করলেন। আর তারপরে সাংস্কৃতিক নির্মাণের যে প্রয়াস, স্বাধীন বাংলাদেশে। প্রতিরোধ আর নির্মাণ দুটোই করলেন পাশাপাশি। তার সঙ্গে অধ্যাপনা কলেজে, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় অধ্যাপক এবং গবেষণা।
“তার পিএইচডি থিসিস..অনেক আগেই কিন্তু, তারপরে তিনি যিনি পোস্ট ডক্টরাল করলেন রবি থেকে কবিতা এবং কবিতার ধ্বনির তাৎপর্য, এগুলোর ব্যাখ্যা সেটাও একটা নতুন দিগন্ত খুলে দেওয়া, সাহিত্য সমালোচনায় বা কবিতা বোঝার ক্ষেত্রে। সঙ্গে সামাজিক কতরকম কাজ। আর তার সঙ্গে হচ্ছে বাংলাদেশ যদি বলি, বাংলাদেশের চেতনা। এই চেতনাকে যারা পুষ্টি যুগিয়েছেন এবং এই চেতনা নিয়ে যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর এই মুক্তিযুদ্ধের সময়ও যে তিনি দেশান্তরী হয়ে তারপর সেইখানে যেয়ে আবার এই সঙ্গীতকে অবলম্বন করেই একটা নতুন অধ্যায় প্রতিরোধের।”
সন্জীদা খাতুন সম্পর্কে মফিদুল হকের মূল্যায়ন, “এ তো বলা যায়, রক্তে-মজ্জায় অসাম্প্রদায়িক মানুষ। যে অসাম্প্রদায়িকতা আসলে বাঙালি সত্তার একেবারে প্রাণ, সেটা তিনি এমনভাবে ধারণ করেছেন। তার সঙ্গে তার জীবনাচার, তার যে একেবারে একটা নির্লোভ মধ্যবিত্তসুলভ একটা জীবন, যেখানে বাহুল্যবর্জিত একটা জীবনধারা, জীবনযাত্রা, আমরাতো এটার সাক্ষী। আজকের সমাজেতো সেটা অকল্পনীয়।
“তার সঙ্গে আরও কত কাজ এটা বলে শেষ করার না। কত ছেলেমেয়েকে তিনি এই শিল্পের পথ দেখিয়েছেন, শিল্পের মধ্য দিয়ে জীবনের দিশা যুগিয়েছেন এবং তার সঙ্গে তার যে লেখালেখি এবং সেটাও তিনি বলা যায় যে, গত এক দশক ও তার বেশি ধরে তিনি অনেকটাই নজরুল চর্চায় উপবিষ্ট হয়েছেন, নজরুলের ওপর তার বই বা লোকসঙ্গীতের চর্চা, জসীমউদ্দিন নিয়ে তার গান।”
এই গবেষক বলেন, “ফলে তাকে কিন্তু নানাভাবে খণ্ড খণ্ডভাবে আমি দেখি। আর পরিপূর্ণ সন্জীদা খাতুন অভাবনীয় একটা বিষয়। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত দিয়ে গেলেন, অসুস্থ যখন বাড়ি থেকে বের হতে পারেন না, তখনও ঘরে সপ্তাহে একদিন বা নিয়ম করে আরও যারা গানের সম্পর্কে জানতে চায়, বুঝতে চায়, তাদের সঙ্গে কথা বলা, গান শেখানো। আর ছায়ানটতো ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান হয়ে গেল এই ব্যতিক্রমী মানুষগুলোর জন্য। আসলে এ সমাজের পক্ষে তাকে বোঝাটা খুব জরুরি।”
জেলার সংস্কৃতি চর্চায়ও অনন্য ভূমিকা সন্জীদা খাতুনের: জয়দুল হোসেন
সন্জীদা খাতুনের সঙ্গে নব্বই দশকে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সূত্রেই পরিচয় হয় কবি জয়দুল হোসেনের। তিনি সাহিত্য একাডেমি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সভাপতি। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও।
সন্জীদা খাতুনের সঙ্গে পরিচয়ের স্মৃতি মনে করে জয়দুল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১৯৯৫ বা ৯৬ সালের দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শিল্পী শাহীনুর রহমানের একটা চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল সাহিত্য একাডেমি। সেই প্রদর্শনীতে অতিথি হয়েছিলেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন।
“অনুষ্ঠানে এসে তিনি সাহিত্য একাডেমির সাংগঠনিক তৎপরতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি সে কথা সন্জীদা খাতুনকে বলেছিলেন। পরে সন্জীদা খাতুনের আহ্বানে রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদে যুক্ত হয়েছিলাম। এরপর সাংগঠনিক কাজে তার সঙ্গে যোগাযোগ হতো।”
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাহিত্য একাডেমি চার দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রতি বছর বৈশাখী উৎসবের আয়োজন করছে। সন্জীদা খাতুন সাহিত্য একাডেমি এবং রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, জেলা শাখার আমন্ত্রণে একাধিকবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসেছেন বলেও জানান জয়দুল হোসেন।
সনজীদা খাতুনকে বটবৃক্ষ উল্লেখ করে জয়দুল হোসেন বলেন, “তিনি সংস্কৃতিচর্চার নানা মাধ্যমে কাজ করেছেন। তিনি যেমন ছিলেন শিক্ষক, আবার নিমগ্ন গবেষক। জেলায় জেলায় গিয়ে তিনি রবীন্দ্রচর্চার প্রসারে কাজ করেছেন। জেলা শহরের সঙ্গে ছিল তার আন্তরিক সম্পর্ক। আমার মতো অনেকে জেলায় থেকে সংস্কৃতি চর্চার কাজ করার পেছনে সন্জীদা খাতুনের মতো মানুষেরা অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। এরকম গুণিজনকে হারানো ভীষণ বেদনার।”
মিনু আপার বিদায় অপার শূন্যতার: ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়
দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে সন্জীদা খাতুন নামে পরিচিত হলেও ছায়ানট কিংবা রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ সংশ্লিষ্টদের কাছে তিনি ছিলেন মিনু আপা বা মিনু খালা।
তার মৃত্যুতে সংস্কৃতি অঙ্গনে অপার শূন্যতা সৃষ্টি করেছে বলে মনে করছেন জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের নির্বাহী সদস্য ও ছায়ানটের সদস্য আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম, আমদের সন্জীদা খাতুন। আমরা সবাই মিনু আপা বলি, কেউ মিনু খালা বলেন, তিনি চলে গেলেন আজকে।
“অত্যন্ত কষ্টের, বেদনার, যারা সংস্কৃতি অঙ্গনের সাথে যুক্ত, সবাই তাকে জানতাম আমরা যে, তিনি একজন সঙ্গীত বিশারদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, সংগঠক, ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা, গবেষক- কী না তিনি। ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পদক পেয়েছেন, শান্তি নিকেতনের দেশিকোত্তম উপাধি পেয়েছেন, স্বাধীনতা পুরস্কার পেছেন। পুরস্কার পাওয়াটা বড় কথা না, বড় কথা হচ্ছে সারাজীবন তিনি বাংলা ভাষা এবং বাংলা সংস্কৃতির জন্য লড়াই করেছেন।”
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবর্ষের পর থেকেই ছায়ানট প্রতিষ্ঠার কথা স্মরণ করে একুশে পদকজয়ী আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “রমনার বটমূলে যে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, তার পথিকৃৎ আমাদের সন্জীদা খাতুন।”
সন্জীদা খাতুনের শেষ সময়ের কথা স্মরণ করে ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “যদিও তার বয়স হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা তাকে দেখেছি। তার মস্তিষ্ক অত্যন্ত পরিষ্কার ছিল। সমস্ত কথা বলছেন সবার সাথে, শুধু শরীরটা যা হয় বয়সকালে, একটু খারাপ হয়েছিল, ডায়ালাইসিস করতে হতো।
“আমাদের রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের তিনি সভাপতি ছিলেন, তিনি ছায়ানটের সভাপতি ছিলেন। সংগঠক হিসেবে তার যে সারাদেশব্যাপী কর্মবিস্তৃতি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে, ছায়ানটের সঙ্গে অধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন। আমরা আজ তাকে হারিয়ে ভীষণ শূন্যতা অনুভব করছি।”
আদর্শ ও বিশ্বাসে অবিচল সন্জীদা খাতুন: রামেন্দু মজুমদার
সন্জীদা খাতুন কোনোদিন আদর্শ ও বিশ্বাসের সঙ্গে কোনোরকম আপস করেননি বলে জানিয়েছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার।
তিনি বলেন, “মনে হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতির একটা বাতিঘর নিভে গেল। তিনি সারাজীবন ধরে একটা প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে, যেভাবে বাঙালি সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন, আজকের এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন, এটা তার সারাজীবনের কীর্তি।
“একদিকে আমাদের ছায়ানট তার কীর্তি বহন করবে, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের মধ্য দিয়ে সারাদেশে সংস্কৃতির বীজ বপন করেছেন। শুধুমাত্র রবীন্দ্রসংগীত নয়, নজরুল, লালন- সকল প্রকার শুদ্ধ সঙ্গীতের প্রসারে তিনি অবদান রেখেছেন।”
সন্জীদা খাতুন সারাজীবন আদর্শের প্রতি অনুগত থেকেছেন উল্লেখ করে রামেন্দু মজুমদার বলেন, “আদর্শ ও বিশ্বাসের সঙ্গে কোনোরকম আপস তিনি করেননি, কোনোদিন না। সবসময় সেই ব্যাপারে দৃঢ় ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই একইরকম অসামান্য ভূমিকা এবং পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শুধু স্লোগানের মধ্য দিয়েই নয়, সত্যিকারে কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন।”
এই পহেলা বৈশাখের আগে তার কথা মনে পড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “যেভাবে ছায়ানটের সকালবেলার অনুষ্ঠান রমনার বটমূ্লে গণমানুষের আয়োজনে পরিণত হয়েছে, তাতে তার ভূমিকা মনে রাখতে হবে। সেটা এমন একটা কাজ যা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে সারাজীবন।
“আমি মনে করি, তার মত মানুষ খুব কম আমাদের দেশে জন্মেছে, বিশেষ করে সংস্কৃতি অঙ্গনে। তার অভাব দীর্ঘদিন ধরে অনুভূত হবে। তার একটা বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি অসংখ্য অনুসারী সৃষ্টি করে যেতে পেরেছেন। যারা তার আদর্শকে, তার চেতনাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে লালন করবে।”