অর্থনীতির হালচাল বিশ্লেষণ ও নতুন সরকারের কাজের অগ্রাধিকারের তালিকায় অর্থনীতিবিদরাও মূল্যস্ফীতিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলছেন।
Published : 17 Jan 2024, 07:21 AM
উচ্চ মূল্যস্ফীতির পারদ নামিয়ে আনতে আগের অব্যাহত চেষ্টার মধ্যেই আরেকটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হারের চাপ কমানোর বিষয়টিও আগের মতোই থাকছে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতির সামনে।
বুধবার বিকাল ৩টায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছেন তাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সেই পুরনো কৌশল- আগের কয়েকবারের ধারাবাহিকতায় নীতি সুদহার বাড়ানোর বিষয়টি এবারও আগাম আলোচনায় এসেছে।
নীতি সুদহারের উচ্চ ও নিম্ন সীমার ব্যবধানের মধ্যে সমন্বয় এনে নতুন হার নির্ধারণের সিদ্ধান্ত আসতে পারার ইঙ্গিত মিলেছে কর্মকর্তাদের কথায়।
সেই সঙ্গে বিনিময় হার বাজারমুখী করার চলমান পদক্ষেপগুলোকে আরও কার্যকর করার ঘোষণা আসতে পারে নতুন মুদ্রানীতিতে। অর্থবছরের প্রথমার্ধের সংকোচনমূলক নীতির ধারাও বজায় থাকার সম্ভাবনার কথা বলছেন এটি প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
২০২২ সালের জুলাইয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর তৃতীয় মুদ্রানীতি নিয়ে আসছেন আমলা থেকে গভর্নরের দায়িত্বে আসা আব্দুর রউফ; যেটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে এবার সচরাচর পদ্ধতির বাইরে গিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর পরার্মশে ভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে।
প্রতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক অংশীজনদের মতামত নেওয়ার পর সরকারের নীতির সঙ্গে মিল রেখে নিজেরাই মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। এবার আইএমএফের পরামর্শে মুদ্রানীতি আধুনিকায়নের পথে হেঁটেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একটি পৃথক মুদ্রানীতি প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে, যেটিতে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের বাইরের অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা।
কর্মকর্তারা বলছেন, ছয় মাস আগের মুদ্রানীতির সময় অর্থনীতির যেসব চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে নীতি নির্ধারণী পদক্ষেপের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল সামষ্টিক অর্থনীতিতে এখনও তেমন অবস্থাই রয়ে গেছে। শেষ হতে যাওয়া মুদ্রানীতি অনুসরণের পরও অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন আসেনি।
নির্বাচনের আগের অর্থনীতির সেই অবস্থার সঙ্গে এবার পরিস্থিতির অনেকটা বদল হয়েছে। ভোটের পর নতুন মেয়াদে বর্তমান সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। সামনের দিনগুলোর করণীয় জানাতে গিয়ে সরকারপ্রধানও মূল্যস্ফীতি কমিয়ে এনে জনজীবনে স্বস্তি আনার প্রতিশ্রুতিই দিয়েছেন।
বছরজুড়ে মূল্যস্ফীতি ১০ এর কাছাকাছি
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামনেও সেই একই চ্যালেঞ্জ। সবশেষ দুই মুদ্রানীতিতে এ লক্ষে নীতি সুদহার বাড়িয়ে এবং ‘স্মার্ট’ পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে সুদহার বাড়ানোর পথে হেঁটেও উচ্চ মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়াকে বশে আনা যায়নি। অর্থবছরের প্রথমার্ধ শেষে মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিম্নমুখী হলেও তা দুই অঙ্কের কাছাকাছিই ছিল।
এমন প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি কাক্ষিত পর্যায়ে নামিয়ে আনা, উচ্চ হারের খেলাপিতে লাগাম টানা এবং ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার তিন চ্যালেঞ্জ অগ্রাধিকার পাচ্ছে নতুন মুদ্রানীতিতে।
আইএমএফের একগুচ্ছ পরামর্শ মেনে করা সবশেষ মুদ্রানীতিতে ‘মনিটরি টার্গেটিং’ এর বদলে ‘ইন্টারেস্ট রেট টার্গেটিং’ নির্ধারণের মতো পরিবর্তন দেখা গেছে। একই সঙ্গে মুদ্রানীতিতে বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া, সুদহার সীমা তুলে দেওয়া এবং বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ হিসাব করতে আইএমএফ স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতি চালুর বিষয়গুলো যোগ হয়েছিল।
আগের মুদ্রনীতিতে নীতি সুদহার বাড়ানোর পরও তা খুব বেশি কাজে না আসায় সবশেষ গত নভেম্বরে নীতি সুদহার আরেক দফা বাড়ানো হয়। সে সময় মূল্যস্ফীতি ডিসেম্বরে ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের।
অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেবে গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। আগের মাসে যা ছিল ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আর গত ছয় মাসে তা কখনই ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। অথচ সরকার চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে।
অর্থনীতির হালচাল বিশ্লেষণ ও নতুন সরকারের কাজের অগ্রাধিকারের তালিকায় অর্থনীতিবিদরাও মূল্যস্ফীতিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলছেন।
নীতি সুদহার বাড়ানোর পরও মূল্যস্ফীতি কাঙিক্ষত হারে নেমে না আসার বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট জাহিদ হোসেনের পর্যবেক্ষণ, “নিয়ন্ত্রিক ঋণ সুদহার বৃদ্ধির ফল পেতে আরও কয়েক মাস সময় লাগবে।“
তার মতে গত অক্টোবরে যে ঋণ বিতরণ হয়েছে বাজারে সেটির প্রভাব দুই মাসের ব্যবধানে ততটা পড়বে না।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ না হওয়ার আরেক কারণের বিষয়ে বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারমুখী না হওয়ার কথাও বলছেন এই অর্থনীতিবিদ। তার ভাষ্য, ‘‘মুদ্রানীতির পাশাপাশি রাজস্বনীতির সমন্বয় করলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের আশা করা যেতে পারে। যেটি অন্যান্য দেশ করেছে।’’
এজন্য রাষ্ট্রায়ত্ত দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয় করার প্রয়োজনের কথা বলেছেন আরেক অর্থনীতিবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।
তার মতে, ‘‘বতর্মান সংকট যে অবস্থায় গিয়েছে তা শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে উত্তরণের অবস্থায় নেই।“
তবে মুদ্রানীতির মাধ্যমে যতটুকু প্রভাব রাখা যায় অন্তত সেটুকু যাতে হয় সে প্রত্যাশা তার।
গত ছয় মাসে অর্থনীতিতে নতুন কোনো চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়নি মন্তব্য করে তিনি বলেন, মুদ্রানীতিতে খুব একটা বড় পরিবর্তন আসবে বলে মনে হচ্ছে না।
সুশাসন নিশ্চিত ও খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে না আনা গেলে আর্থিক খাতের সমস্যাগুলো আরও গভীর হবে বলে আশঙ্কা তার।
দেখার বিষয় মুদ্রানীতিতে এ দুটি বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যোগ করেন তিনি।