বড় ঘাটতির বাজেটে ১৭% আসবে ব্যাংক ঋণ থেকে

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, বাজেট বাস্তবায়নে কোনো মতেই ব্যাংক ঋণ নেওয়া উচিত নয়। নিতে হলেও তা সামান্য পরিমাণে হওয়া উচিত।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 June 2023, 12:24 PM
Updated : 1 June 2023, 12:24 PM

নানামুখী চাপের মধ্যে দাঁড়িয়েও ‘স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে’ যাত্রার প্রত্যাশা রেখে ভোটের আগে রেকর্ড ঘাটতির যে বাজেট অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রস্তাব করেছেন, তার ১৭ শতাংশের বেশি তাকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যোগাড় করতে হবে।

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার এই বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী কামাল।

এর মধ্যে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা তিনি রাজস্ব খাত থেকে যোগান দেওয়ার পরিকল্পনা সাজিয়েছেন, যা বাস্তবায়ন করা হবে বড় চ্যালেঞ্জ।

তারপরও তার আয় ও ব্যয়ের হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকার বেশি, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় ঘাটতির এই পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৫.২ শতাংশ।

মহামারীর আগে প্রায় এক যুগ সরকার ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে রেখে বাজেট প্রণয়নের চেষ্টা করত। কিন্তু মহামারী শুরুর পর বাড়তি টাকা যোগানোর চাপে তা ৬ শতাংশও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত অর্থবছরে জিডিপির ৫.৫ শতাংশ ঘাটতি রেখে মূল বাজেট সাজানো হলেও সংশোধনে তা ৫.১ শতাংশে নেমে আসে। এবারের ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির অনুপাতে তার কাছাকাছিই থাকছে।

আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে সেই ঘাটতি পূরণ করতে হয় ঋণ করে। সরকার বিদেশি সাহায্য ও বিদেশি ঋণ নিয়ে, দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে ধরা করে, জনগণের কাছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করতে পারে।

এবারের বাজেটের ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হলে অর্থমন্ত্রীকে ওই অর্থের ৩৪ শতাংশই জোগাড় করতে হবে ঋণ করে।

সেজন্য বিদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯০ এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার মত ঋণ করার পরিকল্পনা জানিয়েছেন কামাল।

বিগত বছরগুলোতে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প করার তাগিদে বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। তবে বিদেশি ঋণের সুদ দিতে সরকারের রিজার্ভ থেকে ডলার খরচ করতে হয়। আর ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাজারে ডলারের দর চড়ে যাওয়ায় এমনিতেই রিজার্ভ কিছুটা চাপে আছে।

ডলারের সঞ্চয় ধরে রাখতে সরকার বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি কম জরুরি প্রকল্পে অর্থায়ন বিলম্বিত করার নীতি নেয় গতবছর। এবারের বাজেটে বিদেশের বদলে দেশের উৎস থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনাও ডলার বাঁচানোর কৌশলের দিকেই ইংগিত করছে। 

অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে রেকর্ড ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে বাজেটে, যা মোট ব্যয়ের ১৭.৩৭ শতাংশ। ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার এই লক্ষ্য বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি।   

এছাড়া সঞ্চয়পত্র থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আরও ৫ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন কামাল। বাজেটে সম্ভাব্য বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার পরিমাণ ধরা হয়েছে সোয়া ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেলে অর্থনীতিতে বাইরে থেকে আসা তারল্য যোগ হয়। তাতে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বাড়ে। তাছাড়া সেই ঋণের জন্য সরকারকে সুদও গুনতে হয়।

এবার দেশি-বিদেশি ঋণের জন্য ৯৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা খরচ হবে বলে অর্থমন্ত্রী হিসাব ধরেছেন, যা মোট অনুন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় ২০ শতাংশ।

আবার মন্দার দিনে ঋণের ওই বাড়তি টাকার যোগান সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গতি আনতে পারে, তাতে স্থবির অর্থনীতিতে গতি আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়, মুস্তফা কামাল সেই আশাই করছেন। তার এবারের বাজেটের শিরোনাম ‘উন্নয়নের অভিযাত্রার দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা’।

তবে বড় যে ঘাটতি রেখে বাজেট পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে, তাতে ডলারের ওপর চাপ আরও বাড়বে এবং তা মূল্যস্ফীতিও আরও বাড়িয়ে দিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।

তিনি বলেন, “বিদেশি অর্থায়ন না হওয়ায় ডলার আসছে না। তাই ব্যয় সাশ্রয় এবং ঘাটতি কমিয়ে আনতে উদ্যোগ নিতে হবে।

“যেসব প্রকল্প দেশীয় অর্থায়নে চলবে, কিন্তু প্রকল্পের নির্মাণ বা উপাদান সামগ্রী হিসেবে মেশিনারি, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি আমদানি করতে হবে, সেসব প্রকল্পও এড়িয়ে চলতে হবে।”

আর দেশীয় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে যে ঋণ নেওয়া হবে, তা বাংলাদেশ ব্যাংক দেবে, না বাণিজ্যিক ব্যাংক দেবে, সেই প্রশ্নের সুরাহা প্রয়োজন বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন।

তার পরামর্শ, যদি অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ সংগ্রহ হয়, তা যেন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে না করা হয়। কেননা বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ৭০ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট ছাপিয়েছে এ ঋণ দিতে গিয়ে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক যখন টাকা ছাপায়, তা মূল্যস্ফীতি আরও উসকে দেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, বাজেট বাস্তবায়নে কোনো মতেই ব্যাংক ঋণ নেওয়া উচিত নয়। নিতে হলেও তা সামান্য পরিমাণে হওয়া উচিত।

তার মতে, সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কোনো ঝুঁকি ছাড়াই ৭ শতাংশ সুদে সরকারকে ঋণ দিচ্ছে। তাতে বেসরকারি খাত নিরুৎসাহিত হচ্ছে।

ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ঋণ করার বদলে সরকারকে সঞ্চয়পত্র থেকে ধার নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন এই অর্থনীতিবিদ।

তার যুক্তি, সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিলে সরকারকে যে সুদ দিতে হয়, তা দেশের অর্থনীতিতেই খরচ হয়, সাধারণ মানুষের জীবন-যাপনে সহায়তা করে।

“এ খাতের সুদ ব্যয় তো হচ্ছে মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষের পেছনে। সরকার এ খাত থেকে ঋণ নিতে পারে।”

গেল অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে ১ লাখ ১৫ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা হয়।

আর ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটে বিদেশি ঋণের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা ১ লাখ ১ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। সংশোধনে তা ৬ লাখ ৬০ হাজার ৫০৭ কোটিতে নামিয়ে আনতে হয়েছে।