রবি ফসলে সার-ডিজেলের হিসাব মিলবে কৃষকের?

আমনের লাভের হিসাব মেলেনি সবার; কৃষকের শীতের আবাদেও মিশে থাকছে দুঃশ্চিন্তা।

শাহরিয়ার নোবেলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Nov 2022, 08:08 PM
Updated : 18 Nov 2022, 08:08 PM

হেমন্তের সোনালি ধান কাটা শুরু হয়েছে; ধীরলয়ে বইতে শুরু করেছে উত্তুরে হাওয়া, ঘাসের ডগায় দেখা মিলছে শিশিরের। তবে কৃষকের বিরাম নেই, তাকে এখন বুনতে হবে রবিশস্য।

আমনের মওসুমে ধানের উৎপাদন খরচের তুলনায় লাভের হিসাব মেলেনি নাটোরের কৃষক সাজেদুর রহমানের। সেই ‘হতাশা’ কাটাতে এখন তিনি শীতের আবাদে মন দিতে চান।

ভাবছেন, নিজের ৩০ বিঘা জমির মধ্যে আট বিঘায় গম, ১০ বিঘায় মসুর, ছয় বিঘায় ভুট্টা আর অন্য জমিতে পেঁয়াজ-রসুনের আবাদ করবেন। কিন্তু সেচ, সার, পরিবহন আর শ্রমিকের খরচ নিয়ে তার ভাবনায় মিশে থাকছে দুঃশ্চিন্তাও।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সাজেদুর বলেন, “এভাবে পোষায় না তো। গমের চাষ করতি গেলে পরে সেচ দেওয়া লাগে। ডিজেলের দাম বাড়তি হলেও কৃষকের তো আর কিছু করার নাই। বাড়তি হলেও সেচ দিতি হবে।

“হিসাব করলি পরে তো চলবি না। দুশ্চিন্তা আমাদের লাগিই আছে, এর কোনো শেষ নাই। আমাগের জমি-জিরাত আছে এইটাই কইরা যাইতে হবে। আর তো কোনো রাস্তা নাই।”

সাজেদুর রহমানের বাড়ি নাটোরের বড়াইগ্রামের মহসিন্দা গ্রামে। বংশ পরম্পরায় কৃষিকাজ করে আসছে তার পরিবার। ডিজেল আর সারের দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় আক্ষেপ ঝরে তার কণ্ঠে।

তার ভাষায়, চাষ এখন ব্যয়বহুল হয়ে যাচ্ছে, আগের চেয়ে ‘দ্বিগুণ’ খরচ লাগছে গত কয়েক বছর ধরে। কোনোরকমে খাওয়া-পরা চলে, এর বেশি কিছু হয় না।

কৃষকরা বলছেন, শুকনো মৌসুমে জমিতে সেচের দরকার হয়। কিছু জায়গায় বিদ্যুৎচালিত মেশিন থাকলেও সেচের জন্য ডিজেলের ওপরই নির্ভর করতে হয় বেশি। আর বীজ বোনার পর ছুটতে হয় সারের দোকানে।

গত ৬ অগাস্ট সরকারের এক সিদ্ধান্তে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৮০ টাকা থেকে ৩৪ টাকা (৪২.৫ শতাংশ) বেড়ে হয় ১১৪ টাকা। ২৩ দিন পর ২৯ অগাস্ট সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা কমানো হয়। ফলে প্রতি লিটার ডিজেল-কেরোসিনের দাম এখন ১০৯ টাকা।

আবার অগাস্টের প্রথম দিনেই বিশ্ব বাজারে দাম বাড়ার প্রেক্ষাপটে ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ছয় টাকা বাড়ায় সরকার। কৃষি মন্ত্রণালয় তখন জানিয়েছিল, প্রতি কেজি ইউরিয়া সার কিনতে কৃষকদের দিতে হবে ২২ টাকা, আগে যা ছিল ১৬ টাকা। আর ডিলাররা ওই সার পাবেন প্রতি কেজি ২০ টাকা দরে, যা আগে তারা ১৪ টাকায় কিনতেন।

ডিজেল ও সারের এই চড়া দামের কারণে এবারের রবি মৌসুমে সেচ, সার, শ্রমিক, পরিবহন খরচ এবং সর্বোপরি উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কথা বলছেন কৃষকরা।

উদ্বেগের কথা বললেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হানও। তার ভাষায়, “সার ডিজেলের দাম বৃদ্ধি আসন্ন খাদ্য সংকটের সময়ে আমাদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।”

কৃষি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম অবশ্য অভয় দিলেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সরকার কৃষকদের জন্য যথেষ্ট ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কোনো অসুবিধা হবে না।”

সরকারের কৃষি অধিদপ্তরের ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, রবিশস্যের মওসুমে গম, ভুট্টা, মিষ্টি আলু, চীনা বাদাম, তিসি, তিল, সূর্যমুখি, ছোলা, মুগ, খেসারি, মটর, রসুন, মরিচ ও কালিজিরা উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তা অর্জিত হয়নি।

২০২১-২২ অর্থবছরে রবি ফসলের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ও অর্জন

হাল-সেচে ‘দ্বিগুণ ব্যয়’

নাটোরের কৃষক সাজেদুর রহমান বলেন, “উঁচা জমিগুলোতে সেচ দেওয়া লাগতিছে। ডিজেলের দাম বাড়ায় দুর্ভোগ বাড়ছে। আগে এক বিঘা সেচ ছিল ৬০০ টাকা। এখন হাজার টাকা বিঘা লিচ্ছে জমিতে শ্যালো দিয়ে সেচ দেওয়ার জন্য। লেবারের দামও বাড়তিছে। এখন ৪০০ আছে, দুইদিন পরে ৬০০ হবি ডেইলি।”

রবি মওসুমে এবার সরিষা আর ভুট্টার আবাদ করছেন উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র পাড়ের নদীভাঙনপ্রবণ পোড়ার চরের কৃষক জহিরুল ইসলাম। সেচ তাকে তেমন না ভোগালেও দুর্দশা বেড়েছে অন্য জায়গায়। চরে বাড়ি হওয়ায় সবকিছুই তাকে ট্রলারে পরিবহন করতে হয়। কিন্তু ডিজেলের দাম বাড়ায় তার হালচাষ আর পরিবহন খরচ গেছে বেড়ে।

“আগে আমরা ৩০০ টাকা বিঘা পাওয়ার টিলার বাওয়াইছি, এবার ৫০০ টাকা দিয়া লাগতিছে। আগের বছর যে দামে গেছে, সেই দাম এই বছরও থাকলে তো লসেই থাকুম। আমরা হতাশার মধ্যে আছি। দুই-চাইরটা গরু পুষি, তাই হয়ত গায়ে লাগে না। সরকার কিছু করলে আমরা একটু সাহস পাইতাম।”

দেশের মধ্যভাগের জেলা কুমিল্লার গোমতী নদীর চরে চাষাবাদ করেন ওহিদুল ইসলাম। এ বছর দ্বিগুণ খরচ হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ধানের জমিডাত এই বৎসর ধান করছি না। হেই জাগাত সরিষা বাইন্যাইমু, আলু, মইচ (মরিচ) বাইন্যাইমু। জমি লাগাইলে তো সার-টার লাগবোই।

“চরের ভেতরে ১০ শতক জাগাত মইচ লাগাইতে এই বৎসর লাগতাছে সাত-আট হাজার টাকা। অন্যান্য বৎসর মইচ লাগাইতে লাগতো চাইর হাজার টাকা। ডাবল খরচ যাইতাছে।”

তাতে লাভ থাকবে? এ প্রশ্নে ওহিদুল বলেন, “কৃষি কইরা মনে করেন দাম পাইলে পুষে, দাম তো পাই না, এইজন্য পুষে না। কৃষকরা আশা কইরা করে, আল্লায় জানে আশা পুরাইবো কিনা। সরকার থাইক্কা তো কিছু পাই না। চাইছিলাম, কইছিলো দিবো, কোনসময় যে দিবো জানি না, এই পর্যন্ত কিছু পাইছি না।”

সারে ‘সিন্ডিকেট’

সারের দাম বৃদ্ধির পরও সরকারনির্ধারিত দামে ডিলারদের কাছ থেকে সার না পাওয়ার কথা বলছেন কৃষকরা।

নাটোরের বড়াইগ্রামের মহসিন্দা গ্রামের কৃষক সেলিম হোসেনের ভাষ্য, “আমাদের এইসব রবি ফসল লাগাইতে ভালো পরিমাণেই ইউরিয়া সার লাগে। গমে ইকটু বেশি লাগে। সারের দুর্ভোগ অনেক।

“সার এখন সিন্ডিকেটে চলে। মানে ডিলারেরা সার রাইখা বলে সার নাই। বেশি দাম দিয়া পরে সার নিতি হইচ্ছে। ইউরিয়া সারের ক্রাইসিস, এইসব বইলে তারা দাম বেশি চায়।”

শেরপুরের কৃষক আকরাম আলী বলেন, “সারের জন্য সমস্যা তো আছেই। সবকিছুর দাম বাড়তি। সার, তেলের দাম বেশি। সার কিনতে গেলে দাম-দরের কোনো উপায় নাই, তারা যা বলবে তাই চলে।” 

সার নিয়ে আক্ষেপ জানিয়ে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক আমির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কৃষকের অবস্থা গুরুতর, না পারছে বলতে, না পারছে সইতে। সারের বাজার, বীজের বাজারের অবস্থা খুবই খারাপ। ডিলাররা যা বলে তাই দিতে হচ্ছে। কৃষকরা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।

“২০ টাকার সার ২৫ টাকা, ২২ টাকার সার ২৮ টাকা কিনতে হচ্ছে। বাজারে গেলে সবকিছুর দাম বেশি, শুধু আমরা যেইটা ফলাই সেইটার দাম নাই।”

অন্যদিকে ডিলাররা অভিযোগ মানতে নারাজ। সাঘাটা উপজেলার সারের ডিলার সুশান্ত পাল বললেন, “সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম ১০০ টাকাতেই সার বিক্রি করছি।”

তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম বললেন, “পরিবহনে সার নষ্ট হওয়াসহ ব্যবসায় টিকে থাকার কথা শুনিয়ে খুচরাপর্যায়ের সার ব্যবসায়ীরা কেজিপ্রতি কিছু টাকা বেশি নেয়। ডিলার পর্যায়ে এমন কারচুপি এখনও পাইনি।”

পুষিয়ে নেওয়ার জায়গা কোথায়?

সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান মনে করেন, ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হলে কৃষিসংশ্লিষ্ট যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে, সেসব পণ্যের ওপর ভর্তুকি বাড়াতে হবে সরকারকে।

“সার কৃষক ভর্তুকিতে পাচ্ছে, তবে দাম বেড়েছে। কিন্তু ডিজেলের দাম বাড়ায় কৃষক চাপে পড়ছে। আমার পরামর্শ হল, কৃষকের জন্য ডিজেলেও ভর্তুকি দিতে হবে।”

কৃষককে কম মূল্যে ডিজেল দিতে প্রয়োজনে কার্ডের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “ওই কার্ডে মাঠ পর্যায়ে যাচাই-বাছাই করা প্রকৃত কৃষকের জন্য কম দামে ডিজেল সংগ্রহের সুবিধা দিলে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় কমে আসবে।”

অন্যদিকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক হাসনীন জাহান কৃষককে ‘কৌশলী’ হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, “ইউরিয়া সার আমাদের কৃষকরা যে হারে জমিতে প্রয়োগ করেন, তা আসলে লাগে না। যেহেতু এই সময়ে সারের দাম বেড়েছে, আবার অন্যান্য জিনিসেরও দাম বেশি, তাই যেটুকু ডোজ সার দেওয়া দরকার ঠিক ওইটুকু যদি দেন, সেখানে তাদের একটি সাশ্রয় হবে।”

ডিজেলে ভর্তুকির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “কৃষির জন্য যে ডিজেল লাগবে সেখানে ভর্তুকি দিতে পারলে অনেক ভালো, সরকার সেটি নিশ্চয় ভাববে। তবে আমি পরামর্শ দেব, কৃষক যেন ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে মাটির উপরের পানির ব্যবহার বাড়ায়। এতে ডিজেলনির্ভরতা কমবে, খরচও কমবে।”

কৃষি বিভাগ আশাবাদী

চলতি রবি মওসুমে সার-ডিজেলের দাম বাড়লেও ‘কৃষকের ক্ষতি হবে না’ বলে মনে করছে রংপুর অঞ্চলের কৃষি বিভাগ।

অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, “আমাদের বাম্পার ফলন হচ্ছে। শীতকালীন সবজিতে বাজার ভরে গেছে। সামনে সরিষা, গমের মৌসুমেও ভালো ফলন হবে বলে প্রত্যাশা আমাদের। ফলনের সাথে বাজারে দামও ভালো থাকায় আমাদের কোনো সংকট হবে না।”

রবি মওসুমে সার-ডিজেলের দাম বাড়ায় কৃষকের ‘একটু খরচ’ বেড়েছে মন্তব্য করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম  বলেন, “সার নিয়ে কৃষকরা সমস্যায় পড়বে না। সারের দাম যেটা বেড়েছে তা সরকার কৃষকদের যে প্রণোদনা, ভর্তুকি দিচ্ছে তার তুলনায় কিছুই না। ডিজেলের দাম বৃদ্ধিটা আমাদের হাতে নেই।”

“সরকার গত বছর সারে ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। এবছর প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা দিতে হবে।”

এই রবি মওসুমে উৎপাদন বাড়াতে ১৬ লাখ ৭১ হাজার কৃষককে ১৩৭ কোটি টাকা প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। গত ২৭ অক্টোবর কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক অঞ্চলের কৃষক এই প্রণোদনার আওতায় বিনামূল্যে বীজ ও সার পাবে।

একজন কৃষক এক বিঘা জমিতে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় বীজ ও সার পাবেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত বাজেট কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা খাত থেকে এ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।

গতবছর কিছু ফসলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও এবছর রবি শস্যের সময়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ফসল উৎপাদনের প্রত্যাশা করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম।

“আমরা মাঠে কৃষকদের অবস্থা খুব ভাল দেখেছি। আমাদের আমন ধান ভাল হয়েছে। রবি মওসুমেও আমরা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি উৎপাদন পাব।”

আরও খবর

Also Read: রবি ফসলের জন্য ১৩৭ কোটি টাকার প্রণোদনা

Also Read: ২ লাখ ১০ হাজার টন সার আমদানির অনুমোদন

Also Read: সার কেনায় আরও কিছু সাশ্রয় হচ্ছে সরকারের

Also Read: ডিজেল ও কেরোসিনের দাম এক ধাক্কায় ৪২.৫%; অকটেন ও পেট্রোলে ৫১% বাড়ল