সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় ব্যাংকিং খাতের চলমান সংস্কারে অটল থাকা, আঁটোসাট মুদ্রানীতি, বিনিময়হার বাজারমূখী করার মতো পরামর্শ এবারও দিল আর্ন্তজাতিক সংস্থাটি
Published : 13 Dec 2023, 12:44 PM
ঋণ কর্মসূচিতে থাকা বাংলাদেশকে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের সময়ে সামষ্টিক অর্থনীতিতে থাকা চাপ কমিয়ে আনতে চলমান আর্থিক সংস্কার অব্যাহত রাখার সুপারিশসহ একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ।
মঙ্গলবার সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক পর্ষদের সভায় বাংলাদেশের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৪৬ দশমিক ৮৩ কোটি ডলার অনুমোদনের সিদ্ধান্ত হয়।
একই সভায় আরো ২২ কোটি ১৫ লাখ ডলারের ঋণ তহবিল অনুমোদন হওয়ায় মোট ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নেয় আইএমএফ।
সভায় বাংলাদেশের বিষয়ে একগুচছ পরামর্শ ঠিক করা হয় সুপারিশ হিসেবে। পরিচালকরা সম্মিলিতভাবে বলেছেন, আর্থিক খাতের স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী সংস্কার পদক্ষেপ অব্যাহত থাকলে, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতীশীলতা পুনরুদ্ধার, বৈদেশিক চাপে সৃষ্ট ঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং রিজার্ভ চলতি বছর শেষে ২৪ বিলিয়ন ডলারের উপরে থাকবে।
এজন্য আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ কাঠামো জোরদার, আঁটোসাট মুদ্রানীতি, বিনিময়হার বাজারমুখী করা, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা ও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির মতো পরামর্শ আবারও দিল আইএমএফ।
অতি দ্রুত এ অর্থ ছাড় করা হবে জানিয়ে সংস্থাটি ঋণ অনুমোদনের পর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, আইএমএফ নির্বাহী পর্ষদ বাংলাদেশে আর্টিকেল-৪ এর মিশনের রিভিউ শেষ করেছে।
ঋণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে, এক্সটেনডেট ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) ও এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইইএফ) ব্যবস্থার অধীনে প্রথম পর্যালোচনা শেষ করে ৪৬ দশমিক ৮৩ কোটি ডলার দ্রুত ছাড় করবে।
এই ঋণের বাইরে আরএসএফ (রেসিলেন্স অ্যান্ড সাসনেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটি) তহবিলের অধীনে প্রথম পর্যালোচনা শেষ করে ২২ কোটি ১৫ লাখ ডলার ছাড় করার কথাও জানিয়েছে সংস্থাটি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত তহবিলের অধীনে এই অর্থ পাচ্ছে বাংলাদেশ ঋণ হিসেবে।
সভায় বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করতে তিনটি বিষয়কে সুনির্দিষ্ট করে বেশি গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়ে সংস্থাটি বলেছে, মুদ্রানীতিকে আরও আঁটোসাট করা, নিরপেক্ষ রাজস্ব নীতি এবং বিনিময় হার বাজারমুখী করতে।
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি একাধিক ঝুকিঁর মধ্যে দিয়ে গেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে; এ বিষয়টিও আলোচনায় স্থান পায়।
সংস্থাটি বলেছে, ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিকভাবে সুদহার বৃদ্ধি বাংলাদেশের কোভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশে নেমে আসে ও ২০২১ সালের অগাস্টে এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৯ শতাংশে উঠে মূল্যস্ফীতি।
এরপরই আমদানি সংকোচনের নীতিতে চলে বাংলাদেশ। ফল স্বরূপ চলতি হিসাবের ঘাটতি কমতে থাকে আগের চেয়ে, অপ্রত্যাশিতভাবে আর্থিক হিসাব (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) ঘাটতিতে পড়ে যায়, যেখানে এ হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল।
বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা ও অপর্যাপ্ত নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলারের বিপরীতে টাকার মান চাপে পড়ে যায়।
মুদ্রানীতির চলমান আঁটোসাট নীতি অব্যাহত থাকা ও নিরপেক্ষ রাজস্বনীতি বহাল থাকলে ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি সাত দশমিক ২৫ শতাংশ হবে আশা করা যাচ্ছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক বলে আসছে, চলতি ডিসেম্বর শেষে মূল্যস্ফীতি ৮ ও আগামী জুন শেষে তা ৬ শতাংশে নেমে আসবে। এজন্য মুদ্রানীতি সংকোচন করে নীতি সুদহার প্রয়োজনে আরো বাড়াবে।
আইএমএফ বলছে, যথা সময়ে রপ্তানি আয় প্রত্যাাঁসনের উপর জোর দিলে আর্থিক হিসাবে উন্নতি হবে বাংলাদেশের। রিজার্ভও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে চলতি অর্থবছর শেষে চার মাসের আমদানি দায় মেটানোর সক্ষমতার পর্যায়ে চলে যাবে।
আগামী জুন শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনাও দেখছে আইএমএফ। যদিও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা ও অভ্যন্তরীণ ঝুঁকির মাত্রা আগের চেয়ে বেড়েছে বাংলাদেশের।
এমন প্রেক্ষাপটে পর্ষদের সভা শেষে আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আন্তোয়েনেত সায়েহ বলেছেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুমুখী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। বৈশ্বিক একটি কঠিন চাপ বাংলাদেশের থাকার পরেও ঋণ কর্মসূচির বাস্তবায়ন সঠিক পথে রয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার শক্ত প্রতিশ্রুতি থাকায়।
“ঋণ সহায়তাপুষ্ট কর্মসূচি সামষ্টিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহযোগিতা করছে, সুরক্ষা দিচ্ছে দুর্বল জনগোষ্ঠীকে। সামষ্টিক অর্থনীতির চলমান কাঠামো সংস্কার কার্যক্রম গতিশীল করবে সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কর্মসূচিকে।”
সায়েহ বলেন, “মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বৈশ্বিক ঝুঁকি মোকাবেলায় নেয়া মধ্যমেয়াদী নীতি নির্ধারণী পদক্ষেপ চলমান রাখা উচিত। এজন্য সতর্ক ও আঁটোসাট মুদ্রানীতি, নিরপেক্ষ রাজস্বনীতি ও বাজারমুখী সহজলভ্য বিনিময়হার ঠিক করা প্রয়োজন, যা অর্থনীতির উপর থাকা চাপকে প্রশমিত করবে।’’
বৈদেশিক মুদ্রা বাজার ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে বৈশ্বিক ঝুঁকি মোকাবেলা করার সক্ষমতা বাড়াবে মনে করে তিনি বলেন, “বর্ধনশীল রাজস্ব আদায় ও সরকারি খরচ যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসা সামাজিক উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত খরচ যোগান দিতে পারবে। সরকারের অর্থ ও বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন; সরকারি ব্যয় ও রাজস্ব ঝুঁকি কমিয়ে আনতে।”
নির্বাহী সভায় বাংলাদেশ বিষয়ে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে সুপারিশও করেন পরিচালকরা।। এসবের মধ্যে রয়েছে রাজস্ব আদায়ে করনীতির বাস্তবায়ন ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ জোরালো করা, ভতুর্কির যৌক্তিকিকরণ, ব্যয় সক্ষমতা বাড়ানো ও আর্থিক ঝুঁকিগুলো আরো ভালোভাবে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা।
সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য আর্থিক খাতের সংস্কার ধাপে ধাপে এগিয়ে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে সংস্থাটি বলেছে, এজন্য ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পুনরুদ্ধারের কৌশলে জোর দিতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রযোজন।
পরিচালকরা একমত হয়েছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকি বৃদ্ধি, নীতিনির্ধারণী ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো শক্তিশালী করা, কঠোর সুশাসন ও পুঁজিবাজারকে উন্নত করতে পারলে আর্থিক খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে ও প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের উৎস সহজলভ্য হবে।
বাংলাদেশকে উচ্চ মধ্যম আয়ের অবস্থায় পৌঁছাতে দীর্ঘ মেয়াদী সংস্কারে যেতে সুপারিশ করে আইএমএফ বলেছে, বাণিজ্যের উদারীকরণ, বিনিয়োগের পরিবেশ এবং সুশাসন বৃদ্ধি, শ্রমশক্তিকে উন্নত করা এবং নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ বৃদ্ধি আরও এফডিআই আকৃষ্ট করতে, রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে এবং প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।