বিপুল বাজেট ঘাটতির চক্র ভেঙে বেরিয়ে আসতে আগামী বাজেট থেকেই রাজস্ব আহরণ এবং ব্যয় ব্যবস্থাপনায় সরকারের নীতিতে পরিবর্তন ও সংস্কার আনার তাগিদ তাদের।
Published : 31 May 2024, 01:47 AM
ব্যয়ের চাপ সামলাতে হিমশিম অবস্থার মধ্যে সংকোচনমূলক নীতি নিয়ে এগোচ্ছে সরকার; আসছে বাজেটে মুদ্রানীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজস্বনীতি গ্রহণের কথা ভাবছে। অর্থনীতির এমন প্রেক্ষাপটে রাজস্ব আয় কীভাবে বাড়বে আর বাজেটের বিশাল ব্যয়ের ফর্দ মেলাতে কী করবে সরকার-সেই জিজ্ঞাসা অনেকের মত অর্থনীতিবিদদেরও।
দীর্ঘদিন থেকেই আয়-ব্যয়ের বিপুল ঘাটতির চক্র নিয়েই বাজেট দিতে হচ্ছে সরকারকে। বাজেটের আকার প্রতি অর্থবছরেই যখন বাড়ছে, তখন ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সামঞ্জস্যও থাকছে না; যথারীতি বাড়ছে ঋণ নির্ভরতা, যার সুদ দিতে আবার চাপে পড়ছে অর্থনীতি। বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর চাপ তৈরি না করে বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নের চ্যালেঞ্জ রয়েই যাচ্ছে।
এ চক্র ভেঙে বেরিয়ে আসতে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট থেকেই রাজস্ব আহরণ এবং ব্যয় ব্যবস্থাপনায় সরকারের নীতিতে পরিবর্তন ও সংস্কার আনার তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের বোঝা বছরের পর বছর টানতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এ থেকে মুক্তি পেতে খরচে লাগাম টেনে আয় বাড়ানোর কৌশল বের করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
আসছে বাজেটের আগে অর্থনীতির বর্তমান হালচাল বিশ্লেষণে তারা রাজস্ব আদায়ের চলমান দুর্বলতার কথা যেমন তুলে এনেছেন, তেমনি ভুল নীতি-পরিকল্পনার কারণে সরকারের অনেক আয় থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা বলছেন।
বাজেট ঘাটতি ও আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানোর পুরনো প্রসঙ্গকে সামনে আনা হলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপকালে তারা সরকারকে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো, অপ্রয়োজনীয় খাতে ভর্তুকি রাখার বিলাসিতা পরিহার, বাজেটে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য আনতে সরকারের ব্যয়ের লক্ষ্য কমানো, রাজস্ব আয়ের ‘লিকেজ’ কমানোর তাগিদ দিয়েছেন।
একই সঙ্গে প্রণোদনা ও কিছু সংস্কার এনে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়ানোর পথ খোঁজার পরামর্শ তাদের। প্রশাসনেও প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে পদক্ষেপ নিতে বলেছেন তারা।
সরকারে প্রধান রাজস্ব আদায়কারী সংস্থা এনবিআরের শীর্ষ পদে থাকা এক কর্মকর্তা বাজেটে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য আনতে আগে অর্থনীতি মেরামতের তাগিদ দিয়েছেন।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের মতে, ভুল নীতি-পরিকল্পনার কারণে সরকার অনেক আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “কর ছাড়ের ফলে কাস্টমসে ৩ লাখ কোটি টাকার মত লোকসান হয় সরকারের। এই রেভিনিউ লসগুলো অনেকদিন ধরেই দেওয়া হয়েছে। অনেকগুলো ১০-২০ বছর ধরে। কিন্তু যেই কারণে লস দেওয়া হয়েছিল, তা কখনও অর্জিত হয়নি।
“আবার ব্যবসায়িক শ্রেণির চাপ আছে যে, এগুলো রাখতে হবে। না রাখলে ব্যবসা নষ্ট হবে।”
বাজেটে আয়-ব্যয়ে ভারসাম্য আনতে ব্যয়ের লক্ষ্য কমানো, রাজস্ব আয়ের ‘লিকেজ’ কমানো, নতুন করে মেগা প্রকল্প না নেওয়ার মত পরামর্শ দেন তিনি।
ব্যয় ব্যবস্থাতে পরিবর্তন আনার তাগিদ দিয়ে অর্থনীতির শিক্ষক ও গবেষক সায়মা হক বিদিশা বলছেন, চ্যালেঞ্জে থাকা অর্থনীতির চাপ কমাতে খরচের অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে, যা সরকার করতে পারছে না।
“টাকা খরচ করাটাই মূল নয়। সঠিকভাবে বরাদ্দ হচ্ছে কিনা দেখতে হবে। আমাদের যেহেতু আয় কম, তাই খুব বেশি ব্যয় করার উপায় নেই। কোন খাত বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেখানে খরচ আগে করতে হবে। অপচয় না করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষ সুফল পাবে, সেই জায়গাটিতে ব্যয় করতে হবে।”
আগামী ৬ জুন সংসদে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য আনুমানিক ৭ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বিশাল এ ব্যয়ের যোগান দিতে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হতে পারে বলে খবর এসেছে।
এতে দেখা যাচ্ছে, আয় ও ব্যয়ের ব্যবধান এবারও বিশাল। বিপুল ঘাটতি মাথায় নিয়েই বাজেটের হিসাব নিকাশ করতে হচ্ছে। তবে কাগজে কলমে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় বাস্তবতার সঙ্গে সেটির ফারাকও অনেক; যে আয় আসবে বলে ধারণা করা হয় আহরণ হয় তার চেয়ে অনেক কম। লক্ষ্যমাত্রা সংশোধনের পরও তা পূরণ হচ্ছে না বছরের পর বছর।
এ কারণে বাজেটের ঘাটতি মেটাতে বরাবরের মত এবারও ঋণ নির্ভরতা বাড়ছে। আগামী বাজেটের প্রায় ২ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঘাটতি মেটানো হবে দেশি-বিদেশি ঋণ নিয়েই, যা মোট বাজেটের এক তৃতীয়াংশের বেশি।
বাজেট প্রণয়নের সময় ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ৫ শতাংশের সমান বেশি রাখা হচ্ছে অনেক বছর ধরে। চলতি অর্থবছরে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ছিল জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। তবে নতুন বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা ৫ শতাংশের কিছুটা নিচে রাখার কথা বলছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারপরও বিপুল ঘাটতি ঋণ নেওয়াকেই প্রধান বিকল্প হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বড় অংশ আসবে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকেই।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রত্যাশিত আয় না থাকায় বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের এই ঋণনির্ভরতার ধাক্কাও পড়ছে অর্থনৈতিক পরিকল্পনায়।
আসছে বাজেটের ৮ লাখ কোটি টাকার ব্যয়ের মধ্যে ঋণের সুদ পরিশোধের জন্যই বরাদ্দ সোয়া লাখ কোটি টাকার উপরে রাখা হচ্ছে বলে খবর এসেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান বাজেট ব্যবস্থাপনায় সরকারের ঋণ নেওয়ার বিকল্প নেই। ঠিকঠাক রাজস্ব আহরণ হলে সরকারকে এত ঋণ নিতে হত না। আবার সবকিছু মিলিয়ে বিনিয়োগের অবস্থাও ভালো না হওয়ায় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার বিকল্প হতে পারে সঞ্চয়পত্র।
বাজেটে আয়-ব্যয়ের এ ফারাক বা বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে না নামার চক্রে দীর্ঘদিন থেকে আটকে থাকার পরিস্থিতির জন্য ’অবিবেচনাপ্রসূত’ ব্যয়ের পাশাপাশি রাজস্ব আদায়ের দুর্বলতাকে দায় দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।
রাজস্ব আয়ের দুর্বলতা কাটছে না কেন?
আয়কর দাতা বাড়াতে গত কয়েক বছর ধরে এনবিআরের তোড়জোড়ের ফলে বর্তমানে টিআইএনধারীর সংখ্যা ১ কোটি ৪০ লাখ ছাড়িয়েছে। আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার পরিমাণও অনেকটুকু বেড়েছে। তবে টিআইএনধারীর সংখ্যা যত বেড়েছে রিটার্ন দাখিলকারীর প্রকৃত সংখ্যা এবং প্রকৃত আয়কর দেওয়ার আশাব্যঞ্জক নয়।
অর্থনীতির শিক্ষক অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা মনে করেন, প্রতি বাজেটে উচ্চভিলাসী লক্ষ্যমাত্রা দেওয়ায় রাজস্ব আয়ে সাফল্য আসছে না।
“কেন এটা হচ্ছে, সেটি দেখা দরকার। এনবিআরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। অনেক জায়গাতে আমরা শুনি, অনেকে অর্থসম্পদের মালিক হচ্ছে, অনেকে ঋণ খেলাপি রয়েছে, তারা কতটুকু আয়কর দিচ্ছে, তাদের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আয়কর দিচ্ছে কি না, অর্থাৎ অতি ধনীদের আয়কর তাদের সম্পদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা সেই জায়গাটিতে অনেক বড় ফাঁকি রয়েছে। যারা মধ্যবিত্ত, তারা সৎভাবে আয়কর দেয়। নিম্নবিত্তদের কাঁধে ভ্যাটের অনেক বড় বোঝা কাঁধে পড়ে। অর্থাৎ তারাও রাজস্ব দিচ্ছে। কিন্তু উচ্চবিত্তরা হয়ত দিচ্ছে, কিন্তু ছিটেফোঁটা- ওই জায়গাটা বাড়াতে হবে।”
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল সময়ে রাজস্ব আহরণ আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ৬১ শতাংশ বেড়ে দুই লাখ ৮৯ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৫০ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। গত ১০ মাসে আদায় হওয়া রাজস্বের পরিমাণ চলতি অর্থবছরের জন্য নির্ধারণ করা সংশোধিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার ৭০ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। পরে তা কমিয়ে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা।
এরপরও উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভোক্তাদের জেরবার এবং সংকোচনমূলক নীতির কারণে ব্যবসা-বিনিয়োগ ও অর্থনীতিতে ধীর গতির মধ্যে রাজস্ব আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে অর্থবছরের শেষ দুই মাসে এনবিআরকে এক লাখ ২০ হাজার ৬২২ কোটি টাকা আদায় করতে হবে।
অর্থাৎ গড়ে প্রতি মাসে আদায় করতে হবে ৬০ হাজার ৩১১ কোটি টাকা, যা বর্তমান আদায়ের পরিমাণের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি।
এ প্রসঙ্গে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের জটিলতা ঠিক না করে রাজস্ব আদায় বাড়ানো সম্ভব না। এটি এনবিআরের হাতেও নেই।
কর আদায়ের সক্ষমতা বাড়াতে পারলে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে ব্যয় করার সক্ষমতা বাড়বে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক।
আরও বেশি ধনী মানুষকে করের আওতায় আনার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, “আয়কর রিটার্ন সাবমিট করাকে অনেক কিছুর সঙ্গেই বাধ্য করতে হবে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অনেকের সক্ষমতা বেড়েছে, তাদের কিছু ইনসেনটিভ দিয়ে আয়করের আওতাভুক্ত করতে হবে।
“অতিধনী কারা, তাদের খুঁজে বের করেও দেখতে হবে তারা তাদের সম্পদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ন ট্যাক্স দিচ্ছে কিনা।”
রাজস্ব আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে নজর দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ।
তিনি বলেন, “কেন মানুষ করের আওতায় আসছে না, কেন কর ফাঁকি দিচ্ছে, সে বিষয়গুলো খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের অর্থনীতির দিকে তাকালে বোঝা যায়, নির্বাচনের প্রার্থীদের মনোনয়ন ফরম কেনা থেকে শুরু করে তাদের আয়ের বিবরণী দেখলেই বোঝা যায় সম্পদ কিছু মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়ে গেছে। আয়কর যারা ফাঁকি দিচ্ছে, তারা বৈষম্য সৃষ্টি করে ফেলছে সমাজে। কারণ তাদের হাতে টাকা-পয়সা চলে আসায় তারা সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়াচ্ছে, নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী জায়গাটিও দখল করে ফেলছে।
“যার আয় হচ্ছে, তার কাছ থেকে আয়কর নেওয়া হবে না কেন? এখানে সরকারকেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। এনবিআর রাজস্ব আহরণ করবে কিন্তু সে রাজস্ব আদায়ে বাধ্য করতে পারে না। সবাইকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা তার নাই। সে বড়জোর প্রশ্ন করে ফাইল আটকে রাখতে পারে, হয়রানি করতে পারে। কিন্তু করদাতাকে ডেকে এনে কর দিতে বাধ্য করতে পারে না।”
মানুষকে কর দিতে বাধ্য করতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন বলে মতামত আবদুল মজিদের।
“মানুষ যাতে কর দিতে আসে, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। এখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যারা নিবেন, তারাই যদি কর না দেন, তাহলে তো হবে না।”
সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত বিদেশি যেসব প্রতিষ্ঠানকে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে, তাদের কাছ থেকে যেন কর আদায় করা হয় সেদিকে নজর দিতে বলেছেন তিনি।
“দেশি ঠিকাদারদের কর দিতে হলে বিদেশিরা দেবে না কেন? বিদেশিরা তো তাদের পারিশ্রমিক ডলারে নিয়ে যাচ্ছে। এসবদিকে কঠোরভাবে নজর দিতে হবে।”
নিজেদের অভ্যন্তরীণ আয় না বাড়ায় প্রতিবছরই বাজেট বাস্তবায়নে ঘাটতি থাকার পেছনে জবাবদিহিতার অভাবকে দায়ী করছেন গবেষক সায়মা হক বিদিশা।
“এখানে বাজেট বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাদের, বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আয় ও ব্যয়ের খাতটি বাস্তবায়নে কারা সংশ্লিষ্ট রয়েছে, সেটি দেখতে হবে। আয়ের ক্ষেত্রে যেমন- এনবিআর আছে, অন্যান্য সংস্থাও রয়েছে। আর ব্যয়ের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় জড়িত। মন্ত্রণালয় ও প্রকল্পভিত্তিক কঠোর পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন দরকার। মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলোকে যাচাই-বাছাই করা, কেন আমরা বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারলাম না?”
বাজেট বাস্তবায়নে সার্বিক সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে এই গবেষক সার্বিকভাবে আর্থিক খাত ও রাজস্ব খাতে সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন।
ব্যয় পরিকল্পনা কেমন হওয়া উচিত?
বাজেটে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য আনতে হলে অর্থনীতিকে মেরামত করার তাগাদা এসেছে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদের কাছ থেকে।
তিনি বলেন, “বাজেটে ঘাটতি কম হলে সেটি কাটিয়ে ওঠা যায়। কিন্তু ঘাটতি যদি বেশি হয়ে যায়, তাহলে সেটি অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়ায়। সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম ঠিক রাখতে হলে অবধারিতভাবে কঠিন শর্তের বৈদেশিক ঋণ নিতে হবে। কেননা বাংলাদেশকে কেউ-ই সহজ ঋণ দিতে চাচ্ছে না।
“কারণ বাংলাদেশের রিজার্ভ কম। প্রতিবছর এই ঘাটতি হওয়া মানেই হচ্ছে অর্থনীতির ওপর ঋণের বোঝা আরও বেড়ে যাওয়া। সেটা দেশি হোক আর বিদেশি হোক। সেই ঋণের বোঝা ও কিস্তি বাজেটের সিংহভাগ খেয়ে ফেলবে। সুতরাং বাজেটে ভারসাম্য হওয়ার খুব দরকার ছিল।”
দুটি কারণে বাজেটের আয়-ব্যয়ে ভারসাম্য আসছে না বলে মনে করছেন তিনি।
“ব্যয়ের বাজেট বাড়ানো হচ্ছে। সেখানে সুশাসন বা কৃচ্ছতাসাধন বা ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়া হচ্ছে না। তার বিপরীতে উচ্চাভিলাসী বাজেট দেওয়া হচ্ছে এবং খরচ বাড়িয়েই যাচ্ছি। অবিলম্বে অনুশাসনহীন ব্যয় বন্ধ করতে হবে। সরকারি বিভিন্ন কেনাকাটার ক্ষেত্রে যেন খরচ বাড়িয়ে কেনা না হয়, যে বছরের প্রকল্প সে বছরেই শেষ করতে হবে। প্রকল্পের সময় বাড়িয়ে খরচ বাড়ানো যাবে না।”
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাড়িয়ে সরকার গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে বরাদ্দ দিতে পারছে না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে বিদ্যমান ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন।
“সরকার প্রশাসনে কিছু সংস্কার করুক, যেটার মাধ্যমে ব্যয় কমানো সম্ভব। এতগুলো মন্ত্রণালয় রাখার কোনো দরকার নেই। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের মত দপ্তর রেখে রেখে বড় ধরনের ব্যয় করা হচ্ছে। এগুলো আস্তে আস্তে উঠিয়ে দেওয়া দরকার। একটি মন্ত্রণালয়ের সাথে যে বিশাল বাহিনী, গাড়ির বহর- এগুলোর দরকার নেই।”
”পাট মন্ত্রণালয় কী কাজ করে? এটি রাখার কী দরকার আছে?” এমন প্রশ্নও রাখেন তিনি।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায় যায় বাজেটের একটি বিরাট অংশ। ভর্তুকিতেও বড় ধরনের অর্থ ব্যয় করতে হয় সরকারকে। এর মধ্যে বেশ কয়েকখাতের ভর্তুকিকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, “আরেকটি বড় জায়গা হচ্ছে, যেগুলোতে সরকার কাজ করছে না; পাট-বস্ত্র, চিনি- এই ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে আমরা হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি গুণছি। যেটার কোনো দরকার নেই।
“রেমিটেন্সে আমরা ভর্তুকি দিচ্ছি। এটিরও কোনো দরকার নেই। তাদের তো প্রকৃত মূল্য দেওয়া হচ্ছে। এই সমস্যাগুলোর সমাধান সরকার করছে না। এসব ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ চাই।”
এর সঙ্গে পেনশনে সরকারের খরচ যে দ্রুত বাড়ছে তাও মনে করিয়ে দেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ এখন ১৮ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। গত দুই বছর ধরে ডলার সংকটে বৈদেশিক মুদ্রার এই রিজার্ভ ক্রমে কমছে।
কোভিড মহামারীর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে অর্থনৈতিক সংকট ঠেকাতে সরকার ব্যয় সংকোচনের পথে হেঁটেছিল। ডলার বাঁচাতে লাগাম টানা হয়েছিল আমদানি ব্যয়ে। মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে সংকোচনের পথে এখনও হাঁটছে সরকার।
এসব পদক্ষেপে বাজেটে ব্যয়ের চাপ কতটা কমছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অর্থনীতিবিদদের।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, “ব্যয় সংকোচনে সরকারি ব্যয় কমাতে হবে। সরকারের এত গাড়ির দরকার নাই। দলে দলে বিদেশে ভ্রমণে যায়, সেটির দরকার নাই। এই জায়গাগুলোতে কাজ করতে হবে।
“ব্যাংকিং খাতে ঋণখেলাপি কমাতে পারছি না। এ খাতের সমস্যাগুলো রেখে আমরা এগোতে পারব না।”
চলতি বাজেট ঘোষণার সময় সরকারের কৃচ্ছতা সাধনের প্রতিশ্রুতির প্রসঙ্গ টেনে সায়মা হক বিদিশা বলেন, “কিছু জায়গায় সেটি করা হয়েছে। তারপরও আরও অনেক জায়গায় কৃচ্ছতা সাধন করে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় খরচ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। এখনও আমরা দেখছি, অনেক বেশি অপচয় হচ্ছে অনেক খাতে।”
এর বিপরীতে শিক্ষা-স্বাস্থ্যে ব্যয় বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণা পরিচালক বিদিশা বলেন, “এই দুটো খাতে বিনিয়োগ করলে আমরা দীর্ঘমেয়াদে প্রতিফলন দেখব। ভারতের এখন যে বিশাল অর্থনৈতিক সাফল্য, তার মূলে রয়েছে তারা শিক্ষায় অনেক বিনিয়োগ করেছে।”
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়াতে জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাবি থাকলেও, ব্যয় করতে না পারায় এই দুই খাতের বরাদ্দ প্রতিবছরই ফেরত যাচ্ছে।
এর পেছনে এই দুটি খাতে মৌলিক কোন সমস্যা আছে কিনা, তা দেখতে বলেছেন অধ্যাপক সায়মা।
তিনি অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কাট-ছাঁট করা, কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা ও খেলাপি ঋণ বন্ধ করার তাগিদ দিয়েছেন।
বড় শিল্পগুলো চাপে পড়লে কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মন্তব করে তিনি স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থান বাড়াতে প্রণোদনা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
“বৃহৎ খাতগুলো এখন যেহেতু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তাই ছোট ছোট স্বনিয়োজিত কাজগুলোকে উৎসাহিত করা দরকার। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোর ক্ষেত্রে বাজেটে বড় ধরনের দিক নির্দেশনা থাকা দরকার। কর ছাড়, সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া, জেলাভিত্তিক কর্মসূচি করা যেতে পারে। কিছু কিছু জায়গায় কর ছাড় দিলে সেটির সুফল মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা পাবে।
এছাড়া রপ্তানি বহুমুখী করতে প্রণোদনার তাগিদ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এই শিক্ষক বলেন, “প্রণোদনায় এমন নীতি আমাদের নিতে হবে, যার মাধ্যমে নতুন খাতগুলো উৎসাহ পায়, এবং শ্রমঘন জায়গায় বিনিয়োগ বেশি হয়। কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ বাজেটের মাধ্যমে সুফল পেতে পারে।”
আরও পড়ুন:
বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা বাড়বে কোন পথে?
চাল-ডাল-তেল শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত করা হোক প্রথম কাজ:মান্নান
ভর্তুকি দিয়ে সবটা চলবে না: নতুন বাজেট নিয়ে প্রতিমন্ত্রী শহীদুজ্জামান
বাজেট ২০২৪-২৫:এনবিআরের ওপর বাড়ছে কর আদায়ের সেই পুরনো চাপ
বাজেট:বাড়ছে বয়স্ক ও বিধবা ভাতাভোগীর সংখ্যা
বাজেটে সর্বোচ্চ গুরুত্ব থাকছে মূল্যস্ফীতি রোধে: অর্থ প্রতিমন্ত্রী