এখন পর্যালোচনা করতে হবে যে টাকার সরবরাহ কমার কারণে মূল্যস্ফীতি কমছে কি না, বলেন বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক এই অর্থনীতিবিদ।
Published : 15 Oct 2024, 12:01 AM
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরকার পতনের মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে ১১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমেছে; যা উচ্চ মূল্যস্ফীতির এসময়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের কাছে ইতিবাচক হিসেবে দেখা দিয়েছে।
অগাস্টে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ বলে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর আগে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রবৃদ্ধির এ হার ছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ এবং অগাস্টে তা ছিল ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এ হার ছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ।
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির এ হার মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে ঠিক করা লক্ষ্যমাত্রার খুব কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
জুলাই-অগাস্টে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলেন রূপ নিলে সহিংসতা, কারিফিউ, ইন্টারনেট শাটডাউন আর অনির্ধারিত সরকারি ছুটিতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি বিভিন্ন সংকটের মধ্যে দিয়ে যায়।
এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিতে বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে বাজারে অর্থের সরবরাহ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি।
এ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সংকোচনশীল মুদ্রানীতির উদ্দেশই হল বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমাতে হবে। তাতে টাকার সরবরাহ কমলে মূল্যস্ফীতি কমে আসতে পারে।
“বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমা একটা সাফল্য হিসাবে দেখা যেতে পারে। এখন পর্যালোচনা করতে হবে যে টাকার সরবরাহ কমার কারণে মূল্যস্ফীতি কমছে কি না।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপের ওপর মূল্যস্ফীতি ওঠানামা করে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সুদের হার বাড়িয়ে দিয়ে ঋণের প্রবাহ কমানো গেলে মূল্যস্ফীতি কমবে কি, কমবে না সেটার কোনো নিশ্চয়তা না এলেও আরও চড়াও হওয়া বন্ধ করা যায়। সেই দিক থেকে পর্যালোচনা করলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমানো উদ্দেশ্য ছিল।
তার মতে, ঋণ প্রবৃদ্ধি কমার কারণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি কার্যকর হওয়ার বিষয়টি ইঙ্গিত দিচ্ছে।
সুদহার চড়ছেই, বিপাকে ব্যবসায়ীরা
মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে ফের বাড়বে নীতি সুদহার: গভর্নর
মূল্যস্ফীতি দমাতে রেপো ফের বেড়ে হল ৯.৫০%
ব্যাংকাররা বলছেন, জুলাই-অগাস্টের অস্থিরতা ছাড়াও বেসরকারি খাতে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার বড় কারণ ব্যবসায়ীরা ঋণপত্র খুলছেন কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে আগের অর্থবছরের তুলনায় আমদানি কমেছে ১ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি অর্থবছর জুলাই-অগাস্টে আমদানি হয়েছে ৯ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। আগের অর্থবছরের একই সময় যা ছিল ১০ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে ‘এক রকমের অস্থিরতা’ থাকার প্রভাব দেখা যাচ্ছে ব্যবসা বাণিজ্যে। এরকম পরিবেশে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করবেন না, যে কারণে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে।
আন্দোলন ছাড়াও ডলার দরে অস্থিতিশীলতা, গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়া এবং অনেক জায়গায় ঠিকমত বিদ্যুৎ না পাওয়ার বিষয়ও বিনিয়োগে প্রভাব ফেলছে বলে তিনি মনে করেন।
অভিজ্ঞ এ ব্যাংকারের মতে, এসব কারণে বেশ কয়েক মাস ধরেই ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে সময় নিচ্ছেন। তারা পরিস্থিতি বুঝে সামনে বিনিয়োগ করবেন। তাছাড়া আমদানি কমে যাওয়ায় এর একটা প্রভাব পড়ছে। আবার রপ্তানি আশানুরূপ না বাড়ারও প্রভাব রয়েছে।
বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ২০২২ সালের প্রথম দিকে ১০ শতাংশের ওপর ছিল। ওই বছর তা ১৪ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। এরপর বিভিন্ন কারণে মূল্যস্ফীতির পারদ চড়তে থাকলে তা কমিয়ে আনতে নীতি সুদহার রেপো বাড়ানো হয়। মুদ্রানীতিতে আরও সংকোচনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এতে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি থেকে আবার কমতে শুরু করে ঋণ প্রবৃদ্ধি।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকটও এর একটা কারণ। আবার তারল্য সংকটের মধ্যেই যাদের বিনিয়োগযোগ্য অর্থ আছে সেসসব ব্যাংকাররা নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগের জায়গা খুঁজছেন। নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে ট্রেজারি বিল ও বন্ডকে বেছে নিয়েছেন। কারণ সেখান থেকে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদ পাওয়া যায়।
“ব্যাংকাররা ভয়ে ছিল কোথায় বিনিয়োগ করবে। কারণ ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে অনেকে সেই টাকা ফেরত দিত না। তাই বেশিরভাগ ব্যাংক গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বেশি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করা বাড়িয়েছে।”
নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ শতাংশ