স্বল্প সুদের বিদেশি ঋণ কমছে, ভবিষ্যতের ভরসা ‘বাজারভিত্তিক’ সুদ

সাম্প্রতিক ও সম্ভাব্য ঋণ গ্রহণ ও চুক্তি বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তৈরি ইআরডির এক প্রতিবেদন বলছে, উচ্চ সুদহারের ঋণের পথে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

জাফর আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 May 2023, 06:52 AM
Updated : 20 May 2023, 06:52 AM

কম সুদহারের বিদেশি ঋণ এখনই মিলছে কম, সামনের দিনে তা আরও কমে বাজারভিত্তিক হওয়ার পথে এগুচ্ছে; এমন প্রেক্ষাপটে ঋণের ‘সদ্ব্যবহার’ করে সর্বোচ্চ লাভ পেতে কৌশলী হওয়ার পরামর্শ এসেছে অর্থনীতির এক বিশ্লেষকের কাছ থেকে।

বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের সংস্থান ও পরিশোধসহ সার্বিক বিষয়গুলো দেখভালকারী সংস্থা অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিদেশি ঋণের ৬৭ শতাংশই ছিল সবচেয়ে কম সুদের, যা নমনীয় ঋণ হিসেবে পরিচিত। চার বছরের মাথায় এমন ঋণ কমে ৫৯ শতাংশে নেমেছে।

অপরদিকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উৎস থেকে বাংলাদেশের নেওয়া বিদেশি ঋণের মধ্যে ১৭ শতাংশ ছিল তুলনামূলক বেশি সুদের, যা বাজারভিত্তিক বা ফ্লোটিং ভিত্তিতে সুদহার ঠিক করা হয়। ২০২০ সাল পর্যন্ত এমন ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ দশমিক ৩ শতাংশে।

এমন প্রবণতার মধ্যে বৈদেশিক অর্থায়নের ধরন, সাম্প্রতিক ও সম্ভাব্য ঋণ গ্রহণ ও চুক্তি বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তৈরি ইআরডি এর এক প্রতিবেদন বলছে, দেশের অর্থনীতিতে উন্নয়নের ছোঁয়ার প্রভাব পর্যায়ক্রমে দৃশমান হচ্ছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিবেচনার সূচকগুলোতে বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতি হচ্ছে, স্ট্যাটাস বদলাচ্ছে। ঋণের সুদহার নির্ধারণে তা ভূমিকা রাখছে। এতে কম সুদের বদলে উচ্চ সুদহারের ঋণের পথে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

এক্ষেত্রে সুদহার বেশি গুনতে হলেও অনেক খাতে ঋণ নেওয়ার বিশেষ দরজা খুলে দেবে। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, নমনীয় সুদহারের বদলে আইডিএ ব্লেন্ড হিসেবে পরিচিত মিশ্র ঋণ সুবিধার অধীনে বিশ্ব ব্যাংকের আইবিআরডি এর ঋণ নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে।

গত ডিসেম্বরে ইআরডির বিশ্লেষণভিত্তিক ওই প্রতিবেদনের প্রক্ষেপন বলছে, ২০২৬ সালে গিয়ে সস্তা ঋণের সুযোগ কমে নেমে আসবে ৪৬ শতাংশে। ২০৩১ সালে তা আরও কমে ২৫ শতাংশে এবং বর্তমান অগ্রগতি বজায় রেখে ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর লক্ষ্য বাংলাদেশ অর্জন করলে তা ৪ শতাংশে নেমে আসতে পারে। ঠিক এর বিপরীত অবস্থা হবে উচ্চ সুদহারের ঋণের ক্ষেত্রে; যেগুলোর সুদহার নির্ধারণ করা হয়ে থাকে বাজারভিত্তিক বা ফ্লোটিং হিসেবে।

এর কারণ তুলে ধরে ইআরডি কর্মকর্তারা স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে আসা এবং আরেক মানদণ্ডে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার কথা বলছেন। এতে সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদের ঋণ পাওয়ার অংশ কমে আসছে। কেননা উন্নয়ন সহযোগী ও অর্থায়নকারী ঋণদাতা সংস্থাগুলো ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে গরীব ও ধনি দেশের অগ্রাধিকার তালিকা অনুসরণ করে থাকে।

বর্তমানে কম সুদের বা নমনীয় ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ২ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। আর বাজারভিত্তিক (ফ্লোটিং রেট) ঋণের ক্ষেত্রে সোফর (দ্য সেকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট) এবং এর সঙ্গে অন্যান্য ফি ও চার্জ হিসাব করে সুদ নির্ধারণ করা হচ্ছে।

বিশ্লেষণভিত্তিক এই প্রক্ষেপন প্রতিবেদন প্রসঙ্গে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটি শুধু একটি বিশ্লেষণ। বৈদেশিক অর্থায়নের ধরন, সাম্প্রতিক এবং সম্ভাব্য ঋণ প্রবণতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।”

ইআরডির ওই বিশ্লেষণ বলছে, বর্তমান ধারা বজায় থাকলে ২০২৬ সালে বাজারভিত্তিক ঋণের অংশ হবে ৪২ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০৩১ সালে তা মোট ঋণের ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশে এবং ২০৪১ সালে তা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৮২ শতাংশে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক ও গবেষক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশ উন্নত হলে আমাদের চেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোকে সস্তা ঋণ দিতে হবে এই অগ্রাধিকার দাতাদের রয়েছে। তাই বাস্তবতা মানতে হবে।

“এমন পরিস্থিতিতে আমাদের ঋণের যথার্থ সদ্ব্যবহার করে সর্বোচ্চ লাভবান হওয়ার কৌশল নিতে হবে। যাতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে দেশের অর্থনীতি চাপে না পড়ে।”

Also Read: আইএমএফের ঋণ: দুয়ার খুলবে আরও বিদেশি অর্থায়নের

বাংলাদেশ এলডিসি তালিকা থেকে বেরিয়ে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নাম লেখাবে। অপরদিকে বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ শ্রেণির মানদণ্ড অনুযায়ী সংস্থাটি ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে সুদহার বাড়ায়। তখন আগের সবচেয়ে সস্তা ঋণের সঙ্গে কিছুটা সুদহার বাড়িয়ে ‘ব্লেন্ড’ (যা মিশ্র সুদহারভিত্তিক ঋণ হিসেবে পরিচিত) সুদহার কার্যকর করে।

২০১৫ সাল পর্যন্ত বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতাদের মধ্যে বিশ্ব ব্যাংকের ঋণের সুদহার ছিল ০.৭৫ শতাংশ এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থার (জাইকা) ও কোরিয়া আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থার (কোইকা) ০.১ শতাংশ। ভারত ১ শতাংশ, চীন ১ থেকে ২ শতাংশ এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সুদহার ছিল ১ থেকে ২ শতাংশ।

পরে বাংলাদেশ নিম্ম মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলে বিশ্ব ব্যাংক কিছুক্ষেত্রে সুদহার বাড়িয়ে ১ দশমিক ২৫ শতাংশে উন্নীত করে। ওয়াশিংটনভিত্তিক এ সংস্থাকে অনুসরণ করে জাইকাও সুদহার বাড়িয়ে ১ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত করেছে। গত কয়েক বছর ধরে চীনা ঋণের সুদহার ২ থেকে ৪ শতাংশ পর্যন্ত।

ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, উচ্চ সুদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে বাজারভিত্তিক ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হয় ‘লাইবর’ বা লন্ডন আন্তঃব্যাংকের (লন্ডন ইন্টারব্যাংক অফার্ড রেট) সুদহার অনুসরণ করে এবং ‘সোফর’ (দ্য সেকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট) ও ইউরিবর এর (ইউরো ইন্টারব্যাংক অফার্ড রেট) ভিত্তিতে।

Also Read: যে কারণে বাংলাদেশ বেশি বিদেশি ঋণ পাচ্ছে

Also Read: বিদেশি ঋণ ছাড় প্রথমবারের মত ৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল

তবে এখন সুদহার নির্ধারণে ‘লাইবর’ এর বদলে ‘সোফর’ অনুসরণ করা হচ্ছে। আগে লাইবর হিসেবে নেওয়া ঋণও সোফর এ রূপান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে সোফর এর হার ৪ দশমিক ৮। এর সঙ্গে অর্থায়নকারী সংস্থা ভেদে চুক্তি অনুযায়ী ফি ও চার্জ যোগ করা হয়।

বর্তমানে এডিবির প্রায় ৫০ শতাংশ ঋণে এবং রাশিয়ার সঙ্গে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণে বাজারভিত্তিক সুদহার দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

ইআরডির ওই প্রতিবেদনে বৈদেশিক ঋণের কার্যকর ব্যবহার করে সুফল পাওয়ার কিছু পরামর্শও রাখা হয়েছে।

মানসম্পন্ন ঋণ গ্রহণে গুরুত্বারোপ করে এতে বলা হয়, বৈদেশিক ঋণ মূলত প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্যই নেওয়া হয়। কিন্তু যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে না পারায় ঋণের অর্থছাড়ে সমস্যা দেখা দেয়। সময়মত ঋণ ছাড় করতে না পারায় তা দিনে দিনে জমা হয়ে পাইপলাইনের আকার ধারণ করে।

এ সমস্যা দূর করতে প্রকল্পের মূল কাজ শুরুর আগে সকল প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম পরিচালনার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।

একই সঙ্গে প্রস্তুতিমূলক কাজ হিসেবে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই, জমি অধিগ্রহণ, কাজের নকশা এবং দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু থেকে করার পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়নে ব্যবস্থাপনা ব্যয় বরাদ্দের সুপারিশও করা হয়।

দেশের উন্নয়নে প্রকল্প বাস্তবায়নে এমন উচ্চ সুদের অর্থায়নের প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক সেলিম রায়হান বিনিয়োগ ও রপ্তানি বাড়ানোর পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, “আমাদের উন্নয়নের বাজার ধরতে দেশে ব্যাপকভাবে বৈদেশিক বিনিয়োগ আসবে। সরকারকে সেই বিনিয়োগ আসার পথ মসৃণ করতে হবে। এবং রপ্তানিবাজার উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (এফটিএ) এবং প্রিফারেনশিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট (পিটিএ) চুক্তি করতে হবে।”

বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়ানোর জন্য তিনি আর বেশি রেমিটেন্স আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শও দেন তিনি।