এক্ষেত্রে বৈধ আয়ের শর্ত জুড়ে দিতেও অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি।
Published : 23 Jun 2024, 10:20 PM
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনার মধ্যে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই চায় ব্যক্তি নয়, শুধু প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ সুযোগ দেওয়া হোক।
অবৈধ উৎস থেকে করা আয় সাদা করার সুযোগ থাকাও উচিত নয় বলে মনে করে সংগঠনটি। তাদের দাবি, “এই বিধানের অধীন ঘোষিত কোনো আয় যেন কোনো অবৈধ উৎস হতে উদ্ভূত না হয়।”
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে এটিসহ আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে দুই সভায় অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর কাছে দাবি জানিয়েছে এফবিসিসিআই।
শনিবার অর্থমন্ত্রীর কাছে কালো টাকা সাদা করার বিষয়টিসহ নতুন করে ১২টি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন সংগঠনের সভাপতি মাহবুবুল আলম। এর আগে গত ১৫ জুন প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে সংগঠনের আরও কিছু সুপারিশ ও প্রস্তাব পাঠানো হয়।
শুধু প্রতিষ্ঠানের বেলায় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখার প্রস্তাবের কারণ জানতে চাইলে এফবিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে অনেক বেশি টাকা রয়েছে। সেসব অর্থ যেন আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে যোগ হয় সেজন্য আমরা এই বিশেষ সুযোগ কেবল প্রতিষ্ঠানের জন্য রাখার প্রস্তাব করেছি। এতে সরকারের করের জাল আরও বাড়বে।“
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ, নগদ টাকা এবং শেয়ারসহ যে কোনো বিনিয়োগ কর দিয়ে ঢালাওভাবে সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। বাজেটে এ প্রস্তাবের পর থেকে তা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়।
বাজেটেত্তোর সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ক প্রশ্নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেছিলেন, “ব্যবসায়ীদের দাবির কারণে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ চালু করা হয়েছে।”
তিনি বলেছিলেন, “আমাদের কাছে তথ্য ছিল যে কয়েকজন ব্যবসায়ী অডিট সংক্রান্ত সমস্যার কারণে তাদের সব সম্পদ প্রদর্শন করতে পারেননি। সেজন্য আমরা এ প্রস্তাব দিয়েছি। এখন সংসদে এ বিষয়ে আলোচনা হবে এবং সংসদ সদস্যরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।”
এখন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই বাজেটের ঘোষণা পুর্নবিবেচনার জন্য প্রস্তাব দিয়ে তা শুধু প্রতিষ্ঠানের জন্য করতে বলেছে। এক্ষেত্রে বৈধ আয়ের শর্ত জুড়ে দেওয়ারও প্রস্তাব করা হয়েছে।
কালো টাকা সাদা করা নিয়ে প্রশ্ন তোলা না গেলে সেই সম্পদ বা আয় বৈধ উপায়ে অর্জিত হয়েছে কি না সেটি কীভাবে বোঝা যাবে-এমন প্রশ্নে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, “প্রশ্ন তোলা হলে তখন ব্যবসায়ীরা আর অপ্রদর্শিত আয় সাদা করতে উৎসাহিত হবেন না। এই বিশেষ নীতির মাধ্যমে তাদের আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে আসতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এতে সরকার পরের অর্থবছর থেকে এই সম্পদের ওপর থেকে সাধারণ নিয়মেই কর আহরণ করতে পারবে।”
সংগঠনের সভাপতি মাহবুবুল আলম স্বাক্ষরিত চিঠিতে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, “এ বিধানের ফলে কর নীতির স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা রক্ষা করবে এবং কর প্রদানকারী সকল প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করবে।”
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুধু প্রতিষ্ঠানের জন্য এই সুযোগ থাকবে, ব্যক্তি করদাতার ক্ষেত্রে থাকবে না, এটা কেমন কথা। এটা তো ডিস্ক্রেমেন্টরি। যাদের প্রতিষ্ঠান আছে তাদের বেশিরভাগই আয় দেখান কোম্পানিতে, ব্যক্তি করের রিটার্নে দেখান না। ফলে এটি আরও বৈষম্য তৈরি করবে।
“আমাদের কথা হচ্ছে, এই সুযোগ কারও জন্যই থাকা উচিত নয়।”
অবৈধ উৎস থেকে উদ্ভূত আয় সাদা করার সুযোগ নয়, এফবিসিসিআইয়ের এমন শর্তারোপের প্রস্তাব বিষয়ে তিনি বলেন, “বর্তমান আইনে যেহেতু উৎস নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। তাই বৈধ বা অবৈধ আয় বোঝারও সুযোগ নাই। তবে সেটি যদি আইনের মাধ্যমে স্পষ্ট করা যায়, তাহলে অপ্রদশর্শিত আয়ের টাকা সাদা করার সুযোগ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সবার ক্ষেত্রেই সমানভাবে থাকা উচিত।”
এর আগে সবশেষ ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত শর্তসাপেক্ষে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছিল। পরের অর্থবছরে সেই সুযোগ আর রাখা হয়নি। একই সঙ্গে প্লট, ফ্ল্যাট ও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগও তুলে নেওয়া হয়।
তবে এই বিশেষ সুযোগের বাইরে যে কোনো ব্যক্তি আয়কর আইন মেনে যে কোনো সময় নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করতে পারেন। তবে তখন তাকে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে।
বাজেটে আরও যেসব বদল চায় এফবিসিআই
রোববার অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠানো প্রস্তাবে বৈষম্য কমাতে সরকারি ভবিষ্য তহবিলেও করারোপের প্রস্তাব করেছেন এফবিসিসিআই সভাপতি।
চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “বেসরকারি তহবিলসমূহের অর্জিত আয়ের উপর ১৫ শতাংশ হারে হ্রাসকৃত আয়করের বিধান করা হয়েছে। কিন্তু আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা হতে সরকারি তহবিলসমূহকে অব্যাহতি প্রদান করাসহ তাদের করকেও আয়মুক্ত করার বিধানটি সরকারি ও বেসরকারি কর্মীদের মাঝে বৈষম্য তৈরি করছে।”
এজন্য সরকারি ও বেসরকারি কর্মীদের মাঝে বৈষম্য দূর করতে সরকারি তহবিলগুলো তথা প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুইটিসহ অন্যান্য ভবিষ্য তহবিলকে আয়করের আওতায় আনার প্রস্তাব করেছে ব্যবসায়িক সংগঠনটি।
বিক্রির ৩০% পর্যন্ত নগদ লেনদেন
করপোরেট করহার আড়াই শতাংশ কমাতে কোনো আয়বর্ষে সব প্রকার আয় ও প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ৫ লাখ টাকার বেশি একক লেনদেন এবং বার্ষিক ৩৬ লাখ টাকার বেশি ব্যয় বা বিনিয়োগ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে করার শর্ত দেওয়া হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে।
এফবিসিসিআই এ বিষয়ে ছাড় চেয়ে বলেছে করহার কমানোর ক্ষেত্রে নগদ লেনদেনের শর্ত আরোপ বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুরোপুরি মেনে চলা ব্যবসাবান্ধব হবে না।
তারা বলেছে, ”এই হার কোম্পানির বিক্রয়ের হারের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। যেমন, বিক্রয়ের ৩০ শতাংশের বেশি নগদে সম্পাদন করা যাবে না। আবার আগামী বছরগুলোতে তা ক্রমান্বয়ে হ্রাস করা যেতে পারে।”
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর অব্যাহতির শর্ত শিথিলের প্রস্তাব
নতুন অর্থ বিলে আইটিইএস সার্ভিসগুলোর কর অব্যাহতি পেতে হলে শতভাগ নগদবিহীন লেনদেনের শর্ত আরোপ করা হয়েছে।
এফবিসিসিআই সভাপতি তার প্রস্তাবে বলেছেন, “বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং অবকাঠামো এবং ডিজিটাল লেনদেনের সুবিধার সীমাবদ্ধতার কারণে ১০০ শতাংশ নগদবিহীন লেনদেন পরিপালন করা অনেক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হবে।
“যেহেতু এই ব্যবসার পরিধি অনেক ছোট আকারের হয়ে থাকে এবং তাই এখনও এসকল প্রতিষ্ঠান নগদ লেনদেনের ওপর নির্ভরশীল। তাই এই খাতের ক্ষেত্রে ১০০% নগদবিহীন লেনদেনের শর্তটির শিথিল করে আগামী বছরগুলোতে তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করা যেতে পারে; যা এই ব্যবসাকে কর অব্যাহতির সুবিধা পেতে সহায়তা করবে।”
অন্যান্য প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে- অর্থনৈতিক অঞ্চলে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের আয়ের উপর কর অব্যাহতি, আয়কর আইনের ১৬৩ ধারার নূন্যতম করের বিধান বিলুপ্ত করা, ব্যবসার আয়ের ক্ষেত্রে অননুমোদনযোগ্য খরচের তালিকা হ্রাস করা, রিস্ক-বেসড মেথডে অডিট নির্বাচন করা, করের হার ভবিষ্যতাপেক্ষ করার মাধ্যমে ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে কার্যকর করা, উৎসে করের হার বাস্তবিক করা।
আরও পড়ুন:
১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ
'অপ্রদর্শিত' আয়ে কেনা জমি-ফ্ল্যাট বিনাপ্রশ্নে বৈধ করার সুযোগ
'কালো টাকা সাদা করা'র সুযোগের পক্ষে এনবিআর চেয়ারম্যানের সাফাই