প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা, অপ্রদর্শিত সম্পদ, জমি, ফ্ল্যাট-প্লট, শেয়ারসহ যে কোনো বিনিয়োগ ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করার সুযোগ রয়েছে।
Published : 07 Jun 2024, 05:45 PM
প্রস্তাবিত বাজেটে ‘কালো টাকা’ সাদা করার যে সুযোগ দেওয়া নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর এর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম এর পক্ষেই বলছেন।
তিনি বলছেন, যারা অসচেতনতায়, অজ্ঞতায় বা কোনো জটিলতায় পড়ে আয়কর বিবরণীতে সম্পদের তথ্য দিতে ব্যর্থ হন, তাদের সুযোগ দিতেই ‘অপ্রদর্শিত আয়’ বৈধ করার এই সুযোগ।
আর যারা অবৈধ সম্পদের মালিক তারা দেশের অর্থনীতিতে সেই অর্থ ব্যবহার করেন না বলেই এনবিআর চেয়ারম্যানের ভাষ্য।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা, অপ্রদর্শিত সম্পদ, জমি, ফ্ল্যাট-প্লট, শেয়ারসহ যে কোনো বিনিয়োগ ১৫ শতাংশ কর দিয়ে ঢালাওভাবে সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে।
এর সমালোচনা করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলেছে, যেখানে সাধারণ নিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে সর্বোচ্চ কর হার ৩০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে, সেখানে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বিনাপ্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নৈতিক বা অর্থনৈতিক– কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা নিয়মিত কর দেন, এর মধ্য দিয়ে তাদের ‘তিরস্কৃত’ করা হচ্ছে।
বাজেট ঘোষণার পরদিন শুক্রবার ঢাকার ওসমানী মিলনায়তনে অর্থমন্ত্রীর বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সাংবাদিকরা। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এনবিআর এর চেয়ারম্যানকে এর উত্তর দিতে বলেন।
রহমাতুল মুনিম বলেন, “আসলে যখন এ ধরনের অ্যামনেস্টি দেওয়া হয়, তখনই সাধারণের প্রশ্ন আসে যে, এটা কালো টাকাকে সাদা করার জন্য। কিন্তু আমরা মূলত এ অ্যামনেস্টি দিয়ে থাকি বিভিন্ন কারণে অপ্রদর্শিত কিছু সম্পদ থাকতে পারে।
“রিটার্নে দেখানো হয়নি আগে, সেটা নানা কারণে হতে পারে। অসতর্কতার জন্য হতে পারে। অজ্ঞতার কারণে রিটার্নে দেখানো যায়নি অথবা অন্যের মাধ্যমে রিটার্ন জমা দেওয়ার কারণে হতে পারে। আমাদের অনেকেই নিজে রিটার্ন জমা না দিয়ে অন্যের মাধ্যমে রিটার্ন জমা দেন।”
অন্যের মাধ্যমে রিটার্ন দেওয়ার কারণে তথ্যগুলো (অপ্রদশির্ত অর্থ-সম্পদ) নথিতে বাদ পড়ে যায় বা ভুল হয়ে যায় বলে মনে করেন এনবিআর চেয়ারম্যান।
জমি কেনা-বেচার ফলে ‘অজ্ঞাতে’ কিছু টাকা কালো হয়ে যায় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আরও একটি বিষয় রয়েছে, সেটা আপনারা স্বীকার করবেন যে, জমি ক্রয়-বিক্রয়ে আমাদের কিছু টাকা আমাদের অজ্ঞাতেই কালো হয়ে যায় বা অপ্রদর্শিত হওয়ার সুযোগ হয়ে যায়।
“এ ধরনের কিছু অনিবার্য কারণে রিটার্নে যে সমস্ত সম্পদ দেখাতে পারেননি, সেই সম্পদ দেখানোর সুযোগ দেওয়ার জন্য অনেক দেশেই এ প্র্যাকটিসটি আছে।”
কালো টাকা সাদা করার এ সুযোগ ‘ব্যবসায়ী মহল ও সাধারণের’ দাবি ছিল বলে মন্তব্য করে রহমাতুল মুনিম বলেন, এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ শতাংশ কর দেওয়ার মাধ্যমে সুযোগটি দেওয়া হয়েছে।
কমপ্লায়েন্স ও টাকা পাচার রোধের বিবেচনা থেকেও কালো টাকা বৈধ করার পক্ষে যুক্তি দেন এনবিআর চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, “কমপ্লায়েন্সের বিষয়টি আমরা যখন এনশিওর করতে যাচ্ছি, তখন দেখা যাচ্ছে কিছু অপ্রদর্শিত জিনিস রয়ে গেছে, যেগুলো ব্যবসায়ীরা দেখাতে চান, ব্যক্তি পর্যায়ে দেখাতে চান। নতুন করদাতা যারা, তারা করের আওতায় আসতে চান এবং এগুলো দেখাতে চান। সেজন্য আমরা এ ধরনের একটি সুযোগ করে দিয়েছি।
“আরও একটি বিষয় হল, কালো টাকা যারা তৈরি করেন, আমরা কথায় কথায় বলি, কালো টাকাকে যারা প্রশ্রয় দেন, তারা অর্থনীতিতে এই কালো টাকাকে ব্যবহারের জন্য করেন না।
“কালো টাকা মূলত দেশের বাইরেই বেশি চলে যায় এবং বিভিন্ন ভোগ বিলাসের কাজেই ব্যয় হয়ে যায়। সেই জায়গা থেকেই রিটার্নে বিষয়টি রাখার জন্য সুযোগটা রেখেছি।”
প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করে তাদের অপ্রদর্শিত সম্পদ ট্যাক্স রিটার্নে সংযুক্ত করেন, তাহলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কেউই কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবেন না।
২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন এর মধ্যে এ সুযোগ নিতে পারবেন কালো টাকার মালিকেরা। একই সঙ্গে প্রশ্ন ছাড়া জমি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট কিনে থাকলেও এলাকা অনুযায়ী বেঁধে দেওয়া কর পরিশোধ করে সেগুলো বৈধ করা যাবে।
এর আগে সবশেষ ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত শর্ত সাপেক্ষে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছিল। পরের অর্থবছরে সেই সুযোগ আর রাখা হয়নি। একই সঙ্গে প্লট, ফ্ল্যাট ও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগও তুলে নেওয়া হয়।
তবে যে কোনো ব্যক্তি আয়কর আইন মেনে যে কোনো সময় নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করতে পারতেন। তবে তখন তাকে প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল।
কালো টাকা ও সম্পদ সাদা করার বিষয়ে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেন, “চলমান বৈশ্বিক সংকটের কারণে পরিবর্তিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখা আবশ্যক। অর্থনীতিতে কার্যকর চাহিদা সৃষ্টি এবং তা বজায় রাখার নিমিত্ত পর্যাপ্ত সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য একদিকে অধিক পরিমাণ রাজস্ব যোগান দিতে হবে এবং অন্যদিকে বেসরকারি খাতেও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড গতিশীল রাখতে হবে।”
তিনি বলেন, ডেটা ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) চালুর ফলে বিভিন্ন কোম্পানির অপ্রদর্শিত আয় ও সম্পদ প্রদর্শনে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। তা ছাড়া, রিটার্ন দাখিলে করদাতার অজ্ঞতাসহ অনিবার্য কিছু কারণে অর্জিত সম্পদ প্রদর্শনে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে।
”এই অবস্থায় করদাতাদের আয়কর রিটার্নে এই ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ প্রদান এবং অর্থনীতির মূল স্রোতে অর্থ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমি আয়কর আইনে কর প্রণোদনা সংক্রান্ত একটি অনুচ্ছেদ সংযোজনের প্রস্তাব করছি।”
অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রস্তাবিত বিধান অনুযায়ী, দেশের প্রচলিত আইনে যাই থাকুক না কেন, কোনো করদাতা স্থাবর সম্পত্তি যেমন, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট কর হারে এবং নগদসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করলে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রকারের প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না।