বিনিময় হার বাস্তবিক অর্থে বাজারভিত্তিক করা এবং পণ্য সরবরাহের বাজার ব্যবস্থাপনাকে এখনও চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।
Published : 10 Feb 2025, 01:55 AM
বছর কয়েক ধরে চড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সুদের হার টানা বাড়িয়ে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক; এবার সেই ধারা থেকে বের হওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রথম মুদ্রানীতি দিতে যাচ্ছেন গভর্নর আহসান এইচ মনুসর।
তার জন্য কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে চার মাস পর এক অঙ্কে নেমে আসা জানুয়ারির মূল্যস্ফীতির তথ্য। যে কারণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সুতোয় কিছুটা হলেও ঢিল দেওয়ার সুযোগ থাকছে তার সামনে।
তবে রিজার্ভ বাড়ানো ও বিদেশি মুদ্রা ব্যবস্থাপনাকে বাজারভিত্তিক করার পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের জন্য অর্থ প্রবাহ বাড়ানোর চাপও সামলাতে হবে তাকে বলে মনে করছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকরা।
সোমবার বেলা ৩টায় আগামী জুন পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতির বিভিন্ন সূচকের লক্ষ্যমাত্রা প্রকাশ করবেন গভর্নর। এর আগে সকালে প্রাক্কলিত মুদ্রানীতি অনুমোদন হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ সভায়।
সরকারের আর্থিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে বাজারে কী পরিমাণ অর্থের সরবরাহ থাকবে, সেটির সম্ভাব্য পরিকল্পনা থাকে মুদ্রানীতিতে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি, বিনিময় হার, রিজার্ভের বর্তমান পজিশন দেখেই মুদ্রানীতি করা হচ্ছে।’’
সাধারণত বছরের প্রথম মাস জানুয়ারির শুরুতেই পরবর্তী ছয় মাসের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনাকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন তিনি।
সেজন্য আগের সরকারের সংকোচনমূলক নীতিরি ধারাবাহিকতায় রেপো হার বাড়িয়ে ব্যাংক ঋণের সুদহার বৃদ্ধি, ছাপানো টাকার পরিমাণ কমিয়ে আনা ও দুর্বল ব্যাংকের তারল্য সহায়তার পরিমাণ কমিয়ে আনার পরিকল্পনার কথা বলে আসছিলেন তিনি।
এসব নানা উদ্যোগের প্রভাবে জানুয়ারি শেষে মূল্যস্ফীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটির ওপর ভিত্তি করে আগামী মুদ্রানীতি সাজানোর পরিকল্পনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কর্মকর্তারা বলছেন, এজন্য এবারের মুদ্রানীতি ঘোষণা জানুয়ারির দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহের বদলে ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় সপ্তাহে গড়িয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস জানুয়ারি মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ হওয়ার তথ্য দেয় গত ৪ ফেব্রুয়ারি। চার মাস পর এ হার এক অঙ্কে নেমে আসে। এর আগে সবশেষ গত বছরের জুনে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।
জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ৭.৫ শতাংশে নামানোর লক্ষ্য
রোববার গভর্নর আহসান মনসুরের বরাত দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আগামী জুলাই নাগাদ মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশে নেমে আসবে।
এর আগে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গত ২৮ জানুয়ারি অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত ও সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক শেষে বলেন, “রোজার সময় একটা মেজর পরিকল্পনা নেব। সেটার ফলটা এপ্রিল-মে মাসের দিকে পাওয়া যাবে।
“জুন মাসের দিকে যেটাকে আপনার আইডিয়াল সিচুয়েশন বলছেন, ৬ কিংবা ৭ শতাংশের দিকে যেতে পারে। আমার পক্ষ থেকে বলছি, মার্চের দিকে কতগুলো স্পেসিফিক অ্যাকশন দেখবেন; বিশেষ করে আর্থিক খাতকে সামনে রেখে।”
ভোগাচ্ছে মূল্যস্ফীতি
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা হারানোর তিন দিন পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব নেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে বেছে নেওয়া হয় আহসান মনসুরকে। গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই তিনি অর্থনীতি ও সীমিত আয়ের মানুষকে ভোগাতে থাকা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দেন।
২০২৪ সালের মে মাস থেকে নীতি সুদহার বাড়ানোর কৌশলকে আরও ত্বরান্বিত করেন তিনি। দায়িত্ব নেওয়ার মাসেই নীতি সুদহার সাড়ে ৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯ শতাংশে উন্নীত করেন। এরপর কয়েক দফায় আরো বাড়ানোর পর সবশেষ গত ২২ অক্টোবর নীতি সুদহার ৫০ শতাংশ পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত এক বছরে নীতি সুদহার বেড়েছে দুই বেসিস পয়েন্ট।
প্রথম দফায় নীতি সুদহার বাড়ানোর পর আহসান মনসুর বলেছিলেন, মুদ্রানীতির পদক্ষেপের ফল পেতে ছয় মাস সময় লাগবে। পাঁচ মাসের ব্যবধানে শীত মৌসুমে মূল্যস্ফীতির পারদ নিচের দিকে নামল।
তবে নীতি সুদহার বৃদ্ধির প্রভাবে ব্যাংক ঋণের সুদহারও বেড়ে যাওয়ায় তা ব্যবসায়ীদের অস্বস্তিতে ফেলে। এতে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশে ঠেকেছে; যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এর আগে ২০২১ সালের মে মাসে কোভিড মহামারীর মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমেছিল।
এমন অবস্থায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ঋণের সুদহার আগের মত ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে।
মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে আসায় নীতি সুদহার আর না বাড়ানোর ইঙ্গিত বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দিয়েছেন আহসান মনসুর।
সামনে রোজা থাকায় পণ্য আমদানিতে যাতে আরও সুদহার বেড়ে যাওয়ার প্রভাব না পড়ে সেজন্য রেপো না বাড়ার কথা ভাবছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘রোজায় খরচ বেড়ে যাবে সবার, সেটি চিন্তা করে মার্চের আগে নীতি সুদহার আর বাড়াতে যাচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।’’
এর উদ্দেশ্য হল, ব্যাংকের ঋণ সুদহার যাতে আর না বাড়ে।
দুই চ্যালেঞ্জ
রপ্তানি আয়ে প্রায় ১১ শতাংশ ও রেমিটেন্সে ২৩ দশমিক ৬১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির মত স্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। সবশেষ গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিপিএম হিসাবে ২০ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্রস পদ্ধতিতে ২৫ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার।
এ পরিমাণ রিজার্ভ বাংলাদেশের চার মাসের আমদানি দায় মেটানোর সক্ষমতা রাখে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, আইএমএফ এর সঙ্গে করা ঋণ চুক্তির শর্ত মেনে পরবর্তী কিস্তি পেতে নিট রিজার্ভ আরও বাড়াতে হবে।
চতুর্থ কিস্তিতে অর্থ পেতে চারটি বিষয়ে শর্ত দিয়েছে সংস্থাটি। এরমধ্যে রয়েছে অর্থনীতির বহির্চাপ সামাল দিতে রাজস্ব আদায় জোরদার করা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি আরও সংকুচিত ভঙিতে করা, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক ও জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে সবুজ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতে নীতিমালার বাস্তবায়ন।
বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার পুরোটা বাজারমুখী করতে বর্তমান দরের চেয়ে আড়াই টাকা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
গত ডিসেম্বরে বিনিময় হার পুরোটা বাজারমুখী করার ঘোষণা দেওয়ার পর গত জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা ১২২ টাকায় স্থির আছে।
যদিও বাস্তবে ব্যাংকগুলো এ দরে ডলার পাচ্ছে না। ডলারের দর পর্যব্কেষণে প্রতিদিন দুইবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ডলার-কেনা বেচার দর ও পরিমাণ জানাতে হয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি থাকায় ব্যাংকগুলো যে দরেই ডলার কিনুক, তারা ১২২ টাকা দরই দেখিয়ে আসছে।
এই ‘অদৃশ্য’ নিয়ন্ত্রণ আগামী মুদ্রানীতির চ্যালেঞ্জের অন্যতম মন্তব্য করে বিনিময় হার পুরোটাই বাজারমুখী করার পরামর্শ বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট জাহিদ হোসেনের।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের ঘোষণা দিয়েছে গত ডিসেম্বরে। সেটি বাস্তবিক অর্থেই করা প্রয়োজন। কোনো অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ যেন না থাকে।’’
তিনি বলেন, ‘‘ব্যাংকগুলো যদি নির্দিষ্ট দরে ডলার না পায় তাহলে তো অনেকেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বন্ধ করে দিবে। যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক দৈনিক দুই বার তথ্য নিচ্ছে, তাই বিনিময় হার বাজারের উপর দর ছেড়ে দেওয়াটাই উচিত হবে।’’
এটি না হলে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় অস্বচ্ছতা ও অনৈতিক চর্চায় জড়িয়ে যেতে পারে অনেক ব্যাংক বলে তার আশঙ্কা।
তবে ব্যাংক ঋণের খরচ যাতে আরও না বাড়ে সেজন্য নীতি সুদহার আর না বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
সরকার বদলের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালকের দায়িত্বে আসা এ অর্থনীতিবিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘শীতকালীন মৌসুমি সবজির যথেষ্ট সরবরাহে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করায় সার্বিক মূল্যস্ফীতিও কমছে। তাই আর পলিসি রেট বাড়ানোর প্রয়োজন নেই আপাতত।’’
এসময়ে বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের নজরদারি বাড়ানোর আগের চ্যালেঞ্জ মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সাপ্লাই সাইডটা সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। সামনে রোজা, এই সময়ে বাজারে পণ্য বাড়াতে শুল্কে ছাড় দিতে হবে। সেই ছাড়ের প্রভাব যেন ভোক্তা পর্যায়ে পায় তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।’’
আরও পড়ুন
২০২৩-২৪: চূড়ান্ত হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪.২২%, চার বছরের সর্বনিম্ন