আইন সংশোধন করে মূল্যবৃদ্ধির ক্ষমতা হাতে নিয়ে প্রথম ধাপেই এক লাফে গ্যাসের দাম কিছু ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১৭৮ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার, যা এযাবৎ কালের সর্বোচ্চ মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা।
দাম বাড়ানোর কারণ হিসাবে ভর্তুকির চাপ থেকে বেরিয়ে আসা এবং বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার যে যুক্তি সরকার দিচ্ছে, তার যথার্থতা স্বীকার করলেও এক ধাপে এতটা বৃদ্ধি মানতে পারছেন না গ্রাহকরা।
শিলপ ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও তার প্রভাবে পণ্যমূল্য বেড়ে শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের সঙ্কট আরও বাড়িয়ে দেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব বলছে, অযৌক্তিকভাবে ব্যয় বৃদ্ধি করে সেই ব্যয়কে অজুহাত হিসাবে দেখিয়ে দামটা বাড়ানো হচ্ছে। দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোও এখানে অকার্যকর।
বুধবার জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপন জারি করে শিল্প ও বাণিজ্যক ব্যবহার এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়।
গৃহস্থালিতে রান্নার গ্যাস এবং গাড়ি চালাতে ব্যবহৃত সিএনজির দাম এই দফায় বাড়ানো হয়নি। সার উৎপাদন ও চা শিল্পকেও বাদ রাখা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে দেখা যায়, জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম আগের ৫ টাকা ০২ পয়সা থেকে ১৭৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ বাড়িয়ে ১৪ টাকা করা হয়েছে। ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রতি ইউনিট ১৬ টাকা থেকে ৮৭ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে।
বৃহৎ শিল্প খাতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে ১৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ টাকা, মাঝারি শিল্পে প্রতি ইউনিট বর্তমান ১১ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে ১৫৪ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ টাকা এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে বর্তমান ১০ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে ১৭৮ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে।
হোটেল ও রেস্তোরাঁর মতো বাণিজ্যিক খাতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম আগে ছিল ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা। এখন তা ১৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়েছে।
তবে আগের মতোই চা শিল্পের জন্য প্রতি ইউনিট ১১ টাকা ৯৩ পয়সা, সিএনজি স্টেশনের জন্য ৪৩ টাকা, গৃহস্থালির মিটারের জন্য প্রতি ইউনিট ১৮ টাকা, এক মুখের চুলার জন্য মাসিক ৯৯০ টাকা, দুই মুখের চুলার জন্য মাসিক ১০৮০ টাকা রাখা হয়েছে।
গত জুন মাসে নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী বর্তমানে গ্যাসের পাইকারি দাম ১১ টাকা ৯১ পয়সা। ফলে নতুন করে পাইকারি মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা না থাকায় নতুন এই মূল্যবৃদ্ধির মুনাফা যাবে ছয়টি বিতরণ কোম্পানির কাছে।
এবার সর্বোচ্চ মূল্যবৃদ্ধি ঘটলেও গ্যাসের গড় মূল্য ইউনিট প্রতি কতটা বাড়ল, সরকারের পক্ষ থেকে তা প্রকাশ করা হয়নি। দিনভর জ্বালানি বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার কাছে এবিষয়ে জানতে চাইলেও তারা কেউ জানাতে পারেননি।
ভর্তুকি কমাতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হচ্ছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও বর্ধিত মূল্য থেকে কত টাকা আয় হতে পারে, বর্তমানে কতটা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে বা ভর্তুকির চাপ কতটা কমতে পারে, সে বিষয়েও স্পষ্ট কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি।
সকালে প্রজ্ঞাপন জারির পর রাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক ব্যাখ্যায় বলা হয়, বর্তমান বৈশ্বিক বিশেষ জ্বালানি পরিস্থিতিতে ও রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী সব ধরনের জ্বালানির মূল্যে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এছাড়া, জ্বালানি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যয়, যেমন বিমা খরচ, ঝুঁকি ব্যয়, ব্যাংক সুদ, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকা দুর্বল হওয়ায় সামগ্রিকভাবে জ্বালানি খাতে ব্যয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি মূল্যও অস্বাভাবিক পরিমাণে বেড়ে যাওয়ায় এ খাতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এদিন জাতীয় সংসদে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে ভর্তুকি কমানোর পক্ষে অবস্থান জানান।
ডলার সংকটের মধ্যে আইএমএফের ঋণ পেতে সংস্থাটির শর্ত মেনে বিদ্যুতের এবং এরপর গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে সংসদে দাবি করেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।
তার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধের বাজারে জ্বালানির দাম চড়ে যাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, “তারা (ব্যবসায়ী) যদি নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ চায়, তাহলে যে মূল্যে কিনে আনব, সেই মূল্যই তাদের দিতে হবে। এখানে ভর্তুকি দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।”
বেশ কিছু দিন ধরে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার মধ্যে ব্যবসায়ীরা এমনও বলেছিলেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুতের জন্য তার দাম বেশি দিতে প্রস্তুত।
তবে এখন ব্যবসায়ীরা বলছেন, এতটা মূল্য বৃদ্ধি তারা প্রত্যাশা করেননি।
পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কারখানাগুলোতে কাজ কমে গেছে। এই পরিস্থিতিতে এটা মূল্য বৃদ্ধির সঠিক সময় নয়। আমরা ২২ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর কথা মেনে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ১৬ টাকা থেকে এভাবে ৩০ টাকা করে ফেলার ইতিহাস আর আছে নাকি?
“এর আগে তেলের দাম বাড়ল, তারপর গ্যাসের দাম বাড়ল, তারপর বিদ্যুতের দাম বাড়ল, এখন আবার গ্যাসের দাম বাড়ল। এভাবে বাড়তে থাকলে যে উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে, তা দিয়ে ক্রেতারা পণ্য নেবে নাকি?”
তিনি ধারণা দেন, গত এক বছরে উৎপাদন খরচ ৩৩ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। এখন আবার গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি বাবদ আরও ১৪/১৫ শতাংশ উৎপাদন খরচ বেড়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, “গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আমাদের আপত্তি আছে। অন্যদের না বাড়িয়ে কেবল শিল্প খাতে দাম বাড়াতে গিয়ে শিল্পের উপর প্রভাব বেশি পড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে এভাবে ২০০ শতাংশ মেনে নেওয়া যায় না। বাড়ানোটা সহনীয় হতে হবে। ভ্যাট ট্যাক্স কমালেও ইউনিট প্রতি দাম ২০ টাকার মধ্যে রাখা যেত।”
তবে বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, “আমরা সিরামিক খাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস চাই। সারা বিশ্বেই জ্বালানির দাম বেড়েছে। সুতরাং বিশ্ববাজারের কথা চিন্তা করে আমাদের এই দাম মেনে নিতে হবে। তবে আমরা চাই আমাদের অসুবিধা হলেও গ্যাস যেন নিরবিচ্ছিন্ন থাকে।”
তিনি বলেন, সিরামিক খাতে ১৫ পিএসআই চাপে গ্যাসের প্রয়োজন হয়। এখন তা পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য এলএনজি আমদানি করে হলেও চাপ বাড়াতে সরকারকে বলছেন তারা।
দাম বৃদ্ধি নিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যায় বিশ্ববাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) উচ্চ মূল্যকে কারণ দেখানো হয়েছে।
‘দুর্নীতির ভার জনগণের উপর’
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম মনে করেন, জ্বালানি সংক্রান্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও দুর্নীতির ফলে বেড়ে যাওয়া ব্যয়ের ভার জনগণের ওপর চাপাতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির এধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভোক্তার অধিকার রক্ষায় সরব এই অধ্যাপক মনে করেন, মূল্যবৃদ্ধির সমালোচনা করার আগে ব্যয়বৃদ্ধির অন্যায্য উদ্যোগগুলো প্রতিরোধে আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন।
বুধবার রাতে এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “মূল্য বৃদ্ধি হলে আমরা চিৎকার করছি। এটা একটা বিভ্রান্তিকর বিষয়। মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে হবে, নাকি ব্যয় বৃদ্ধি ঠেকাতে হবে, সেটা এখন আলোচনার বিষয়।”
হতাশা প্রকাশ করে অধ্যাপক শামসুল বলেন, “ব্যয়ের ক্ষেত্রে নানা ধরনের অসঙ্গতির কথা তুলে ধরলেও কেউ আমলে নিচ্ছে না। ব্যয় বৃদ্ধি করে লোকসান দেখাচ্ছে। সেই লস পূরণ করতে সরকার ভর্তুকি দিয়েছিল, এখন দেবে না। এখন দাম বৃদ্ধির খাঁড়া সরাসরি যাবে জনগণের উপর।”
এলএনজি আমদানি, দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন ব্যয়, দেশের অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক গ্যাস উত্তোলন প্রতিষ্ঠানগুলো (আইওসি), দেশীয় কোম্পানির উৎপাদন ব্যয়, ভ্যাট, ট্যাক্স, কোম্পানিগুলোর মুনাফা, সঞ্চালন, অবকাঠামো নির্মাণ হতে শুরু কবে পুরো সরবরাহ প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে বলে দাবি করেন ক্যাবের উপদেষ্টা।
“কতটা ব্যয় হওয়া যৌক্তিক আর কতটা অযৌক্তিক, কতটা বেশি মুনাফা করা হচ্ছে, যৌক্তিক রাজস্বের চেয়েও সরকার কতটা বেশি রাজস্ব নিচ্ছে- এই সবগুলো বিশ্লেষণ করে এই অন্যায় ব্যয় বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যেটাকে প্রতিযোগিতা আইনের ভাষায় লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বৃদ্ধি বলা হয়, সেটা বন্ধ করার জন্য এখন ভোক্তা আন্দোলন বিকল্প নেই।”
এগুলো দেখভালের জন্য জ্বালানি বিভাগ, প্রতিযোগিতা কমিশন, রেগুলেটরি কমিশন থাকলেও সেগুলোকে এখন ‘সম্পূর্ণ অকার্যকর’ বলে মনে করেন তিনি।
“ক্যাবের পক্ষ থেকে গত দুই যুগ ধরে বলে আসছি যে, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত সর্বনাশার দিকে যাচ্ছে। এখন শিল্প গ্রাহক-বাণিজ্যিক গ্রাহকদের যদি হুঁশ হয়, তারা যদি প্রতিরোধ করে এগিয়ে আসে, তাহলেই কিছু হবে।”