টানেল ধরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে যানবাহন আনোয়ারা, বাঁশখালী হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত যাবে। কক্সবাজারের মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামে নতুন শিল্প উদ্যোগকে সারাদেশের সাথে যুক্ত করবে এই টানেল।
Published : 28 Oct 2023, 12:02 AM
খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চলে গেছে সড়ক। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার নতুন এক স্মারক- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল।
নদীর তলদেশে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকায় নির্মিত এই টানেল দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম।
শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে খুলবে এই টানেলের দ্বার। এজন্য টানেলের দুই প্রান্তে সাজ সাজ রব।
পতেঙ্গা প্রান্তে গোল চত্বর, আউটার রিং রোড, বিমান বন্দর সড়ক ও পতেঙ্গা সৈকত সংলগ্ন এলাকা সেজেছে জাতীয় পতাকায়। গোল চত্বরে 'জয় বাংলা' খচিত লাল সবুজ বোর্ড শোভা পাচ্ছে।
আনোয়ারা প্রান্তেও শেষ সময়ের তোড়জোড় চলছে। টোল প্লাজায় টোল আদায়ের মহড়াও হয়ে গেল বৃহস্পতিবার।
এর আগে টানেলের পতেঙ্গা থেকে আনোয়ার প্রান্ত পর্যন্ত পরিদর্শন করেন স্থানীয় প্রশাসন ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা।
পতেঙ্গা প্রান্তে টানেলের প্রবেশ পথের শুরুতেই নামফলকে বড় করে লেখা 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল'। নামফলক পেরিয়ে টানেলে ঢুকতেই এক সোনালী আলোর ঝলকানি। প্রবেশ মুখের ছাউনি ও টানেলের ভেতরের বাতি- দুইয়ে মিলে তৈরি হয়েছে এমন সোনালী আভা।
টানেলের পথ ধরে দ্রুত গতিতে গাড়ি এগিয়ে যেতেই প্রথমবার টানেলের প্রবেশের সুযোগ পাওয়া প্রায় সবাই ছবি তুলতে ও ভিডিও করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
টানেল ধরে গাড়ি যতই এগিয়ে যায় তত যেন বিস্ময় বাড়ে। নদীর তলদেশ থেকে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরে এই পথ যে নির্মাণ করা হয়েছে, তা বোঝাই যায় না।
পথের দুই পাশে সিকিউরিটি সিস্টেম, ফায়ার হাইড্রেন্ট, সিসি ক্যামেরা, লাল সবুজ আলো, জরুরি পরিস্থিতিতে এক টিউব থেকে অন্য টিউবে যাওয়ার পথ- এসব দেখতে দেখতে এগিয়ে চলে গাড়ি বহর।
যতটা সাবলীল গতিতে গাড়ি এগিয়ে চলেছে নির্মাণ কাজ ততটা মসৃণ ছিল কী?
নদীর তলদেশে দেশের এই প্রথম টানেল নির্মাণের শুরুর চ্যালেঞ্জ বিষয়ে জানালেন প্রকল্প পরিচালক হারুন অর রশিদ চৌধুরী।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "নদীর তলদেশ খনন করতে বিদেশ থেকে আনা হয় টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম)। উত্তর পাশে মাত্র ৫ শতাংশ আগানোর পর দেখা যায়, মাটির নিচের ও উপরের অংশের ভিন্নতার কারণে টিবিএম নির্ধারিত পথের উপরে উঠে যাচ্ছে। এতে ডিরেকশন চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছিল। এরপর বিদেশি বিশেষজ্ঞ দিয়ে সেটা সমাধান করা হয়।
“প্রথম টিউবের কাজ মাঝে টেকনিক্যাল কারণে প্রায় ৪ মাস বন্ধ ছিল। প্রথম টিউবের কাজ শেষ হয় ১৭ মাসে। তবে এটার অভিজ্ঞতা কাজে লাগে দ্বিতীয় টিউবে। সেটার কাজ শেষ হয় ১০ মাসে।"
দেশের প্রথম টানেল নির্মাণের এ অভিজ্ঞতাকে বড় অর্জন হিসেবে দেখছেন প্রকল্পটির পরিচালক।
তিনি বলেন, “আমাদের দেশিয় ৪০ জন প্রকৌশলী এর বিভিন্ন অংশে কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে তরুণ যে প্রকৌশলীরা আছেন উনাদের জন্য এটা বড় এক সুযোগ। এ অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে দেশের এরকম বড় প্রকল্পগুলোতে কাজে লাগতে পারবেন।”
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মো. ফখরুজ্জামান বলেন, “এই টানেল নির্মাণ অত সহজ ছিল না। অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগ নিয়েছেন বলেই এটি সম্ভব হয়েছে।
“কর্ণফুলী অত্যন্ত খরস্রোতা এক নদী। এটা (টানেল নির্মাণ) আমাদের দেশিয় প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্টদের সক্ষমতার এক প্রকাশ।”
লুসাই পাহাড় থেকে নেমে আসা নদী কর্ণফুলীর দুই প্রান্তকে যুক্ত করতে টানেল নির্মাণে প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। এরপর প্রায় ১৩ বছর পেরিয়ে গেছে।
অবশেষে খুলতে যাচ্ছে টানেলের দুয়ার। যুক্ত হচ্ছে নদীর দুই প্রান্ত।
টানেল ধরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে যানবাহন আনোয়ারা, বাঁশখালী হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত যাবে। কক্সবাজারের মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামে নতুন শিল্প উদ্যোগকে সারাদেশের সাথে যুক্ত করবে এই টানেল।
আনোয়ারা প্রান্ত থেকে আবার যখন গাড়িবহর টানেল ধরে ফিরছিল ততক্ষণে প্রথম যাত্রার বিস্ময় অনেকটা কেটেছে। টানেল আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব।
কর্ণফুলীর দুই তীরকে যুক্ত করা এই টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের ব্যয় ৪ হাজার ৬১৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা এবং চীন সরকারের অর্থ সহায়তা ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা। যার মধ্যে মূল টানেল নির্মাণে শতভাগ খরচ বহন করছে চীন সরকার।
মূল টানেল ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ। যার মধ্যে টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে মোট ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোড আছে।
নদীর তলদেশ থেকে টানেলের সর্বোচ্চ গভীরতা ৩১ মিটার। টানেলে আছে বিপরীতমুখী দুটি টিউব।