Published : 23 Jun 2023, 10:33 PM
মৌসুমের শেষ সময়ে হালদায় আশাতীত ডিম মিললেও রেনু উৎপাদনে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। হ্যাচারিগুলোতে পর্যাপ্ত কুয়া না থাকায় এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাসহ নানা অবহেলায় নষ্ট হয়েছে অনেক ডিম।
এবার হালদায় গত দুই বছরের তুলনায় ডিম মিলেছে দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু হ্যাচারিতে পর্যাপ্ত কুয়া না থাকা, কুয়ায় ধারণক্ষমতার বেশি ডিম রাখা, কুয়ার রক্ষণাবেক্ষণ ঠিক না থাকা, মশারি দিয়ে কুয়া ঢেকে রাখা এবং ঠিকমত শাওয়ারিং না করায় এই সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
রেণু উৎপাদনকারীরাও স্বীকার করছেন, কুয়াতে অতিরিক্ত ডিম দেওয়ায় কিছু রেণু নষ্ট হয়েছে।
মৎস্য বিভাগ বলছে, সরকারি চারটি হ্যাচারিতে কুয়ার সংখ্যা দ্বিগুণ করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী মৌসুমের আগেই কাজ শেষ করা হবে।
রোববার রাত সোয়া ১২টার দিকে চলতি মৌসুমের শেষ জোয়ারে (পূর্ণিমা বা অমাবস্যা তিথিতে) চলাকালে হালদায় ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মা মাছ।
সেদিন সকালে নমুনা ডিম ছাড়ায় সারাদিন নৌকা নিয়ে নদীতেই ছিল ডিম সংগ্রহকারীরা। দিনভর অপেক্ষা শেষে মধ্যরাতেই ডিম সংগ্রহ শুরু করে তারা।
২৮৫টি নৌকা নিয়ে এবার ডিম সংগ্রহকারীরা ডিম সংগ্রহ করেছে। নদীর বিভিন্ন অংশের ডিম সংগ্রহকারীরা জানিয়েছেন নৌকা প্রতি ৩-৫ বালতি ডিম পেয়েছেন তারা। কেউ কেউ ৮-১০ বালতিও পেয়েছেন।
ভোরের দিকে আরো ডিম পেলেও কুয়া স্বল্পতার কথা বিবেচনা করে তা সংগ্রহ করতে পারেননি তারা।
কত কুয়া, কত ডিম
হালদা পাড়ের হাটহাজারী উপজেলার মদুনাঘাট, মাছুয়াঘোনা ও শাহমাদারি এলাকায় এবং রাউজান উপজেলার মোবারকখীল এলাকায় চারটি সরকারি হ্যাচারি আছে।
হালদা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ) এর হ্যাচারিটি রাউজান উপজেলার পশ্চিম গহিরাতে।
সরকারি চার হ্যাচারির মধ্যে হাটহাজারীর তিনটিতে কুয়া আছে ১১৭টি। রাউজানের মোবারকখীর সেই হ্যাচারিতে কুয়া সংখ্যা ৫০টি। এই ১৬৭টি কুয়ার প্রতিটিতে গড়ে ৫ বালতি করে, প্রতি বালতিতে ১০ কেজি করে মোট ৫০ কেজি ডিম ছাড়া যায়।
রেণু উৎপাদনের জন্য এবার মদুনাঘাটের হ্যাচারিতে ১ হাজার ২৮০ কেজি, মাছুয়াঘোনাতে ২ হাজার ৪০০ কেজি, শাহমাদারিতে ১ হাজার ৯০০ কেজি এবং মোবারকখিলে ১ হাজার ৫৪০ কেজি ডিম ছাড়া হয়।
সে হিসেবে চার হ্যাচারিতে মোট ৭ হাজার ১২০ কেজি ডিম রাখা হয়েছে।
ডিম সংগ্রহকারীরা জানান, হ্যাচারিগুলোতে সব কুয়া ডিম রাখার মত উপযুক্ত নয়। সব কুয়া ভালো থাকলে চার সরকারি হ্যাচারিতে মোট ৮ হাজার ৩৫০ কেজি ডিম রাখা যেত।
আইডিএফ এর হ্যাচারি ব্যবস্থাপক আবদুল্লাহ আন নুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের হ্যাচারিতে ১৫টি কুয়ায় ১ হাজার ৩০০ কেজি ডিম সংগ্রহ হয়। হালদার দুই পাড়ের ১০টি মিনি হ্যাচারিতে আরও ১ হাজার ১৯০ কেজি এবং ৩০ জন উদ্যোক্তার ৭১টি মাটির কুয়াতে ৩ হাজার ৪৩০ কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছে।”
সরকারি হ্যাচারি এবং বেসরকারি হ্যাচারি ও ব্যক্তিগত মাটির কুয়া মিলে মোট ডিম সংগ্রহ হয়েছে ১৩ হাজার ৪০ কেজি।
মাছুয়াঘোনা এলাকার ডিম সংগ্রহকারী শওকত আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার আমাদের তিন নৌকায় ৯ বালতি ডিম পেয়েছি। তারপর এক জালে এক বালতি করে ডিম উঠলেও আর ধরিনি। কারণ হ্যচারিতে আমাদের জন্য বরাদ্দ কুয়াতে এর বেশি ডিম ধরবে না।
“ডিম পাওয়ায় অনেকে না ছেড়ে, ধরে নিয়ে এসেছিল। ডিম আছে কিন্তু কুয়া কম। মাছুয়াঘোনা হ্যাচারিতে কুয়ায় ধারণক্ষমতার বেশি ডিম দেওয়ায় অনেক কুয়ার ডিম নষ্ট হয়েছে। আমাদের ভুল আছে, তবে বেশি কুয়া থাকলে এ অবস্থা হত না।”
গড়দুয়ারা এলাকার ডিম সংগ্রহকারী কামাল সওদাগর বলেন, “৫টি নৌকা নিয়ে ২৫ বালতি ডিম পেয়েছি। গত দুই বছরের তুলনায় বেশি ডিম হয়েছে এবার।
আমি আইডিএফের হ্যাচারিতে ডিম রেখেছি। আশাকরি ৫-৬ কেজি রেণু পাব। এখানে ব্যবস্থাপনা ভালো।”
২০২০ সালে সরকারি মৎস্য বিভাগের হিসেবে হাটহাজারীতে ব্যক্তি উদ্যোগের ৭৩টি এবং রাউজানে ৬৮টি মাটির কুয়া ছিল। তবে চলতি বছর আইডিএফ এর অনুসন্ধানে হাটহাজারীতে ১২টি এবং রাউজানে ৫০টি মাটির কুয়ার সন্ধান মিলেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভোগের অধ্যাপক ও হালদা রির্সাচ কেন্দ্রের সমন্বয়ক মনজুরুল কিবরীয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০১৬-১৭ সালে মাটির কুয়া কমে হয়েছিল ১০০টির মত। এরপর আইডিএফ উদ্যোগ নিয়ে কিছু কুয়া সংস্কার করলে তা বেড়ে ১৬৭ হয়।
“কিন্তু হালদার পাড়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণের সময় বেশ কিছু মাটির কুয়া ধ্বংস হয়েছে। কারণ বেড়িবাঁধ নদীর পাড়ে য়ে অংশ দিয়ে গেছে সেখানেই ছিল কুয়াগুলো।”
ব্যবস্থাপনার ঘাটতি
মদুনাঘাটের বড়ুয়া পাড়ায় সরকারি হ্যাচারির কুয়ার তত্ত্বাবধায়ক মো. সেলিম ছাগল পালতেন। সোমবার ভোরে মাছের ডিম সংগ্রহ শেষে হ্যাচারিতে এসে কুয়ার ভেতর ছাগলের পয়ঃবর্জ্য দেখতে পান ডিম সংগ্রহকারীরা।
রতন বড়ুয়া নামের এক ডিম সংগ্রহকারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যাকে দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছে সেই কুয়ার মধ্যে ছাগল পেলেছে। ছাগলের ময়লা পাশের পুকুরে গিয়ে পড়েছে।
“সেই পানিতে ডিম রাখায় তিন-চারজনের ডিম নষ্ট হয়েছে। অভিযোগ করার পর মৎস্য বিভাগ থেকে সরকারি লোকজন এসে দেখেছে।”
হাটহাজারীর সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফারুক ময়েদুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যাকে দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সে ওখানে ছাগল রাখে। তার উচিৎ ছিল ডিম নিয়ে আসার আগেই সেগুলো পরিষ্কার করা। অজ্ঞতার কারণে সেটা হয়েছে। পরে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে।”
এবার হ্যাচারি গুলোর অবস্থা অন্যবারের তুলনায় ভালো বলে দাবি করেন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা।
শাহমাদারি ও মাছুয়াঘোনা হ্যাচারিতেও কয়েকটি কুয়ার ডিম নষ্ট হওয়ার কথা জানিয়েছে স্থানীয়রা।
হালদা রির্সাচ কেন্দ্রের সমন্বয়ক মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, “কুয়ার সংখ্যা বাড়াতে আমরা বারবার বলেছিল। এবার মা মাছ অনেক বেশি ডিম দিয়েছে। কুয়া বেশি থাকলে ডিম সংগ্রহকারীরা নদী থেকে ডিম ছেড়ে দিয়ে ফিরত না।
“কুয়া কম থাকায় বিদ্যমান কুয়াতে ডিমের ওভার স্টকিং করেছেন রেণু উৎপাদনকারীরা। কোথাও কোথাও দ্বিগুণ ডিমও রেখেছেন। এতে রেণু মারা গেছে।”
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী কুয়া সংকটের কথা স্বীকার করে ডিম নষ্ট হওয়ার পেছনে রেণু উৎপাদনকারীদের অসচেতনতাকে দায়ী করে বলেন, “বারবার বলার পরও উনারা মান্ধাতার আমলের মত কুয়ায় মশারি টেনে ঢেকে রাখেন। কুয়াতে অতিরিক্ত ডিম দেন এবং ঠিকমত শাওয়ারিং করেন না।
“কুয়ার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য আমরা ইতোমধ্যে প্রকল্প নিয়েছি। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু হবে। আশা করি আগামী বছরের আগেই সরকারি চার হ্যাচারির প্রত্যেকটিতে কুয়ার সংখ্যা দ্বিগুণ করা সম্ভব হবে।”
ডিমের হিসেব হয়নি, রেণু বিক্রি চলছে
ডিম সংগ্রহ ও রেণু উৎপাদন নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি তথ্যে ফারাক হওয়ায় সরকারি উদ্যোগে দুই বছর আগে কমিটি গঠন করা হয়েছে ডিমের পরিমাণ নির্ধারণে।
সোমবার হালদায় মা মাছ ডিম ছাড়ার পর সেই রাতে কমিটির সদস্যরা নদীতে নৌকায় নৌকায় গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর শুক্রবার সকালে কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন হ্যাচারিতে যায় রেণুর উৎপাদনের তথ্য জানতে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, “আমরা এ নিয়ে হ্যাচারিতে তথ্য সংগ্রহে এসেছি। বিকেলে বৈঠকে ডিমের পরিমাণ নির্ধারণ হলে তখন এ বিষয়ে তথ্য জানাতে পারব।”
২০২২ সালে হালদা নদী থেকে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কেজি এবং ২০২১ সালে সাড়ে ৮ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করেছিল সংগ্রহকারীরা।
২০২০ সালে হালদা থেকে সাড়ে ২৫ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করার কথা জানিয়েছিল জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়, যা ছিল ২০০৬ সালের পর সর্বোচ্চ। ২০০৬ সালে ৩২ হাজার ৭২৪ কেজি ডিম পাওয়া যায়।
২০১৯ সালে প্রায় ১০ হাজার কেজি ডিম মিলেছিল। এর আগে ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়।
হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ১৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে ডিম মেলে ৭৩৫ কেজি, ২০১৫ সালে ২৮০০ কেজি; ২০১৪ সালে ১৬৫০০ কেজি, ২০১৩ সালে ৪২০০ কেজি এবং ২০১২ সালে ২১২৪০ কেজি ডিম মিলেছিল হালদায়।
শুক্রবার বিকেলে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন রেণুর দাম নির্ধারণের কথা থাকলেও শুক্রবার সকাল থেকেই রেণু বিক্রি শুরু হয়েছে বলে উৎপাদনাকারীরা জানিয়েছেন।
রেণু বিক্রেতা কামাল সওদাগর বলেন, “এবার মৌসুমের শেষ দিকে হালদায় মাছ ডিম ছাড়ে। অনেকে অপেক্ষায় থাকলেও পুকুর প্রস্তুত করেনি। আবার দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে যেসব মাছের খামারিরা রেণু কিনতে আসেন তারা অনেকেই রেণু তার আগেই ছেড়েছেন তাদের পুকুরে।
“তবে যারা মা মাছের চাষ করেন তারা অপেক্ষায় ছিলেন। একারণে এবার ক্রেতা সংখ্যা কিছুটা কম।”
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, “ইতিমধ্যে রেণু বিক্রি শুরু হয়েছে। শাহমাদারি ও মোবারকখীলে রেণু বিক্রি হতে দেখেছি। গড়ে ৮০-৯০ হাজার টাকায় এক কেজি রেণু বিক্রি হচ্ছে।”