স্ত্রী আর চার সন্তানকে হারিয়ে ওমানপ্রবাসী নারায়ণ দাশ এখন বাকরুদ্ধ।
Published : 08 Nov 2023, 09:32 PM
এক শ্মশানে পাশাপাশি সাজানো হয়েছে পরিবারের বড় তিন সদস্যের তিনটি চিতা। আর ছোট তিন শিশুকে সমাহিত করার জন্য খোঁড়া হয়েছে মাটি। এমন দৃশ্য দেখে চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি মোহাম্মদপুর গ্রামের বাসিন্দারা।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সাতজনের মধ্যে মঙ্গলবার ছয়জনের শেষকৃত্য হয়েছে চন্দনাইশ উপজেলার জোয়ারা ইউনিয়নের এই গ্রামে। একই উপজেলার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নে হয়েছে অন্যজনের শেষকৃত্য।
মঙ্গলবার হাটহাজারীতে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়কে বাস ও অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ যায় এই সাতজনের। তাদের মধ্যে ছয়জন এক পরিবারের সদস্য; অন্যজন তাদের নিকট আত্মীয়।
নিহতরা হলেন- চন্দনাইশ উপজেলার পূর্ব জোয়ারা মোহাম্মদপুর গ্রামের রীতা দাশ (৩৫), তার দুই মেয়ে শ্রাবন্তী দাশ (১৬), বর্ষা দাশ (৭), দুই যমজ ছেলে দিগ দাশ (৪), দিগন্ত দাশ (৪), ভাশুরের ছেলে বিপ্লব দাশ (২৫), রীতার স্বামীর কাকাত বোন চিনু দাশ (৫০), তার বাড়ি সাতবাড়িয়ায়।
নিহতদের মধ্যে শ্রাবন্তী ছিল বাক প্রতিবন্ধী, আগামী বছর তার এসএসসি দেওয়ার কথা ছিল। আর বর্ষা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত।
এ দুর্ঘটনায় অটোরিকশার চালক বিপ্লব মজুমদার (২৮) এবং নিহত চিনু দাশের ছেলে বাপ্পা দাশও (৩০) আহত হয়েছেন। তারা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
রীতা দাশের স্বামী নারায়ণ দাশ ওমান প্রবাসী। চার সন্তানকে নিয়ে তিনি চন্দনাইশের পূর্ব জোয়ারায় শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন।
১১ দিন আগে ঠাকুরমা মারা যাওয়ায় তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে চার সন্তান ও শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের নিয়ে ফটিকছড়ি শাহ নগর এলাকায় বাবার বাড়ি যাচ্ছিলেন রীতা। তাদের আনতে বাড়ির কাছের অটোচালক বিপ্লবকে পাঠানো হয়েছিল নতুনপাড়া এলাকায়। পথে ছেলে বাপ্পাকে নিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেন চিনু দাশ।
কিন্তু পথে হাটহাজারী উপজেলার মীর্জাপুর ইউনিয়নের চাড়িয়া এজতেমা মাঠ এলাকায় তাদের অটোরিকশা দুর্ঘটনায় পড়ে। ঘটনাস্থলেই সাতজনের মৃত্যু হয়।
বুধবার দুপুরে মোহাম্মদপুর গ্রামের সামাজিক শ্মশানে যখন রীতাদের ছয়জনের শবদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন প্রতিবেশীরা ছাড়াও আশেপাশের গ্রামের লোকজন এবং জনপ্রতিনিধিরা জড়ো হয়েছিলেন সেখানে। চিতা সাজানোর সময় সেখানে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এক সাথে তিনটি চিতায় তিন স্বজন, আর তিন শিশুর সমাহিত করার দৃশ্য স্থানীয়রা আগে কখনও দেখেননি।
রীতা দাশের ভাশুর বাবুল দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, মঙ্গলবার রাতে মরদেহগুলো তাদের গ্রামের বাড়ি নিয়ে লাশবাহী ফ্রিজার গাড়িতে রাখা হয়। স্ত্রী-সন্তানের করুণ মৃত্যুর খবর শুনে ওমান থেকে দেশে ফিরে আসেন রীতার স্বামী নারায়ণ দাশ। বুধবার সকাল ১১টার দিকে তিনি বাড়ি পৌঁছানোর পরই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
বাবুল জানান, ধর্মীয় রীতিনীতি সম্পন্ন করে সামাজিক শ্মশানে বেলা ১টার দিকে রীতা ও বড় সন্তান শ্রাবন্তী ও বিপ্লবের শবদেহ চিতায় তোলা হয়। মেঝ মেয়ে বর্ষা ও দুই যমজ সন্তান দিগ, বিজয় সমাহিত করা হয়।
নিহতদের মধ্যে বিপ্লব দাশ হলেন বাবুল ও নারায়ণের মেজ ভাই শম্ভু দাশের বড় ছেলে। বিপ্লবের মুখাগ্নি করেন তার ছোট ভাই। আর নারায়ণ তার স্ত্রী রীতা ও সন্তান শ্রাবন্তীর মুখাগ্নি করেন।
আর বাবুলদের কাকাত বোন চিনু দাশের শেষকৃত্য হয় তার বাড়ি সাতবাড়িয়া ইউনিয়নে।
বাবলু বলেন, “আমার ভাইয়ের সাজানো সংসারটা নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। তার সবকিছুই শেষ। কিছুই রইল না। সকালে বাড়ি ফিরে দু্ই যমজ সন্তানের মুখ দেখলেন, কান্নায় ভেঙে পড়লেন। স্ত্রী-সন্তানের শেষ কাজ করে এখন বাকরুদ্ধ প্রায়। কারো সাথেই কোনো কথা বলছে না।”
বিপ্লবের বাবা শম্ভু দাশ দীর্ঘদিন ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত, বড় ছেলেকে হারিয়ে তিনিও পাগলপ্রায়।