"ফোন করলাম, পুলিশ ধরে বলল থানায় আসেন…অ্যাকসিডেন্টের খবর পেয়ে এখানে ছুটে এলাম,” বলেন সবিতা দাশ।
Published : 07 Nov 2023, 08:37 PM
হাটহাজারী পৌর সদরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হোসেন বীর প্রতীক অডিটরিয়ামের বারান্দায় ব্যাগে সারি করে রাখা সাতটি মরদেহ। পাশেই নির্বাক বসে ছিলেন সবিতা দাশ। তার দুই চোখে অশ্রু ঝরলেও কান্নার ছিল না কোনো শব্দ।
মরদেহগুলো তার অতি আপনজন- মেয়ে রীতা দাশ, চার নাতি-নাতনি আর দুই নিকটাত্মীয়ের। যাদের নিয়ে হয়ত কিছুক্ষণ পরই আনন্দে মেতে উঠতেন, এখন তাদের হারিয়ে কথা বলারও ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন সবিতা।
স্বামী প্রবাসে থাকায় চার সন্তান আর পরিবারের ব্যস্ততায় অনেক দিন বাবার বাড়ি যেতে পারেননি রীতা দাশ। ঠাকুরমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কারণে এক বছরের বেশি সময় পর সুযোগ আসে বাবার বাড়ি যাওয়ার। কিন্তু সন্তানদের নিয়ে সেই যাত্রাই হয়ে গেল রীতার শবযাত্রা।
মঙ্গলবার চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে চার সন্তান ও দুই নিকটাত্মীয়সহ মারা যান রীতা।
মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে উপজেলার মীর্জাপুর ইউনিয়নের চাড়িয়া ইজতেমা মাঠ সংলগ্ন এলাকায় ফটিকছড়িমুখী একটি অটোরিকশার সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বাসের সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই মারা যান সাতজন।
নিহতরা হলেন- চন্দনাইশ উপজেলার পূর্ব জোয়ারা মোহাম্মদপুর গ্রামের রীতা দাশ (৩৫), তার দুই মেয়ে শ্রাবন্তী দাশ (১৬), বর্ষা দাশ (৭), দুই যমজ ছেলে দিগ দাশ (৪), দিগন্ত দাশ (৪), ভাসুরের ছেলে বিপ্লব দাশ (২৫), রীতার স্বামীর কাকাত বোন চিনু দাশ (৫০)।
নিহতদের মধ্যে বাক প্রতিবন্ধী শ্রাবন্তী আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষার্থী, আর বর্ষা পড়ত তৃতীয় শ্রেণিতে।
এ দুর্ঘটনায় অটোরিকশার চালক বিপ্লব মজুমদার (২৮) ও নিহত চিনুর ছেলে বাপ্পা দাশ (৩০) আহত হয়েছ্নে। তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
দুর্ঘটনার পর পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস লাশ উদ্ধার করে হাটহাজারী পৌর সদরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হোসেন বীর প্রতীক অডিটরিয়ামের বারান্দায় এনে রাখে। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে আসেন রীতার স্বজন ও প্রতিবেশীরা’ জড়ো হন স্থানীয়রাও।
বারান্দায় সারি করে রাখা লাশগুলোর এক কোণে বসে কাঁদছিলেন রীতার ছোট বোন দিয়া দাশ ও রুনু দাশ।
দিয়া দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১১ দিন আগে তাদের ঠাকুরমা মারা যান। মঙ্গলবার তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যোগ দিতে রীতা চার সন্তান ও শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়দের নিয়ে ফটিকছড়ি শাহ নগর এলাকায় বাবার বাড়ি যাচ্ছিলেন।
“আমরা দুই বোন গতকাল (সোমবার) বাবার বাড়ি গিয়েছিলাম। আর রীতা সন্তান ও স্বজনদের নিয়ে আজকে যাওয়ার কথা। রীতাদের আনতে বাড়ির কাছের অটোচালক বিপ্লবকে পাঠানো হয়েছিল নতুনপাড়া এলাকায়। পথেই ঘটে যায় দুর্ঘটনা।”
দিয়া জানান, রীতার স্বামী ওমান প্রবাসী। চার সন্তানকে নিয়ে থাকতেন তিনি।
রীতার মা সবিতা দাশ বসে বলেন, “ফোনে কথা হওয়ার সময় তাদের গতকাল (সোমবার) চলে আসতে বলেছিলাম। কিন্তু আসেনি… সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আমাকে ফোন করে বলেছিল। এই কথাই শেষ কথা। পরে ফোন করলাম, পুলিশ ধরে বলল থানায় আসেন…
অ্যাকসিডেন্টের খবর পেয়ে এখানে ছুটে এলাম,” বলেন সবিতা দাশ।
সবিতা কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লে তাকে তখন জড়িয়ে ধরেন তার বোনের মেয়ে লিখি।
লিখি জানালেন, ছোট সন্তানদের নিয়ে রীতা বাবার বাড়িতে আসতেন না। গত বছর বিজয়ার পরদিন ছোট ভাইয়ের বিয়েতে এসেছিলেন।
“এরপর আজ আবার আসছিলেন। কিন্তু পৌঁছানোর আগেই সব শেশষ…।”
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে পূর্ব জোয়ারা মোহাম্মদপুর থেকে হাটহাজারী ছুটে যান রীতার ভাসুর বাবলু দাশও।
তিনি জানান, তারা তিন ভাইয়ের মধ্যে ছোট রীতার স্বামী নারায়ণ। বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি প্রবাসে থাকেন। রীতা চার সন্তানকে নিয়ে থাকেন।
“রীতার ঠাকুরমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তাদের পরিবারের সবাই নিমন্ত্রিত ছিলেন। কিন্তু দূর বেশি হয়ে যাওয়ায় তারা না আসেননি। আমার অপর ভাই শম্ভু দাশের ছেলে বিপ্লব নগরীর ব্রিজ ঘাট এলাকায় একটি লন্ড্রি চালান। দাওয়াত উপলক্ষ্যে সেও ফটিকছড়িতে যাচ্ছিলেন তার কাকীর বাড়িতে।”
বাবলু আরও জানান, তাদের কাকাত বোন চিনুর বাড়ি চন্দনাইশের সাতবাড়িয়া ইউনিয়নে। সকাল সাতটার দিকে রীতা তার সন্তানদের নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। পথিমধ্যে তাদের সাথে ছেলেকে নিয়ে চিনুও যাত্রী হয়েছিলেন রীতার সাথে। আর শহর থেকে যাচ্ছিলেন বিপ্লব।
এদিকে দুর্ঘটনার পরপর বাসটি আটক করা হলেও চালক পালিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন হাইওয়ে পুলিশের নাজিরহাট ফাঁড়ির পরিদর্শক আদিল মাহমুদ।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্বরত নায়েক নূর আলম জানান, আহত দুইজনকে দুপুরে হাসপাতালে নেয়া হয়। তাদের মধ্যে বাপ্পা ২ নম্বর ওয়ার্ডে ও অটো চালক বিপ্লব ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন।