ডেঙ্গু: চট্টগ্রামে এক দিনে ৩ মৃত্যু, মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন

চলতি মাসের বৃষ্টিতে এইডিস মশার প্রাদুর্ভাব বেড়েছে, বলছেন সিভিল সার্জন।

মিঠুন চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Sept 2022, 01:40 PM
Updated : 22 Sept 2022, 01:40 PM

চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে ২৪ ঘণ্টায় প্রাণ গেছে তিনজনের, আর চলতি মাসের ২২ দিনেই শনাক্ত হয়েছে আড়াই শতাধিক রোগী।

বাসিন্দাদের অভিযোগ, ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এইডিস মশা দমনে নগর সংস্থা মাঝে মাঝে নালায় কীটনাশক দিলেও বাসাবাড়ির আশেপাশে ছিটানো হয় না। অথচ এইডিস মশা বংশবৃদ্ধি করে পরিষ্কার পানিতে।

তবে সেই অভিযোগ নাকচ করে নগর সংস্থার ভারপ্রাপ্ত প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা আবুল হাশেম দাবি করেছেন, স্প্রে ও ফগার মেশিন দিয়ে সব জায়গায় নিয়মিত কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে। যেসব এলাকায় এইডিস মশার লার্ভা মিলেছে, সেসব এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম জেলা কীটতত্ত্ববিদ এনতেজার ফেরদৌস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বুধবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বেসরকারি এভারকেয়ার হাসপাতালে তিনজন ডেঙ্গু রোগী মারা গেছেন।

বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৩ জন রোগী ভর্তি ছিলেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. শাহীদা আক্তার।

চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চলতি মাসে মোট ২৫৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে ২০০ জনই নগরীর বাসিন্দা।

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বছর জানুয়ারি থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেলায় মোট ৪০৫ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি এই মাসে।”

চলতি বছর প্রাপ্তবয়স্ক আক্রান্তদের মধ্যে ১৮৪ জন পুরুষ ও ১১৩ জন নারী উল্লেখ করে সিভিল সার্জন কার্যালয় জানিয়েছে, এছাড়া ১০৮ জন শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে।

চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অনুসন্ধানে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ১৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে আসে। তারা রোগীদের রক্তের নমুনা সংগ্রহ, লার্ভা সংগ্রহ ও আক্রান্তদের বসবাসের এলাকাও পরিদর্শন করেন।

চট্টগ্রাম জেলায় জানুয়ারিতে পাঁচজন ও ফেব্রুয়ারিতে একজন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল। এরপর মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে কারও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য মেলেনি। এরপর জুন মাসে ১৭ জন এবং জুলাই মাসে ৫০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়।

গত অগাস্টে জেলায় ৭৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হলেও চলতি সপ্তাহের শুরু থেকে শনাক্তের হার বেড়ে যায়। ১৮ সেপ্টেম্বর শনাক্ত হয় ২৬ জন; সেখানে ১৯ সেপ্টেম্বরেই ২১ জন, ২০ সেপ্টেম্বর ১৫ জন এবং ২১ সেপ্টেম্বর ২০ জনের নমুনায় ডেঙ্গু মেলে। বৃহস্পতিবারের প্রতিবেদনে আগের ২৪ ঘণ্টায় ১২ জন নতুন রোগী শনাক্তের তথ্য মিলেছে।

সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চলতি মাসে থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ার কারণে ডেঙ্গু (এইডিস) মশার প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। গত কয়েকদিন ধরে প্রায় কাছাকাছি সংখ্যায় নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে।

“বৃষ্টি বন্ধ হলে হয়ত পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে (সিসিসি) আমরা চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। তারা মশা নিধনে কাজ করছে। এছাড়া উপজেলা পর্যায়েও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে, যাতে মশার বংশ বৃদ্ধি না হয়।”

জ্বর হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

মশা মরছে তো?

চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ, ইপিজেড, পাহাড়তলি, কাট্টলী, হালিশহর, বহদ্দারহাট, চকবাজার ও জামালখানসহ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা জানান, চলতি মাসে কয়েক দফা বৃষ্টির পর মশার উপদ্রব আগের তুলনায় বেড়েছে। বাসাবাড়িতে রাতের পাশাপাশি দিনের বেলাতেও মশার উৎপাত সইতে হচ্ছে।

এনায়েত বাজার এলাকার বাসিন্দা মো. মর্তুজা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বড় নালাগুলোতে মাঝে মাঝে ওষুধ ছিটায়। জুলাই মাসে ক্রাশ প্রোগ্রামের সময় ছোট নালায় দিয়েছিল। কিন্তু বাসাবাড়ির আশেপাশে আগে বা এখন কখনোই ওষুধ ছিটায়নি।”

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মাহফুজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এইডিস মশা দুর্গন্ধযুক্ত নালায় থাকে না; থাকে পরিচ্ছন্ন পানিতে। বাসাবাড়ির আশেপাশে জমে থাকে পরিচ্ছন্ন পানি তাদের আবাসস্থল। এছাড়া ঘরের আশেপাশে ঝোপঝাড় ডেঙ্গু মশার আশ্রয়স্থল।”

ডেঙ্গু প্রতিরোধে শুরুতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচারণা ও পরে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সিটি মেয়রের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “সঠিক স্থানে ওষুধ ছিটাতে হবে। ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতে হবে। স্বচ্ছ পানি জমে থাকতে দেওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে নগরবাসীর সচেতনতাটা বেশি জরুরি।” 

নগর সংস্থার মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে সন্তুষ্ট কি না, এ প্রশ্নের কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে ১৯ সেপ্টেম্বর নগরীর মেহেদীবাগ, চটেশ্বরী রোড, উত্তর পাহাড়তলি ও পাহাড়তলী রেলওয়ে হাউজিং এলাকায় অভিযানে বাড়ির ছাদ বাগান ও নির্মানাধীন ভবনে পানি জমে থাকায় ৭ ভবনের মালিককে মোট ২২ হাজার টাকা জরিমানা করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।

জানতে চাইলে নগর সংস্থার ভারপ্রাপ্ত প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা আবুল হাশেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধিতে ওয়ার্ড পর্যায়ে ক্যাম্পেইন, মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ করছি। স্প্রে ও ফগার মেশিন দিয়ে সব জায়গায় নিয়মিত ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।”

মশা নিধনে ছিটানো কীটনাশকের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীর অনুরোধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছয় সদস্যের একটি কারিগরি দল গঠন করে।

ওই দল গবেষণা করে জানায়, নগর সংস্থা যেসব অ্যাডাল্টিসাইড (প্রাপ্তবয়স্ক মশা নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া) ও লার্ভিসাইড (মশার লার্ভা দমনে কীটনাশক ছিটানো) ব্যবহার করে, সেগুলোর কার্যকারিতা কম।

জানতে চাইলে সিটি কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা আবুল হাশেম বলেন, “বিশেষজ্ঞ দল যে ভেষজ ওষুধ ব্যবহারের সুপারিশ করেছিল, তা কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রমাণিত নয়। তাই আমরা আইইডিসিআর এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে মতামত চেয়েছি।

“আমরা যে অ্যাডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড ব্যবহার করি সেগুলোর সক্ষমতা আইইডিসিআর কর্তৃক স্বীকৃত। কিছু অ্যাডাল্টিসাইড সংকট ছিল, ছয দিন আগে আবার কেনা হয়েছে। এখন লার্ভিসাইড ও অ্যাডাল্টিসাইড পর্যাপ্ত আছে।”

আবুল হাশেম বলেন, “আইইডিসিআর গতকাল আমাদের কিছু স্পট দিয়েছে। আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল এলাকা, সিডিএ আবাসিক এলাকা, ডবলমুরিং ও বহদ্দারহাট টার্মিনাল এসব এলাকায় তারা সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গুর লার্ভা পেয়েছে।

“আজই আমরা উচ্ছেদ চালিয়ে বহদ্দারহাট টার্মিনাল এলাকা থেকে সব পরিত্যক্ত টায়ার ও সরঞ্জাম নিয়ে এসেছি। অভিযান অব্যাহত থাকবে।”

Also Read: চট্টগ্রামে ডায়রিয়া কমছে, বাড়ছে ডেঙ্গু

Also Read: পরীক্ষায় দেখা গেল, চট্টগ্রামে ছিটানো কীটনাশকে মশা তেমন মরছে না

Also Read: চট্টগ্রামে মশা দমন আপাতত পুরনো কীটনাশকেই