গ্যাস বন্ধ থাকায় শিল্প কারখানায় উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যায়; সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন আবাসিক গ্রাহকরা।
Published : 19 Jan 2024, 11:24 PM
সাগরে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে সরবরাহ করা গ্যাস দিয়েই মেটানো হয় চট্টগ্রাম অঞ্চলের আবাসিক, শিল্প কারখানা ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা। প্রতিদিন গড়ে ৩২৫ মিলিয়ন ঘনফুট (সিএফটি) চাহিদা থাকলেও পাওয়া যাচ্ছিল ২৯০ সিএফটি।
এলএনজি টার্মিনালে কারিগরি ত্রুটির কারণে বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সব ধরনের গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। নোটিস ছাড়াই গ্যাস বন্ধ হওয়ায় আবাসিক সংযোগ ব্যবহারকারী নাগরিকদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়। বন্ধ হয়ে যায় এ অঞ্চলের সকল সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন, তিনটি সার কারখানা ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রসহ ছোট ছোট বিভিন্ন শিল্পকারখানা।
এদিন গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হলেও আবাসিক সংযোগে দুর্ভোগ চলছে গত নভেম্বর থেকেই। নগরীর বেশিরভাগ এলাকাতেই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গ্যাস মিলছিল না। কোনো কোনো এলাকায় গ্যাস মিলত দিনের শেষ দিকে।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) কর্মকর্তারা বলছেন, একটি এলএনজি টার্মিনালের সংস্কারের কারণে সরবরাহ কম থাকায় এ সংকট ছিল। বৃহস্পতিবার রাতে সংস্কার করে আনা একটি টার্মিনাল কমিশনিংয়ের সময় যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়ায় গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
পরে শুক্রবার গভীর রাতে কক্সবাজারের এলএনজি টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রামে সরবরাহ শুরু হলে নগরীর কিছু এলাকায় গ্যাস আসতে শুরু করে।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ( কেজিডিসিএল) জরুরি গ্যাস নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়, গভীর রাতে নগরীর কয়েকটি এলাকার বাসাবাড়িতে সীমিত পরিসরে গ্যাস এসেছে।
নগরীর চেরাগী পাহাড় এলাকার গৃহিণী মিত্রা বিশ্বাস জানায়, রাত ১টার দিকে তার বাসার গ্যাসের চুলায় মৃদু গ্যাস আসছে ।
তবে নগরজুড়ে পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে শনিবার লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন কেজিডিসিএল এর মহাব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান।
সংকটের শুরু
কেজিডিসিএলের একজন কর্মকর্তা জানান, কক্সবাজারের মহেশখালীতে ভাসমান দুটি এলএনজি টার্মিনালে আমদানি করা এলএনজি রূপান্তরের মাধ্যমে গ্যাস চট্টগ্রামসহ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। গত ১ নভেম্বর থেকে সংস্কারের জন্য একটি টার্মিনাল থেকে সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ ছিল। তখন থেকেই চট্টগ্রামের বাসাবাড়িতে গ্যাসের সংকট দেখা দেয়।
কেজিডিসিএলের জিএম আমিনুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বৃহস্পতিবার সংস্কার শেষে ফেরা টার্মিনালটি কমিশনিং করা হচ্ছিল। টার্মিনালটির জেনারেটরে সমস্যা হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি।
“এছাড়া অপর টার্মিনালটিও সংস্কারের জন্য তৈরি করা হচ্ছিল। সেকারণে টার্মিনাল দুটি থেকে গ্যাস দিতে না পারায় আবাসিক-শিল্প মিলিয়ে সবখানে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।”
গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার মধ্য রাত থেকে বন্ধ হয়ে যায় সিইউএফএল, কাফকো ও ডিএপি সার কারখানার উৎপাদন।
চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টা থেকে কারখানা ‘শাট ডাউনে’ যায়। শুক্রবার পুরো দিন কোনো উৎপাদন হয়নি।
আনোয়ারায় অবস্থিত সিইউএফএলে প্রতিদিন গড়ে ৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দরকার হয়। একদিন বন্ধ থাকলে কারখানাটিতে গড়ে তিন কোটি টাকার সমপরিমাণ ইউরিয়া সার উৎপাদন বন্ধ থাকে বলে জানান তিনি।
আনোয়ারায় অবস্থিত কাফকো ও ডিএপি সার কারখানাতেও বৃহস্পতিবার রাত থেকে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
চট্টগ্রামের রাউজানের দুটি ও শিকলবাহার দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রও গ্যাসনির্ভর। তবে নিয়মিত উৎপাদনে থাকে শিকলবাহা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ২২৫ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র।
পিডিবি চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শিকলবাহার গ্যাস নির্ভর ২২৫ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটি গ্যাস সংকটের কারণে বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে বন্ধ ছিল। তবে শীতকালে চাহিদা কম থাকায় চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ সংকট হয়নি।
কেজিডিসিএল থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, আবাসিক, শিল্প কারখানা, রিফুয়েলিং স্টেশন মিলিয়ে তাদের গ্রাহক সংখ্যা ৬ লাখ ১ হাজার ৯১৪। এর মধ্যে আবাসিক সংযোগ ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৫৬১টি। চট্টগ্রামের সরবরাহ পুরোপুরিই এলএনজি টার্মিনাল নির্ভর।
গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানিটির এক কর্মকর্তা জানান, ৩২৫ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে এলএনজি টার্মিনাল থেকে পাওয়া যেত ২৮০-২৯০ মিলিয়নের ঘনফুটের মত। গত ১ নভেম্বর থেকে কমবেশি ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কম মিলত।
কেজিডিসিএল কর্মকর্তা আমিনুর রহমান বলেন, দুটি টার্মিনালের একটি সংস্কার হয়েছে। অপরটি সংস্কারের জন্য যাচ্ছে। সেটি ফিরতে মার্চ লাগতে পারে।
“দুটি টার্মিনাল থেকে সরবরাহ করা গেলে চট্টগ্রামের গ্যাস সংকট প্রায় কাটবে এবং তার জন্য মার্চ পর্যন্তই অপেক্ষা করতে হতে পারে।”
গ্যাস সংকট, দুর্ভোগ
গ্যাস না থাকায় শুক্রবার ভোরে ঘুম থেকে উঠে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েন আবাসিক গ্রাহকরা। সকালে চুলায় গ্যাস জ্বলতে না দেখে অনেকে খাবারের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ ছুটলেও সেখানে সংকট থাকায় তাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। দুপুর-রাতেও খাবার না পেয়ে অনেককে খালি হাতে ফিরতে হয়।
নগরীর সিএনজি স্টেশনগুলোতেও গ্যাস পাওয়া যায়নি। গ্যাস না পাওয়ায় নগরীতে সিএনজিচালিত অটো রিকশার চলাচলও সকাল থেকে সীমিত হয়ে পড়ে। সিএনজিতে রূপান্তরিত ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলও কমে যায়।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ। হাতেগোনা কিছু অটোরিকশা মিললেও তারা অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করে।
আন্দরকিল্লা এলাকার বাসিন্দা রাজীব মিত্র বলেন, “সকাল থেকেই গ্যাস নেই। ঘুম থেকে উঠে পরিবারের সবাই বিপাকে পড়ি। খাবার আনতে হোটেলে গিয়ে চড়া দামে কিনতে হয়েছে।”
বাদুরতলা এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী সাইফুল সরকার বলেন, “কয়েকমাস ধরে লাইনে গ্যাস মিলছে না সকাল থেকে দুপুর বা বিকেল পর্যন্ত। আজ ভোর থেকেই কোনো ঘোষণা ছাড়া গ্যাস বন্ধ।
“বাইরে বের হলে অটোরিকশায় বাড়তি ভাড়া দিতে হচ্ছে। কবে এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলবে জানি না।”
নগরীর পাহাড়তলী এলাকার অটোরিকশা চালক আবদুস শুক্কুর বলেন, “আগেরদিন গ্যাস ভরছিলাম। তাই দিয়ে আজ দুপুর পর্যন্ত চালাইছি।
“অনেক গাড়িতে গ্যাস নাই, তাই চালাতে পারেনি। যাদের গ্যাস ছিল তারা হয়তো বাড়তি ভাড়া নিয়েছে।”