উদ্বোধনের পর এক বছর ধরে প্রতিদিন যত যানবাহন টানেলে চলেছে, সেই টোলের টাকায় রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশও মিটছে না।
Published : 28 Oct 2024, 01:07 AM
কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম সড়ক টানেল দিয়ে বিপুল সংখ্যক যানবাহন চলাচল করবে, সেই টোলের আয় দিয়ে নির্মাণব্যয় উঠে আসার পাশাপাশি ঋণ পরিশোধ করা হবে– এমন প্রত্যাশার কথাই বলেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টো।
উদ্বোধনের পর এক বছর ধরে প্রতিদিন যত যানবাহন টানেলে চলেছে, সেই টোলের টাকায় রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশও মিটছে না। ফলে নদী তলদেশে দেশের প্রথম টানেল এখন ‘লোকসানি’ প্রকল্পে পরিণত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি কখনোই ‘সাসটেইনেবল‘ প্রকল্প ছিল না। তাই মুখ থুবড়ে পড়েছে। এটি কার্যকর করতে সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে। টানেলের দুই প্রান্তে শিল্প কারখানার কার্যকর অগ্রগতি না হওয়া এবং ‘অপরিকল্পিত চিন্তার বলি’ এই টানেল।
সড়ক ও সেতু পরিবহন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের ভাষায়, কার্যকরিতার বিবেচনায় নয়, কর্ণফুলী টানেল ছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ‘চোখ ধাঁধানো প্রকল্প’।
২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত টানেলটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন সেটি যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
টানেল কর্তৃপক্ষের হিসেবে, প্রথম বছরে প্রতিদিন গড়ে ১৮ হাজার ৪৮৫টি গাড়ি চালাচল করার প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু বর্তমানে প্রতিদিন গাড়ি চলছে গড়ে ৩৯১০টি।
প্রতিদিন গড়ে ১০ লাখ ৩৭ হাজার ১৫৪ টাকা টোল আদায় হলেও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হচ্ছে ৩৭ লাখ ৪৬ হাজার ৯৯৩ টাকা। অর্থাৎ প্রতিদিন ব্যয়ের এক তৃতীয়াংশও টানেল থেকে আয় হচ্ছে না।
গত রোববার টানেল দিয়ে সারাদিন গাড়ি চলেছে ৩৩৬১টি, বিপরীতে টোল আদায় হয়েছে ১০ লাখ ২৩ হাজার ৫০ টাকা। ১৬ অক্টোবর ৩৪৭৩টি যানবাহন চলাচলের বিপরীতে টোল আদায় হয় ৯ লাখ ৯৫ হাজার ২০০ টাকা। ১১ অক্টোবর ৬২০৮ টি গাড়ি চলেছে, টোল মিলেছে ১৭ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।
কর্ণফুলী টানেল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ২৯ অক্টোবর থেকে এ বছরের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ১৪ লাখ ১১ হাজার ৪১২টি গাড়ি চলাচল করেছে এ পথ দিয়ে, টোল আদায় হয়েছে ৩৭ কোটি ৪৪ লাখ ১২ হাজার ৭৫০ টাকা।
এই সময়ে একদিনে সর্বোচ্চ গাড়ি চলেছিল গত বছরের ৩ নভেম্বর। সেদিন যাওয়া-আসা মিলিয়ে চলাচলকারী ১৪ হাজার ৭৯৫টি গাড়ির বিপরীতে ৩৩ লাখ ৫৪ হাজার ৫৫০ টাকা টোল আদায় হয়। সেদিনও টানেলের একদিনের পরিচালন ব্যয়ের পুরো টাকাটা ওঠেনি।
কর্ণফুলী টানেল কর্তৃপক্ষের টোল সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় গত কয়েক মাসে টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল কম থাকলেও এ মাসে সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিন এভারেজে ১০ লাখ টাকার মতো টোল আদায় হচ্ছে।”
কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের জন্য ২০১৪ সালের ১০ জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বেইজিংয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। ২০১৫ সালের নভেম্বরে একনেকে অনুমোদনের পর ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে কাজ শুরু হয়।
শুরুতে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সাল করা হয়। কয়েক দফায় প্রকল্প ব্যয় বাড়ানোর পর মোট খরচ দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা।
৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই টানেলে প্রতিটি সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। এছাড়া ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ওভারব্রিজ রয়েছে আনোয়ারা প্রান্তে।
টানেলের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি), টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজও পেয়েছে তারা। তাদের পরিশোধ করতে হবে ৯৮৪ কোটি টাকা।
এর মধ্যে স্ক্যানার কেনা ব্যয় ৩০০ কোটি টাকা, সে হিসেবে প্রকৃত রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ৬৮৪ কোটি টাকা। প্রতিদিনের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় সাড়ে ৩৭ লাখ টাকায় দাঁড়ায়।
টানেলটি নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ২৫৫ দশমিক ২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীনকে ঋণ বাবদ পরিশোধ করতে হবে ৬ হাজার ৭৭ দশমিক ৫৮ কোটি টাকা।
‘উদ্দেশ্য ছিল দুর্নীতি আর লোক দেখানো’
কর্ণফুলী টানেলকে লোকসানি প্রকল্প বলছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সড়ক ও সেতু উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “টানেল তো হয়ে গেছে। ট্রাফিক কম, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ অনেক বেশি সবাই জানে। এটার খরচ ফেরতের বা ‘রি ডু’ করার কোনো উপায় নেই। শুধু টানেল না, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ নিয়েও একই অবস্থা।”
উপকারের জন্য নয় বরং মানুষের ‘চোখ ধাঁধানোর’ জন্য এসব প্রকল্প মন্তব্য করে উপদেষ্টা বলেন, “এসব উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হয়েছে। উদ্দেশ্য দুর্নীতি আর লোক দেখানো মানে… আমরা টানেল করেছি। এগুলো আমরা দেখব। একসাথে সবকিছুতে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। একটা একটা করে ভুল শোধরানোর চেষ্টা করছি।”
টানেলে ট্রাফিক বাড়ানোর জন্য কী করা যায় তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, “টানেল দিয়ে কক্সবাজারের সঙ্গে সংযোগ বাড়ানো যায় কি না সেটা চিন্তায় আছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম শহরকে বাইপাস করে ঢাকার সঙ্গে সংযোগ করা যায় কি না। এতে টানেলে ট্রাফিক বাড়তে পারে।”
অর্থনীতির জন্য ‘নীরব ঘাতক’
নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার টানেলকে একটি ‘উচ্চাভিলাষী’ প্রকল্প হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, টানেলের বর্তমান আয় দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন খরচের এক-তৃতীয়াংশও ওঠে না। জিডিপিতে কোনো অবদান না রেখেই চীনের ঋণ শোধ করতে হবে সুদসহ। এ প্রকল্পটি এক কথায় মুখ থুবড়ে পড়েছে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “টানেল উদ্বোধনের পর কিছু মানুষ হয়ত আগ্রহ থেকে দেখতে সেখানে গেছেন। সেসময় হয়ত যানবাহন চলাচল কিছু বেড়েছিল, কিন্তু তা সাময়িক। বাণিজ্যিক বিবেচনায় এটা কখনোই ‘সাসটেইনেবল’ হয়নি, যা এখন বোঝা যাচ্ছে। চট্টগ্রামের প্রকৌশলীরা অনেক আগে বলেছিল, তখন আমাদের সাজেশন আমলে নেওয়া হয়নি।”
এ টানেল দেশের অর্থনীতির জন্য ‘নীরব ঘাতক’ হয়ে উঠতে পারে বলেও সতর্ক করেন মজুমদার।
তিনি বলেন, “টানেলকে কীভাবে আরও কার্যকর করে তোলা যায় এজন্য সরকারকে ভাবতে হবে। বিশেষ করে টানেলের দুইপ্রান্তে সড়ক প্রশস্তকরণের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের বিকাশ ঘটাতে হবে।”
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বুয়েটের পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, “কর্ণফুলী টানেল একটি মেগা প্রকল্প। মেগা প্রকল্প মানে আশপাশের এলাকায়ও বিনিয়োগ ভারী হতে হবে অর্থাৎ সমন্বিত পরিকল্পনাটাও মেগা হওয়া দরকার। এ প্রকল্পের ক্ষেত্রে তা হয়নি।
“দেশে প্রথম সড়ক টানেল হচ্ছে এটা নিয়ে আমরা একসময় গর্ব করতাম। কিন্তু অর্থনৈতিক করিডোর বা সম্ভাবনার কথা যেটা বলা হয়েছে, সেটা বাস্তবে হয়নি। এশিয়ায় বা আমাদের আশপাশের দেশে কেউ সড়ক টানেল বানায় না। কারণ এর নির্মাণ খরচ বা রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় অনেক বেশি।”
হাদিউজ্জামানের পরামর্শ, বানিয়ে যেহেতু ফেলা হয়েছে, তাই একে কার্যকর করার কথা ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, “টানেলের দুই প্রান্তে ভারী শিল্প কারখানা তৈরি করতে হবে, সড়কে ভারী যানবাহন চলাচলের সক্ষমতা বিবেচনায় ঠিক করতে হবে।
“শুধু ভারী যানবাহন চলাচল কয়েকটা বাড়ল, সেটিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ল বিবেচনা না করে অর্থনৈতিক করিডোরে ট্রান্সফর্ম করতে না পারলে রিটার্ন যুতসই হবে না। এদিকে মিরসরাই শিল্পাঞ্চল থেকে টানেলের অপরপ্রান্তে আনোয়ারা-কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণসহ সঠিক ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ভারী শিল্প কারখানা তৈরি করতে হবে।”
টানেল নিয়ে এসব পরিকল্পনা হয়ত কাগজে কলমে আছে, কিন্তু সেভাবে কার্যকর হয়নি বলে মনে করেন তিনি।