চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের পেছনে অব্যবস্থাপনা খুঁজে পেয়েছে তদন্ত কমিটি; কারখানাটিতে দক্ষ জনবলের ঘাটতি থাকার কথাও উঠে এসেছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
বিকট বিস্ফোরণের উৎসস্থল হিসেবে প্ল্যান্টটির অক্সিজেন সেপারেশন ইউনিটকে চিহ্নিত করেছে তদন্ত কমিটি।
ভবিষ্যতে এই ধরনের বিস্ফোরণ এড়াতে নয়টি সুপারিশ করেছে নয় সদস্যের এই তদন্ত কমিটি। তার কিছু বাস্তবায়ন ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
গত ৪ মার্চ সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে সাতজন নিহত হয়, আহত হয় ২৫ জন। বিস্ফোরণ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে লোহার টুকরা, সিলিন্ডার কয়েকশ গজ দূরে গিয়েও পড়ে।
বিস্ফোরণের পর অক্সিজেন উৎপাদনের এই কারখানাটিতে অনিয়মের পাশাপাশি কারখানা দেখভালের দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থার গাফিলতি নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
এরপর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব হাসানকে প্রধান করে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। পরে কমিটিতে আরও দুজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে কমিটিকে বলা হলেও আরও দুই দিন সময় বাড়িয়ে নিয়ে মঙ্গলবার জেলা প্রশাসককে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি।
তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তরের সময় বিস্ফোরণের কারণ ও সুপারিশ বিষয়ে জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান এবং তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক রাকিব হাসান দুজনের কেউ বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব সাংবাদিকদের বলেন, “কিছু ঘাটতি, কিছু অবহেলা অবশ্যই ছিল। যার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।”
তদন্ত কমিটির একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিস্ফোরণের উৎসস্থল হিসেবে অক্সিজেন সেপারেশন ইউনিটকে চিহ্নিত করেছেন তারা।
তাদের একজন বলেন, “বিস্ফোরণটি হয়েছিল অক্সিজেন সেপারেশন ইউনিটে। বিস্ফোরণ এতটাই তীব্র ছিল যে আশেপাশে অনেক দূর পর্যন্ত ধাক্কা অনুভূত হয়েছে।”
বিস্ফোরণের পরদিন তদন্ত কমিটির পরিদর্শনের সময় রাকিব বলেছিলেন, “প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, অক্সিজেন প্ল্যান্টে এয়ার সেপারেশন কলাম থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত হতে পারে।”
প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “অক্সিজেন প্ল্যান্ট পরিচালনার মতো দক্ষ ও যোগ্য লোকবল ওই কারখানায় ছিল না। প্ল্যান্টটি স্থাপনের পর থেকে সেটি মেনটেইনেন্স করা হয়নি। এসব কারণে অক্সিজেন সেপারেশন ইউনিটের ত্রুটিও আগে থেকে ধরা পড়েনি।”
বিস্ফোরণের পর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মিনা মাসুদ উজ্জামান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, একবার কারখানা পরিদর্শনে ত্রুটি পাওয়ার পর সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টকে নোটিস দেওয়া হয়েছিল।
১৯৯৬ থেকে সচল এই কারখানাটিতে যে প্ল্যান্টটি বিস্ফোরিত হয়, তা ২০১৭ সালে চালু হয়েছিল বলে কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মামুন উদ্দিন জানিয়েছিলেন।
সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে শিল্প খাতে ব্যবহারের জন্য অক্সিজেন প্রস্তুত করা হত এবং সরবরাহ করা হত সিলিন্ডারে ভরে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিল্প খাতে ব্যবহারের এ ধরনের অক্সিজেন সাধারণত তৈরি করা হয় কয়েকটি ধাপে। শুরুতে কম্প্রেসারে বাতাস নেওয়া হয়। সেখানে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় নাইট্রোজেন আলাদা করা হয়। ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত অক্সিজেন হলে তা সিলিন্ডারে ভরা হয়।
তদন্ত কমিটির আরেক সদস্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিস্ফোরণে অক্সিজেন সেপারেশন ইউনিটের পুরোটা ভেঙেচুরে যায়।
“আমরা জানি, অক্সিজেন নিজে জ্বলে না, তবে অন্যকে জ্বলতে সাহায্য করে। অক্সিজেন সেপারেশন ইউনিটের কোথাও লিকেজ থাকতে পারে। বিকেল ৩টা-৪টার দিকে তাপমাত্রা বেশি ছিল। লিকেজের কারণে কোনোভাবে হাইড্রোকার্বনের সংস্পর্শে এসেছিল, এতে স্পার্ক (স্ফুলিঙ্গ) হয়। প্রেসারে থাকা অক্সিজেন তখন বিস্ফোরিত হয়েছিল।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত কমিটির ওই সদস্য বলেন, “যেহেতু ওই কারখানায় টেকনিক্যাল লোকবল ছিল না, তাই দীর্ঘদিন প্ল্যান্টটি মেনটেইনেন্স হয়নি। ফলে প্রসেসরে লিকেজ থাকার বিষয়টি নজরে আসেনি।
“অক্সিজেন সেপারেশন প্ল্যান্টে সেফটি ভালব থাকে, এলার্মিং সিস্টেম থাকে। নিয়মিত পরীক্ষা না করায় লিকেজ ধরা পড়েনি।”
বিস্ফোরণের পর জেলা প্রশাসনের এক বৈঠকে সীমা অক্সিজেনের মালিক মামুন বলেছিলেন, দুজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার এবং মানবিক বিভাগ থেকে পাস করা একজন সুপারভাইজার মিলে কারখানাটি পরিচালনা করা হত।
এক প্রশ্নের জবাবে সেদিন তিনি আরও বলেছিলেন, “প্ল্যান্টটি চীন থেকে সাপ্লাই দেওয়ার পর কমিশনিং এবং প্রডাকশন পর্যন্ত প্রায় তিন মাস উনারা (চীনা কর্মী) এখানে ছিলেন। এরপর আরও দু’মাস থেকে যারা অপারেটিং করবে তাদের ট্রেইনিং দিয়েছেন। তারপর আর আসেননি।”
৬ মার্চের ওই অনুষ্ঠানে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা জানিয়েছিলেন, সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের ফায়ার সেফটি প্ল্যান ও পরিবেশ ছাড়পত্র ছিল না। কারখানায় অননুমোদিত কার্বন ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেন সিলিন্ডার ছিল।
মঙ্গলবার বিকালে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জেলা প্রশাসক ফখরুজ্জামানের কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করে তদন্ত কমিটি।
প্রতিবেদন নিয়ে তিনি বলেন, “তদন্ত কমিটি একাধিকবার সরেজমিন গিয়ে টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি দেখে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাব। অনুমোদন পেলে দুর্ঘটনার কারণ, উৎস ও সুপারিশমালা আপনাদের পরে জানাব।”
তদন্ত কমিটির প্রধান রাকিব হাসান সাংবাদিকদের বলেন, “অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের ঘটনা এটাই বাংলাদেশে প্রথম। শুধু তাই নয়, গত এক দশকে সারা পৃথিবীতে এ নজির ৪-৫টির বেশি নেই। এই বিস্ফোরণ খুবই বিরল।
“কাজটা (তদন্ত) শুরুর সময় আমাদের মানসিকতা ছিল একরকম। কাজটা করতে গিয়ে ইন ডেপথে যেতে গিয়ে আমাদের অনেক নতুন বিষয় শেখা হয়েছে।”
বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি ৮ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে ৯টি সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব।
তিনি বলেন, সুপারিশমালার মধ্যে যেগুলো জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাস্তবায়ন সম্ভব, সেগুলোর বাস্তবায়ন ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, “সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের ঘটনার পর আমরা ভারী ও মাঝারি শিল্পের জন্য মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছি। চট্টগ্রামে যে অক্সিজেন প্ল্যান্ট আছে সেগুলোর জন্য একটি ম্যানুয়েল তৈরি করতে চাই। একটি বড় প্রতিষ্ঠান, যাদের কমপ্লায়েন্স ভালো তারা এগিয়ে এসেছে।
“সব অক্সিজেন প্ল্যান্ট থেকে ২-৩ জন করে প্রতিনিধিকে নিয়ে ওয়ার্কশপ আয়োজন করেছি। কোন পর্যায়ে কোন ধরনের লোকবল কাজ করবে, সেগুলোসহ সব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবে।”
এদিকে বিস্ফোরণে নিহত এক ব্যক্তির স্বজন কারখানা মালিকদের আসামি করে একটি মামলা করেন। তদন্ত প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর রাতে সেই মামলার আসামি কোম্পানির পরিচালক পারভেজ উদ্দিন শান্টুকে গ্রেপ্তার করেছে শিল্প পুলিশ।