খৈয়াছড়ায় ১১ মৃত্যু: থেমে থেমে মাতম, চোখের জলে বিদায়

এক দিন আগেও পরিবেশ ছিল স্বাভাবিক; সেখানে স্বজন, বন্ধু আর প্রতিবেশী হারানোর বেদনায় থেমে থেমে কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে পরিবেশ।

উত্তম সেন গুপ্তচট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 July 2022, 02:43 PM
Updated : 30 July 2022, 02:43 PM

চট্টগ্রামের খৈয়াছড়া ঝর্ণা রেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে ১১ জন নিহতের ঘটনায় শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছে হাটহাজারী উপজেলার চিকনদণ্ডী ইউনিয়নের খন্দকিয়া গ্রামের বাসিন্দারা।

এক দিন আগেও যে পরিবেশ ছিল স্বাভাবিক; সেখানে স্বজন, বন্ধু আর প্রতিবেশী হারানোর বেদনায় কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে পরিবেশ।

শনিবার খন্দকিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বেলা নয়টার আগে থেকেই খন্দকিয়া ছমদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জড়ো হতে থাকে স্থানীয় লোকজন। নিহতদের জানাজা হবে সকালে তা রাতেই জানাজানি হয়ে যায়।

সকাল থেকেই ওই গ্রাম, আশেপাশের গ্রামের মানুষ আর আত্মীয় স্বজনরা আসতে থাকেন। জানাজা শুরুর অনেক আগেই মাঠে জমায়েত বাড়ে।

আর নিহতদের বাড়িতে স্বজন হারানোদের সান্তনা দিতে ছুটে গেছেন প্রতিবেশী নারী ও স্বজনরা।

পৌনে ১০টার দিকে মাঠে যখন নিহত ছয়জনের লাশ নিয়ে আসা হচ্ছিল তখন স্বজনদের কান্নার রোল ওঠে আবারও; জানাজায় আসা লোকজনের অনেকের চোখের কোণায় জমে অশ্রুবিন্দু।

শনিবার সকালে স্থানীয় খন্দকিয়া ছমদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কেএস নজুমিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নিহত ছয়জনের জানাজায় নেমেছিল মানুষের ঢল।

প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে নিহত জিয়াউল হক সজিব, রিদুয়ানুল চৌধুরী, সামিরুল ইসলাম হাসান, ইকবাল হোসেন মারুফ ও মাইক্রোবাস চালক গোলাম মোস্তফা নিরুর জানাজা হয়। কেএস নজুমিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে হয়েছে মোসাব আহমেদ হিশামের জানাজা।

এ দুই জানাজায় স্থানীয়দের পাশাপাশি অংশ নেন স্থানীয় সাংসদ আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ সালামসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা।

শুক্রবার দুপুরে খৈয়াছড়া লেভেল ক্রসিংয়ে উঠে পড়া তাদের মাইক্রোবাসটিকে ঠেলে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নিয়ে যায় আন্তঃনগর মহানগর প্রভাতী ট্রেন। ওই মাইক্রোবাসেই সকালে হাটহাজারীরে ‘আর অ্যান্ড জে’ কোচিং সেন্টার থেকে খৈয়াছড়ায় বেড়াতে গিয়েছিলেন ১৬ শিক্ষক-শিক্ষার্থী। এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় উপলক্ষে ওই পিকনিকে চালক ও সহকারীসহ ১৮ জন ছিলেন।

ট্রেনের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই ১১ জন নিহত হন, ছয়জন চিকিৎসাধীন আছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিউরো সার্জারি ওয়ার্ডে।

নিহতরা হলেন- মাইক্রোবাসের চালক গোলাম মোস্তফা নিরু, কোচিং সেন্টারের পরিচালক জিয়াউল হক সজিব, ওয়াহিদুল আলম জিসান, রিদুয়ানুল চৌধুরী ও মোস্তফা মাসুদ রাকিব, শিক্ষার্থী সামিরুল ইসলাম হাসান, মুসাব আহম্মেদ হিশাম, ইকবাল হোসেন মারুফ, আসিফুল ইসলাম আশিক, শান্ত শীল ও সাজ্জাদ হোসেন।

নিহতদের মধ্যে হাসান, হিশাম ও মারুফ স্থানীয় কেএস নজু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পরীক্ষার্থী, আশিক ও শান্ত স্থানীয় কে সি শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

পরিচালকদের মধ্যে রিদুয়ান সরকারি চট্টগ্রাম কলেজের দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের, সজিব ওমরগণি এমইএস কলেজের স্মাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।

এছাড়া জিসান ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে স্মাতক সম্পন্ন করে সম্প্রতি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন এবং রাকিব চট্টগ্রাম মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায় আছেন।

নিহত সাজ্জাদ কোচিং সেন্টার পরিচালক সজীবের বন্ধু হিসেবে পিকনিকে গিয়েছিলেন।

তাদের মধ্যে রাকিবর বাড়ি চিকদণ্ডী ইউনিয়নের পাশ্ববর্তী শিকারপুর ইউনিয়নে, সাজ্জাদের বাড়ি মাদার্শা এবং শান্তর বাড়ি সরকার হাট ও আশিক ফতেপুর এলাকার বাসিন্দা। আর অন্যরা সবাই খন্দাকিয়া গ্রামের বাসিন্দা।

দুপুরে দুর্ঘটনার পর রাতেই তাদের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় তাদের বাড়িতে। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনার খবর আসর পর থেকে সেই যে কান্নার রোল উঠছে তা শনিবারও চলছে পুরো গ্রামজুড়ে। থেমে থেমে স্বজনরা নিহতদের জন্য শোকে মাতম করছেন।

প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠের অল্প ব্যবধানে কোচিং সেন্টারের পরিচালক জিয়াউল হক জিসানের বাড়ি। তার একশ গজের মধ্যেই ইকবাল হোসেন মারুফের নানা বাড়ি, যেখানে থেকে পড়ালেখা করেছেন তিনি।

জানাজা শেষে জিসানকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এর ঠিক বিপরীতেই কয়েক গজের ব্যবধানে মারুফের কবর।

আর অ্যান্ড জে প্রাইভেট কেয়ার নামে যে কোচিং সেন্টারটি থেকে পিকনিকে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে সেটাতে পড়াতেন আব্দুল্লাহ আরিফ রিসাদ নামে একজন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, গত মার্চে কোচিং সেন্টারটি চালু করা হয়েছিল। সজীব, জিসান, রিদুয়ান ও রাকিব সেন্টারটি চালু করেছেন। তারা এবং তিনিসহ ছয়জন সেখানে পড়াতেন।

“যে চারজন কোচিং সেন্টারটি চালু করেছেন, তারা সবাই মারা গেছেন,” আরিফ যখন বলছিলেন, তার চোখের কোনে তখন জমেছে অশ্রু কণা।

“পরশুদিন (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত আমরা একসাথে ছিলাম। গতকাল আমারও যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সকাল বেলা মত পরিবর্তন করেছিলাম। যার কারণে আমি বেঁচে আছি। এখন তাদের জন্য দোয়া করা ছাড়া আমার আর কিছুই নেই।”

দুর্ঘটনায় নিহত ১১ জনের মধ্যে সাতজনই স্থানীয় কেএস নজুমিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী। আর আহতদেরও কয়েকজন এ স্কুলের শিক্ষার্থী।

তাদের মধ্যে মোসাব আহম্মেদ হিশাম, সামিরুল ইসলাম হাসান ও ইকবাল হোসেন মারুফ এবছরের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন বলে জানান বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুহাম্মদ শফিউল আলম।

আর মাইক্রোবাসচালক গোলাম মোস্তফা নিরু, কোচিং সেন্টার শিক্ষক সাকিব, রিদুয়ান ও সাজ্জাদ বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র বলে জানান তিনি।

প্রধান শিক্ষক বলেন, নিহত তিনজনই ছিলেন মেধাবী শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে হিশাম ও মারুফ জিপিএ-৫ পাওয়ার যোগ্যতা ছিল।

এদিকে দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় কেএস নজু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় নিহতদের স্মরণে তিন দিনের শোক ঘোষণা করে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে এবং কালো পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার আয়োজন করা হয়েছে শোকসভার বলে জানান প্রধান শিক্ষক।

স্কুলের সহকারী শিক্ষক সাধন চন্দ্র নাথ বলেন, একসঙ্গে একই এলাকায় এত মৃত্যুর খবর শুনেছিলাম ২০১১ সালে মিরসরাইয়ের আবু তোরাব স্কুলে। এবার নিজের স্কুলের শিক্ষার্থীদের দেখলাম। বিষয়টি আমাদের জন্য মেনে নেওয়াও খুব কষ্টের।