খৈয়াছড়ায় ১১ মৃত্যু: ‘নিজের কেনা কাফনের কাপড়েই দাফন হলো হিশামের’

শয্যাশায়ী নানার জন্য এই কাপড় কিনে রেখেছিল সে।

উত্তম সেন গুপ্তবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 July 2022, 12:31 PM
Updated : 30 July 2022, 12:31 PM

দুই বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে চাচাদের সান্নিধ্যে বেড়ে উঠছিল মোসাব আহমেদ হিশাম; এসএসসি পরীক্ষা শেষে কানাডায় মা-বোনের ঠিকানায় যাওয়ার কথা ছিল এ কিশোরের।

তবে সেই যাত্রার আগে শুক্রবার তার অন্তিম যাত্রা হয়েছে মিরসরাইয়ের ভয়াবহ মাইক্রোবাস-ট্রেন দুর্ঘটনায়। হিশামের (১৬) সঙ্গে প্রাণ গেছে আরও ১০ জনের; তাদের কেউ কেউ তার বন্ধু, কেউ শিক্ষক।

শনিবার চট্টগ্রামের হাটহাজারীর খন্দকিয়া গ্রামে হিশামদের বাড়িতে গিয়ে শোকার্ত আবহে কথা হচ্ছিল তার চাচা মোহাম্মদ হোসেনের সঙ্গে। অশ্রুসিক্ত হোসেন বলছিলেন, “হিশামকে বেশি দেখাশোনা করত আমার মেজ ভাই আকবর হোসেন। শুনেছি তার অসুস্থ (শয্যাশায়ী) নানার জন্য একটি কাফনের কাপড় কিনেছিল সে (হিশাম); যেটি দেখে আমার মেঝ ভাই তাকে খুব বকাঝকা করেছিল।

“আজ তার কেনা কাফনের কাপড় দিয়েই তাকে দাফন করা হয়েছে।”

Also Read: মিরসরাই দুর্ঘটনা: জীবন গড়ার পথ থামল রেলপথে

শুক্রবার দুপুরে খৈয়াছড়া লেভেল ক্রসিংয়ে উঠে পড়া তাদের মাইক্রোবাসটিকে ঠেলে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নিয়ে যায় আন্তঃনগর মহানগর প্রভাতী ট্রেন। ওই মাইক্রোবাসেই সকালে হাটহাজারীরে ‘আর অ্যান্ড জে’ কোচিং সেন্টার থেকে খৈয়াছড়ায় বেড়াতে গিয়েছিলেন ১৬ শিক্ষক-শিক্ষার্থী। এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় উপলক্ষে ওই পিকনিকে চালক ও সহকারীসহ ১৮ জন ছিলেন।

ট্রেনের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই ১১ জন নিহত হন, ছয়জন চিকিৎসাধীন আছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিউরো সার্জারি ওয়ার্ডে।

শনিবার সকালে হিশামের শিক্ষালয় কে এস নজু মিয়া উচ্চবিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে তার মরদেহ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

কাছাকাছি সময়ে খন্দকিয়া ছমদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে নিহত জিয়াউল হক সজীব, রিদুয়ানুল চৌধুরী, সামিরুল ইসলাম হাসান, ইকবাল হোসেন মারুফ ও মাইক্রোবাস চালক গোলাম মোস্তফা নিরুর জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।

দুই জানাজাতেই অংশ নেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ সালামসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিপুল সংখ্যক মানুষ।

দাফন শেষে হিশামের চাচা মোহাম্মদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, দুই ভাই দুই বোনের সবার ছোট হিশামের বড় ভাই থাকেন স্পেনে, বড় বোন কানাডা প্রবাসী। অপর বোন ঢাকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। আড়াই বছর আগে তার মা কানাডায় হিশামের বোনের কাছে গেছেন।

Also Read: কী ঘটেছিল খৈয়াছড়া রেল ক্রসিংয়ে?

মায়ের সঙ্গে হিশামেরও কানাডায় যাওয়ার কথা থাকলেও ভিসা জটিলতায় আর যাওয়া হয়নি। সামনে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই মা-বোনের কাছে যাওয়ার কথা ছিল তার।

“হিশাম কোচিং সেন্টার থেকে পিকনিকে যাওয়ার বায়না ধরলেও আমার মেঝ ভাই তাকে যেতে দিতে চাননি। কিন্তু তার কোচিং এবং গৃহশিক্ষক রাকিবের অনুরোধে পিকনিকের আগের দিন বৃহস্পতিবার যেতে দিতে রাজি হয়েছিলেন।”

ওই শিক্ষকও দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন।

হোসেন বলছিলেন, “পিকনিকের আগে আমাদের কাছ থেকে এবং মায়ের সাথে ভিডিও কলে কথা বলে বিদায় নিয়েছিলেন। সকাল ১০টায় সেখানে পৌঁছানোর পর আমাকে জানিয়েছে, নিরাপদে পৌঁছেছে। কিন্তু জুমার নামাজ শেষ হওয়ার পর শুনতে পেলাম, খৈয়াছড়ায় ট্রেন-মাইক্রোবাসের সংঘর্ষের খবর।”

এ সময় হিশামের মোবাইল ফোন বন্ধ পেয়ে বাড়িতে এসে সবার সাথে কথা বলে হোসেন ও তার ভাই আকবর ছুটে যান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

“সেখানে আহত অবস্থায় আনা সাত জনের মধ্যে তাকে না পেয়ে আমাদের আর কিছুই বোঝার বাকি রইল না…”, বলছিলেন শোকার্ত হোসেন।

তিনি যখন বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে ভাতিজাকে হারানোর বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন পাশে দাঁড়িয়ে ডুকরে কাঁদছিল হিশামের বন্ধুরা। আর আকবরকে শান্ত্বনা দিচ্ছিলেন প্রতিবেশীরা।