কী ঘটেছিল খৈয়াছড়া রেল ক্রসিংয়ে?

ঝর্ণা দেখার আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফেরা হল না হাটহাজারীর ১১ জনের; মিরসরাইয়ের একটি রেল ক্রসিংয়ে দ্রুতগামী ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ গেল তাদের।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীমিরসরাই ঘুরে এসে চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 July 2022, 07:53 PM
Updated : 29 July 2022, 07:53 PM

সকালে গিয়ে বিকালের মধ্যেই পাশের উপজেলা থেকে ঝর্ণা দেখে ফেরার কথা ছিল তাদের; দুপুরের দিকে কারও এক ‘ভুলে’ আনন্দ আয়োজন পরিণত হয় বেদনায়, কান্নায় রোল ওঠে তাদের বাড়িতে।

অরক্ষিত একটি রেল ক্রসিং হয়ে ওঠে প্রাণ সংহারী। দ্রুতগ্রামী ট্রেনের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ যায় এক মাইক্রোবাসে থাকা ১১ জনের। আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন আরও ছয়জন।

বিষাদ ছড়ানো সংবাদ শিরোনাম হওয়া চট্টগ্রামের সেই ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনার ঠিক আগেই সেখান দিয়ে ঢাকার পথে ছুটে গেছে আরেকটি ট্রেন। অন্য সময়ের মত স্বাভাবিকই ছিল সবকিছুই।

একটু পরেই ঘটে যায় মারাত্মক সেই দুর্ঘটনা; চট্টগ্রামমুখী মহানগর প্রভাতী ট্রেনেরও কাছাকাছি সময়ে ওই ক্রসিং অতিক্রম করার সময় ছিল। তবে সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায় সেই রেল লাইনে পর্যটক ভর্তি একটি মাইক্রোবাস উঠে পড়লে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্রুতগামী ট্রেনের সামনে পড়ে যায় সেটি, ঘটে যায় ভয়ানক এক দুর্ঘটনা।

চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ‘খৈয়াছড়া ঝর্ণা রেল ক্রসিং’ নামে পরিচিত ওই এলাকায় ট্রেনটির প্রবল ধাক্কায় মাইক্রোবাস থেকে সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে পড়েন ৬ জন, বাকিদেরসহ গাড়িটিকে ঠেলে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে বড়তাকিয়া রেল স্টেশনের কাছাকাছি নিয়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেনটি।

ট্রেনের ধাক্কায় দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া মাইক্রোবাসের বিভিন্ন অংশ এবং গ্যাস সিলিন্ডারটি ঘটনাস্থলের পাশের জমিতে আছড়ে পড়ে। গাড়িটিকে যতদূর ঠেলে নিয়ে গেছে ট্রেনটি ততদূরই ছিল ভয়াবহ এ দুর্ঘটনার নানান চিহ্ন।

ঘটনাস্থলে রক্তমাখা জুতা, ভাঙা মোবাইল, গাড়ির বিভিন্ন অংশ পড়েছিল। সেখানকার রেললাইন ও আশেপাশের মাটি ও ঘাস ছিল রক্তমাখা। পড়েছিল একটি পানির বোতলও।

রেল ক্রসিংয়ে মাইক্রোবাসের উঠে পড়ার সেই ক্ষণের ‘ভুলটি’ কোথায় বা কার- সেটি নিয়ে চলছে দিনভর আলোচনা। মাঝ দুপুরের ওই ঘটনার সময় আশেপাশে মানুষের উপস্থিতি কম থাকায় কোথা থেকে কীভাবে, কী করে ঘটেছে সেটির সুষ্পষ্ট বর্ণনাও পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা।

পূর্ব রেলের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এত জন মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আমরা জানতে চাই আসলে কী ঘটেছিল। দুটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে তাদের তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

"গেটম্যান দাবি করলেও তদন্তের পরই বলা যাবে গেট ফেলা হয়েছিল কি না। নাকি মাইক্রোবাস চালকের গাফিলতিতে এ ঘটনা। এখনই চূড়ান্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।"

শুক্রবার দুপুর দেড়টার দিকে এ দুর্ঘটনায় চট্টগ্রামমুখী আন্তঃনগর মহানগর প্রভাতী বড়তাকিয়া স্টেশনে প্রবেশের আগে রেলক্রসিংয়ে লাইনে উঠে পড়া মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দেয়। এতে গাড়িটি দুমড়েমুচড়ে তাতে থাকা ১১ জনের প্রাণহানি ঘটে। আহত ছয়জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

হতাহতরা চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার আমানবাজার এলাকা থেকে শুক্রবার সকালে মাইক্রোবাসে করে খৈয়াছড়া ঝর্ণা দেখতে গিয়েছিলেন। দুপুরে ফেরার পথে তারা ওই ভয়াবহ দুর্ঘটনার মুখে পড়েন।

মাইক্রোবাসটিতে চালক-সহকারীসহ মোট ১৮ জন ছিলেন। হতাহতদের বেশিরভাগেরই বয়স ১৮ থেকে ২৫ এর মধ্যে।

রেল ক্রসিংয়ে গেট বন্ধ বার ফেলা হয়েছিল?

পূর্ব রেলের মহাব্যবস্থাপক জানান, ওই রেল ক্রসিংয়ে তাদের নিজস্ব কোনো কর্মচারী নেই। অস্থায়ীভাবে নিয়োগ পাওয়া দুজন দিনেরাতে পালা করে গেটে দায়িত্ব পালন করে।

ক্রসিংয়ের দুই পাশের ফলকেও লেখা আছে "এখানে কোনও গেটম্যান নেই। সাবধানে নিজ দায়িত্বে পারাপার করবেন।"

শুক্রবার দিনের পালায় সাদ্দাম হোসেন নামের গেটম্যানের দায়িত্ব ছিল। রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে সাদ্দামের দাবি, তার নিষেধের পরও বিপরীত পাশে থাকা ক্রসিং বারটি তুলে মাইক্রোবাসটি লাইনে উঠে যায়।

তবে স্থানীয়দের মধ্যে কারও দাবি, উত্তর-দক্ষিণমুখী রেললাইনের দুপাশে পশ্চিম ও পূর্বপাশের ক্রসিং বার দুটি ফেলা থাকলেও গেটম্যান ঘটনার সময় সেখানে ছিলেন না।

একারণে মাইক্রোবাস চালক পূর্ব পাশের (খৈয়াছড়া ঝর্ণার দিকের) ক্রসিং বারটি তুলে লাইনে উঠে পড়েন গাড়ি নিয়ে।

ঘটনার কিছু আগে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী একটি ট্রেন ওই ক্রসিং অতিক্রম করে। এর কিছুক্ষণ পর ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী মহানগর প্রভাতী সেখানে পৌঁছায়।

প্রথম ট্রেনটি চলে যাওয়ায় আর ট্রেন আসবে না ধরে নিয়ে মাইক্রোবাসের চালক তাড়াহুড়োয় লাইনে উঠে পড়েন।

তবে ওই রুটের সিএনজি চালকদের দাবি, ক্রসিং এ লোহার বার ফেলা থাকলেও তা হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ওঠানোর সময় ট্রেন দেখতে পাওয়ার কথা মাইক্রোবাস চালকের। তাদের দাবি, ক্রসিং বার ফেলাই হয়নি।

গেটম্যান ছিলেন কি না এবং বার ফেলা হয়েছে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল, রেল পুলিশ ও বড়তাকিয়া স্টেশন মাস্টারও।

ঘটনার পর থেকে গেটম্যান সাদ্দামের হদিস মেলেনি। পরে বিকেল ৫টার দিকে ক্রসিং এলাকায় এলে তাকে আটক করে পুলিশ। এসময় উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে তাকে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। দ্রুত তাকে পুলিশের গাড়িতে তোলা হয়।

কী ঘটেছিল রেল ক্রসিংয়ে

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই অংশ থেকে গ্রামীণ একটি পাকা সড়ক চলে গেছে খৈয়াছড়া ঝর্ণার দিকে। ওই সড়ক ধরে দুই কিলোমিটার গেলে পথে পড়বে সেই রেল ক্রসিং। সেটি পেরিয়ে পশ্চিম পাশ থেকে সড়কটি ধরে আরও কিছু দূর গেলে ঝর্ণা।

সকালে গিয়ে ঝর্ণা দেখা শেষে পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসটি ফিরছিল। বেলা দেড়টার দিকে সেটি পৌঁছে ক্রসিং এলাকায়।

গেটম্যান সাদ্দামকে উদ্ধৃত করে পূর্ব রেলের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "সাদ্দাম হোসেন বলছে, দুটি গেটই সে ফেলেছিল।

"চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি চলে যায়। এরপর ঢাকার দিক থেকে আসতে থাকা ট্রেনটি তখনও আসেনি। গেটম্যান মাইক্রোবাসটিকে লাল পতাকা নেড়ে নিষেধ করেছিল। তারপরও মাইক্রোবাস চালক বিপরীত দিকের বার তুলে লাইনে উঠে যায়। তখনই ট্রেনটি এসে পড়ে।"

প্রথম ধাক্কাতেই ছিটকে পড়ে ৬ জন

রেল ক্রসিংয়ে ট্রেনটি প্রবল বেগে ধাক্কা দিলে মাইক্রোবাস থেকে ছিটকে যান ছয়জন। বিকট শব্দে আশেপাশে থাকা স্থানীয়রা এগিয়ে আসেন। তাদের সঙ্গে খৈয়াছড়া ঝর্ণা রুটে চলাচলকারী সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকরা আহতদের উদ্ধার করে মিরসরাইয়ের মস্তান নগরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান।

প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখেন, ধাক্কার পর ট্রেনের ইঞ্জিনের সঙ্গে আটকে যাওয়া মাইক্রোবাসটিকে ঠেলে বড়তাকিয়া স্টেশনের দিকে এগিয়ে যায় মহানগর প্রভাতী।

এসময় খৈয়া ছড়া ঝর্নার দিক থেকে ফিরছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা মোটর মেকানিক মো. আরাফাত।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "ট্রেন মারার সাথে সাথে মাইক্রোর কাঁচ ভেঙে একজন বাইরে পড়ে যায়। ওই লোক উঠে দাঁড়িয়ে যায়। তার তেমন কিছু হয়নি।

"ওই লোকসহ মোট ৬ জন গাড়ি থেকে পড়ে যায়। যে সিএনজিতে ছিলাম সেটার চালক আর আমি মিলে আহত দুজনকে আমাদের সিএনজিতে তুলি। যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে আহতদের নিয়ে হাসপাতালে যাই।"

আরাফাত বলেন, "আহতদের মধ্যে একজন ঘাড়ে ব্যথা পেয়েছে বেশি। অন্যজনের রক্ত পড়ছিল। বাকি চারজনকেও অন্য সিএনজির লোকজন তুলে হাসপাতালে নিয়ে যায়।"

খৈয়া ছড়া ঝর্ণা ক্রসিংয়ের পাশের একটি মুদি দোকানের মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "ঘটনার সময় গেটম্যান ছিল না। সে গেট ফেলে নামাজ পড়তে গিয়েছিল।"

স্থানীয় এক বাসিন্দার অভিযোগ, ঝর্ণা রুটে চলাচলকারী সিএনজি অটোরিকশা চালকরা গেটম্যান না থাকলে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ক্রস বার তুলে রেললাইন পেরিয়ে যায়।

এ বিষয়ে খৈয়াছড়া ঝর্ণা রুট সিএজি সমিতির সভাপতি মো আনোয়ার হোসেন বলেন, "আমাদের চালকরা কখনই সিগন্যাল অমান্য করে না। নিয়ম মেনেই তারা গাড়ি চালায়। দুর্ঘটনার সাথে সাথে ছিটকে পড়া ৬ জনকে উদ্ধার করে আমাদের সিএনজি চালকরাই হাসপাতালে নিয়ে যায়।"

দুর্ঘটনার সময় ক্রসিংয়ের বার ফেলা ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, "সেটা আমি জানি না। খবর পেয়ে ১৫ মিনিট পর সেখানে পৌঁছাই।"

রেলওয়ে পুলিশের ওসি নাজিম উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্থানীয়রা বলেছেন, "ঘটনার সময় গেটম্যান সেখানে ছিল না। তাকে আমরা আটক করেছি। নিয়মিত মামলা হবে। কী ঘটেছিল সেটা জিজ্ঞাসাবাদের পর বলতে পারব।"

ট্রেন হেঁচড়ে নিয়ে যায় অনেকটা পথ

ইঞ্জিনের সঙ্গে আটকে থাকা মাইক্রোবাসটিকে আরও প্রায় দেড় কিলোমিটার ঠেলে নেয় ট্রেনটি। তারপর থেমে যায়। ততক্ষণে দুমড়ানো গাড়ির ভেতর থাকা যাত্রীরা মারা গেছেন।

এ পথ পেরোনোর সময় মাইক্রোবাসের বিভিন্ন অংশ টুকরো টুকরো হয়ে রেল লাইন ও আশেপাশে ছিটকে পড়ে।

মাইক্রোবাসের ভিতর থেকে মরদেহ উদ্ধার করে বড়তাকিয়া স্টেশনে নিয়ে রাখা হয়।

উদ্ধারে সহযোগিতাকারী স্থানীয় বাসিন্দা মো. ফরহাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "গাড়ির ভিতর থেকে অনেক কষ্টে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন নিহতদের বের করে। খুবই ভয়াবহ অবস্থা।"

ওই ট্রেনের এক যাত্রী মো. রব্বানী সাংবাদিকদের বলেন, ক্রসিংয়ে যখন একটা শব্দ হয় আমরা তখন কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। শুধু সাদা কিছু একটা দেখতে পাই। পরে ট্রেন থেমে গেলে দেখি মাইক্রোবাস। সেটার ভেতর এত লাশ এটা আমরা কল্পনাও করিনি।

রেল পুলিশের এসপি মো. হাসান চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "মাইক্রোবাস থেকে আমরা ১১টি লাশ উদ্ধার করেছি। গাড়িতে আরো লোক ছিল বলে শুনেছি। আমরা পৌঁছার আগেই তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

"দুর্ঘটনার জন্য কারও অবহেলা বা দায় দায়িত্ব ছিল কি না সেটা তদন্তের পর বলা সম্ভব হবে।"

রাতেই মরদেহ হস্তান্তর

দিনের বেলা নিহতদের পরিচয় জানা যায়নি। তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর শুক্রবার রাতেই রেল পুলিশের পক্ষ থেকে পরিবারের সদস্যদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে।

নিহতরা হলেন- এসএসসি পরীক্ষার্থী মোহাম্মদ হাসান ও মোসহাব আহমেদ হিসাম (১৬), শিক্ষার্থী সাগর, ইকবাল হোসেন মারুফ ও আয়াতুল ইসলাম, কোচিং সেন্টারের শিক্ষক জিয়াউল হক সজীব (২২), ওয়াহিদুল আলম জিসান (২৩), মোস্তফা মাসুদ রাকিব (১৯) ও রিদুয়ান চৌধুরী (২২) এবং মাইক্রোবাস চালক গোলাম মোস্তফা নিরু (২৬) ও মোহাম্মদ মাহিম।