মিরসরাই দুর্ঘটনা: জীবন গড়ার পথ থামল রেলপথে

“টেলিভিশনে দুর্ঘটনার সংবাদ দেখে তার মাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি। লাশের মতো শুয়ে থাকা অবস্থায় কয়েকজনের মধ্যে তার ছবি দেখেছি।”

মিন্টু চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 July 2022, 06:39 PM
Updated : 29 July 2022, 06:39 PM

টাকা ধার করে বন্ধুদের নিয়ে কোচিং সেন্টার দিয়েছিলেন জিয়াউল হক সজীব; লেখাপড়ার পাশাপাশি সেই কোচিংয়েই ভাগ্য ফেরানোর স্বপ্ন বুনছিলেন। ‘আর অ্যান্ড জে প্রাইভেট কেয়ার’ নামের কোচিং সেন্টারের এ উদ্যোক্তার স্বপ্ন কেড়েছে মিরসরাইয়ের ট্রেন-মাইক্রোবাসের ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

শুক্রবার বিকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আহাজারি করে সে কথাই বলছিলেন সজীবের বাবা মোহাম্মদ হামিদ। তার পাশে মুর্ছা যাচ্ছিলেন সজীবের ছোট ভাই তৌসিফ।

দুর্ঘটনার সংবাদ শুনে হামিদ সজীবকে খুঁজতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে আসেন। সেখানে মৃত্যু সংবাদ শুনে আহাজারিতে ভেঙে পড়েন।

সজীবদের বাড়ি হাটহাজারী আমান বাজার যোগীরহাট এলাকায়। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে বড় সজীব চট্টগ্রাম শহরের ওমরগণি এমইএস কলেজের সম্মান প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। অর্থাভাবে তার পড়ালেখায় একবছর ছেদ পড়ে।

হামিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “টাকার অভাবে ও (সজীব) সেকেন্ড ইয়ারে ভর্তি হতে পারেনি। পড়ালেখার সাথে টিউশনি করে অর্থ উপার্জন করার জন্য বন্ধুদের সাথে কোচিং সেন্টার দিয়েছিল। কোচিংয়ের শিক্ষক-ছাত্ররা মিলে শুক্রবার মিরসরাই বেড়াতে গিয়েছিল।”

কোচিং সেন্টারের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি একটি লেভেল ক্রসিয়ে উঠে গেলে চট্টগ্রামমুখী মহানগর প্রভাতী তাতে ধাক্কা দেয়, দুমড়েমুচড়ে যাওয়া ওই গাড়িতে থাকা ১৮ জনের মধ্যে ১১ জন ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান।

জুমার নামাজের পর প্রতিবেশী এক নারীর কাছ থেকে দুর্ঘটনার খবর শুনে হামিদ মিরসরাইয়ে রওনা দিয়েছিলেন। পরে আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার সংবাদ শুনে মেডিকেলে আসেন। সেখানে সজীবসহ অন্যদের মারা যাওয়ার খবর পান।

সজীবের মামাতো ভাই রাকিব মোবাইল ফোনে একটি গ্রুপ ছবি দেখিয়ে বলেন, “এটা ছিল শুক্রবার সকালে মিরসরাই রওনা দেওয়ার আগে তাদের সর্বশেষ ছবি।... এরকম ছবি আর তাদের তোলা হবে না।”

দুপুরের পর থেকে দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বজনরা ভিড় করতে থাকেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে। স্বজনদের আহাজারিতে জরুরি বিভাগের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।

খৈয়াছড়া লেভেল ক্রসিংয়ে উঠে পড়া মাইক্রোবাসটিকে ঠেলে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নিয়ে যায় আন্তঃনগর মহানগর প্রভাতী ট্রেন। ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় নিহতরা হাটহাজারী উপজেলার আমান বাজার ও আশেপাশের এলাকার বাসিন্দা এবং বেশিরভাগই শিক্ষার্থী।

বিকালে স্ত্রীকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলে ছেলে মোস্তফা মাসুদ রাকিবকে (২২) খুঁজতে আসেন প্রবাসী মোতাহার হোসেন খান।

তিনি জানান, তার বাড়ি হাটহাজারীর নজু মিয়া হাট এলাকায়, কিন্তু তার ছেলে আমান বাজার এলাকায় নানাবাড়িতে থেকে পড়ালেখা করতেন। বন্ধুরা মিলে কোচিং সেন্টার দিয়ে সেখানে পড়াতেন।

অশ্রুভেজা কণ্ঠে তিনি বলেন, সকাল ১০টার দিকে শেষবার মোবাইলে কথা হয়েছিল ছেলের সঙ্গে।

“টেলিভিশনে দুর্ঘটনার সংবাদ দেখে ওর মাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি। ছবিতে দেখিছি লাশের মতো শুয়ে আছে কয়েকজন, ওখানে রাকিবকেও দেখেছি।”

ভবিষ্যতে সন্তানকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠানোর পরিকল্পনা করছিলেন মোতাহের, তা আর হবে না।

“ও জিয়াউর রহমান ডিগ্রি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছিল। পড়লেখা শেষ হলে বিদেশে পাঠাব ভেবেছিলাম। কিন্তু কী যে ঘটে গেল!”

এসএসসি পরীক্ষার্থী মোসাব আহমেদ হিশামকে (১৬) খুঁজতে হাসপাতালে এসেছেন তার দুই চাচা আকবর হোসেন মানিক ও মোহাম্মদ হোসেন।

পিতৃহীন হিশাম আমান বাজার এলাকায় তার চাচাদের সাথেই থাকত। তার মা থাকেন কানাডায়। নজু মিয়া স্কুল থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল তার। সেই প্রস্তুতি নিতে ‘আর অ্যান্ড জে প্রাইভেট কেয়ারে’ কোচিং করতে যেতে।

হিশামের মৃত্যুর খবর শুনে চাচা আকবর কান্নাকাটি করতে করতে হাসপাতালের মেঝেতে গড়াগড়ি দিচ্ছিলেন।

আরেক চাচা মোহাম্মদ হোসেন বলেন, “সে ওই কোচিং সেন্টারে পড়ত। ওখানকার শিক্ষক-ছাত্ররা মিলে পিকনিকে যাবে বলে সকাল ৮টায় ঘর থেকে বের হল। তখনই ওর সাথে শেষ কথা হয় আমাদের।

“ওর মা বিদেশে থাকে। দুর্ঘটনার খবর শুনে আমরা হাসপাতালে এসেছি। ওর মাকে কীভাবে সংবাদটা দেব।”