ঢাকার রাজপথ যেদিন ভাষা শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হল, তার প্রতিবাদে সেসময়ের সবচেয়ে বড় জনসভাটি হয়েছিল চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে। সে স্মৃতি কতটা ধরে রেখেছে বীর চট্টলা?
Published : 21 Feb 2022, 02:01 PM
পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে ফুঁসে ওঠে বাঙালি; ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল নামে ঢাকায়। স্লোগান ওঠে- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। শাসকের বন্দুক উগরে দেয় গুলি, রক্তের দামে আসে বাংলার স্বীকৃতি।
সেদিন বিকালেই মিছিল করে লালদীঘি মাঠে গিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল চট্টগ্রামের ছাত্রজনতা। পরদিন মাঠের কাছেই নির্মিত হয় শহীদ মিনার। মাঠের চারপাশের সড়কগুলোর নামকরণ করা হয় ভাষা শহীদদের নামে।
একুশের প্রথম কবিতা রচনা করেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। সেই কবিতা ২৩ ফেব্রুয়ারি পাঠ করা হয় লালদীঘি মাঠের জনসভায়। দুদিন পর ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে হয় বিশাল প্রতিবাদ সভা।
চট্টগ্রামে গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে ছিলেন প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। চট্টগ্রাম কলেজ ও ডা. খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও চট্টগ্রামের সেসব কর্মসূচিতে শামিল হয়েছিলেন।
সিটি মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলছেন, নগরীতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর হলে সেখানে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণের ইচ্ছা তার আছে। সে লক্ষ্যে তিনি উদ্যোগ নেবেন।
‘চটগ্রামে ভাষা আন্দোলন’ গ্রন্থের রচয়িতা গবেষক শরীফ শমশির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনের সূচনা ১৯৪৭ সাল থেকে। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মীরা সেসময় জনমত তৈরিতে কাজ শুরু করেন। ‘সীমান্ত’ পত্রিকা এবং একে ঘিরে গড়ে ওঠা সংগঠন ‘সাংস্কৃতিক বৈঠক’ তাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
দৈনিক আজাদী পত্রিকার ৩৫ বর্ষপূর্তির বিশেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হাজার বছরের চট্টগ্রাম গ্রন্থে বলা হয়েছে, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ভাষা আন্দোলন শহরে বাধা পেলে তা গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। সে বছর ১১ মার্চ চট্টগ্রামের কানুনগোপাড়া কলেজ ও স্কুল, ধলঘাট, কেলিশহর, সারোয়াতলী, কাটিরহাট, নানুপুর, নোয়াপাড়া, আর্যমিত্র, কোয়েপাড়া, মহামুনি, রাধারানী প্রভৃতি স্কুলের হাজার হাজার ছাত্র বাংলাকে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ধর্মঘট পালন করে।
১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান চট্টগ্রামে এলে তমদ্দুন মজলিশের দুই নেতা ফরমান উল্লাহ ও মো. ইসহাক শিক্ষামন্ত্রীকে আরবি হরফে বাংলা চালুর প্রতিবাদে স্মারকলিপি দেন। সেজন্য তাদের চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
গবেষক শরীফ শমশির জানান, ১৯৫১ সালের ১৬-১৯ মার্চ হরিখোলার মাঠে (বর্তমান হিন্দু ফাউন্ডেশন ভবন এলাকা) অনুষ্ঠিত দেশের প্রথম সাংস্কৃতিক সম্মেলনের সভাপতি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রাখেন।
নগরীর আন্দরকিল্লায় সে সময়ের আওয়ামী মুসলিম লীগের কার্যালয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি হওয়া সভায় রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতিকর্মী, ছাত্র ও যুবনেতাদের সমন্বয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
ইতিহাস বিষয়ক সাময়িকী ‘ইতিহাসের খসড়া’ সম্পাদক মুহাম্মদ শামসুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই সভায় সাংস্কৃতিক সংগঠক মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে আহ্বায়ক এবং রেলওয়ে শ্রমিক নেতা চৌধুরী হারুনর রশিদ ও আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে কমিটি হয়।”
ওই কমিটিতে আরও ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী, শেখ মোজাফফর আহমদ, আমির হোসেন দোভাষ, ডা. আনোয়ার হোসেন, তমদ্দুন মজলিস নেতা আজিজুর রহমান, যুব সংগঠক কৃষ্ণ গোপাল সেন (কালাচাঁদ), ছাত্রনেতা এমদাদুল ইসলাম, আবু জাফর, ডা. সৈয়দুর রহমান, আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা আজিজুর রহমান (গোরা আজিজ)।
ইতিহাসবিদ মুহাম্মদ শামসুল হক বলেন, ভাষা আন্দোলনে সে সময় সাহিত্যিক আবুল ফজল, ডা. কামাল এ খান, সাইফুদ্দিন খান, মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমীসহ আরও অনেকে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।
২১ ফেব্রুয়ারি সকালে চট্টগ্রামে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়। রেলওয়ে ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউটে সমবেতরা ঢাকায় গুলির খবর পান বেলা আড়াইটায়। তখনই তারা মিছিল নিয়ে লালদীঘি মাঠে যায় এবং সেখানে সমাবেশ করে।
একুশের প্রথম কবিতার রচয়িতা মাহবুব উল আলম চৌধুরী ‘আমার স্মৃতিতে ভাষা আন্দোলন’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “আন্দরকিল্লা থেকে চৌধুরী হারুনর রশিদ ও পরিষদ নেতারা প্রতিবাদ মিছিল বের করেন। শহরের প্রধান প্রধান সড়ক অতিক্রমকালে দোকানপাট স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ হয়ে যায়।… চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রী প্রতিভা মুৎসুদ্দি, তালেয়া রহমান ছোট একটি মিছিল নিয়ে খাস্তগীর গার্লস স্কুলে উপস্থিত হয়।”
সেখান থেকে খাস্তগীর স্কুলের ছাত্রীরা মিছিল বের করে ট্রাকে শহর প্রদক্ষিণ করে বলে বইয়ে উল্লেখ করেছেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী।
সে সময় জলবসন্তে আক্রান্ত মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে ঢাকায় গুলির খবর দেন ছাত্র ফেডারেশন সদস্য ননী ধর। এরপর মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচনা করেন একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। ননী ধর সেটি লিখে নেন।
গবেষক শরীফ শমশির বলেন, আন্দরকিল্লায় ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের মালিকানাধীন কোহিনূর ইলেকট্রিস প্রেসে গোপনে কবিতাটি ছাপানো হয়। কামাল উদ্দিন আহমদ খানের অনুরোধে প্রেস ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরী কবিতা ছাপানোর দায়িত্ব নেন।
“কবিতাটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশের অপরাধে ২৩ ফেব্রুয়ারি দবির আহমদ চৌধুরী গ্রেপ্তার হন। বন্ধ করে দেওয়া হয় কোহিনূর প্রেস। ২৩ ফেব্রুয়ারি লালদীঘির জনসভায় একুশের প্রথম কবিতা পাঠের পর গ্রেপ্তার করা হয় চৌধুরী হারুনর রশিদকে। হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে যান কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী।”
শরীফ শমশির বলেন, লালদীঘি মাঠের কাছে খুরশিদ মহলের সামনের স্থানটির তখন নাম ছিল ভিক্টোরিয়া পার্ক। বর্তমানে যেখানে পেট্রোল পাম্প। সেখানে ২২ ফেব্রুয়ারি নির্মাণ করা হয় চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ মিনার।
শরীফ শমশির বলেন, “২৩ ও ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। তখনকার সংবাদপত্রের তথ্য মতে সারাদেশে ২১ ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ সমাবেশ হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি মাঠে। সব শ্রেণি পেশার মানুষ পুরো জেলা থেকে সেদিনের সভায় এসেছিল।”
ইতিহাসের খসড়া সম্পাদক মুহাম্মদ শামসুল হক বলেন, ওই জনসভার সিদ্ধান্তের আলোকে নগরীর চারটি সড়কের নাম ভাষা শহীদদের নামে নামকরণ করা হয়েছিল। যেহেতু তখন পাকিস্তানের শাসন, তাই ১৯৫৬ সালের পর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি সংরক্ষণে তখন আর উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
“একুশের প্রথম কবিতা রচনা এবং লালদিঘী ময়দানে একুশের প্রথম কবিতা পাঠ আমাদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ইতিহাস সংরক্ষণে অবশ্যই উদ্যোগ নেওয়া উচিত। লালদীঘির মাঠে স্মৃতি ফলক স্থাপন করে এই ইতিহাস তুলে ধরা যেতে পারে। পাশাপাশি প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের স্থানটিতে ও কোহিনূর প্রেসে ইতিহাসের তথ্য স্মারক স্থাপন করা উচিত।”
চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পের আওতায় নতুন করে যে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হচ্ছে সেখানেও চট্টগ্রামের ভাষা আন্দোলনের জাদুঘর নির্মাণের দাবি জানান গবেষক শরীফ শমশির।
জানতে চাইলে সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চট্টগ্রাম পুরাতন সার্কিট হাউজে মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর করার বিষয়ে আলোচনা চলছে। ১৯৭১ সালে এখানে মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেক মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
“সেই ইতিহাস সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। এখানে জাদুঘর হলে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি সংরক্ষণে আলাদা স্থান বরাদ্দ রাখা হবে। শিগগির এ বিষয়ে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের সাথে আলাপ করে উদ্যোগ নেব।”