স্বাধীন দেশে চট্টগ্রামের একুশের প্রথম সংকলন ‘শেষ থেকে শুরু’

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারিতে একটি সংকলন প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন চট্টগ্রামের কয়েকজন তরুণ শিক্ষার্থী।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Feb 2018, 02:47 PM
Updated : 20 Feb 2018, 02:59 PM

লেখা ও প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় শেষে হাতে ছিল মাত্র একদিন। তাই ২০ ফেব্রুয়ারি সারারাত জেগে ছাপাখানায় সেই সংকলনটি ছাপা হয়।

একুশের ভোরে সেই সংকলন হাতে নিয়ে ছুটে যান শহীদ মিনারে- শ্রদ্ধা জানাতে। একুশে’র প্রতি সেই অর্ঘ্য শহীদ মিনারে সমবেতরা গ্রহণ করেছিলেন হৃদয়ের উষ্ণতায়।

১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত সেই সংকলনটির নাম ‘শেষ থেকে শুরু’।  

সেই সংকলনে লিখেছিলেন একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’র কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী।

৪৭ বছর পেরিয়ে সেই সংকলনটির খোঁজ মিলল ‘চট্টগ্রাম লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রে’।

সংকলনটির সম্পাদক সে সময়ের স্নাতক শ্রেণির ছাত্র সুদীপ দেওয়ানজী বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।

কেন সংকলন প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন জানতে চাইলে সুদীপ দেওয়ানজী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ““১৯৫২ সালে ভাষার দাবিতে আত্মদানকারী শহীদদের আত্মত্যাগে প্রাণিত হয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নের যাত্রা শুরু। লাখো শহীদের রক্তে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর এলো বহুল প্রতীক্ষিত সেই স্বাধীনতা।

“বায়ান্নো আর একাত্তরের শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে যাত্রা শুরুর সময় ছিল বাহাত্তর। সেজন্য প্রয়োজন ছিল আত্মোপলব্ধি ও আত্মচেতনা উন্মেষের। তাই একুশের চেতনায় আত্ম অনুসন্ধানের একটি প্রয়াস ছিল আমাদের সংকলন।”

সংকলনের নামকরণের বিষয়ে তিনি বলেন, “স্বাধীন দেশে নতুন করে একটা সংগ্রাম শুরু হবে। তাই ঠিক করেছিলাম নাম হবে ‘শেষ থেকে শুরু’।”

চট্টগ্রাম লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক কমলেশ দাশগুপ্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত এটি সম্ভবত প্রথম একুশের সংকলন।”

সংকলনটিতে লিখেছিলেন অধ্যাপক তপন চক্রবর্তী এবং অধ্যাপক শান্তি রঞ্জন ভৌমিক। অন্য লেখকরা ছিলেন অঞ্জন কান্তি দাশ, ইউসুফ পাশা, অমর বিন্দু চৌধুরী, প্রদীপ দেওয়ানজী, সৌমেন কান্তি দে, শফিকুল মান্নান, সুভাষ দত্ত ও সুদীপ দেওয়ানজী।

আটটি কবিতা ও তিনটি প্রবন্ধে সাজানো সংকলটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুটি, কাজী নজরুল ইসলামের একটি এবং জহির রায়হান ও শহীদুল্লাহ কায়সারের একটি করে কবিতাংশ ছাপা হয়েছিল। 

রাত জাগা ভোরে শহীদ মিনারে

সুদীপ দেওয়ানজী বলেন, “কয়েকজন বন্ধু আর অনুজ মিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিই সংকলন করব।” 

এরপর লেখা পেতে ছুটে গিয়েছিলেন একুশের প্রথম কবিতার কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর কাছে। তিনি লিখে দিয়েছিলেন ‘একুশের গান’ শিরোনামের কবিতাটি।

খরচ জোগাতে পরিচিতজনদের দ্বারস্ত হয়েছিলেন এই তরুণরা। সেকথা স্মরণ করে সুদীপ দেওয়ানজী বলেন, নগরীর দেওয়ান বাজারের আবদুল সোবহান চৌধুরী একশ টাকা দিয়েছিলেন।

“নিউ মার্কেটের নিচতলার ইস্টার্ণ ফটোগ্রাফিক এজেন্সিস এবং দেওয়ান বাজারের জনকল্যাণ ফার্মেসী দুটো বিজ্ঞাপন দেয়। বাকি টাকা নিজেদের পরিবার থেকে জোগাড় করেছিলাম।”

সংকলনের উদ্যোক্তাদের অন্যতম অমর বিন্দু চৌধুরী বলেন, “লেখার জন্য ছোটাছুটি আর টাকার জোগাড় শেষে দেখি একদিন বাকি। চিন্তায় পড়ে যাই, এত অল্প সময়ে কীভাবে কাজ শেষ হবে?”

নগরীর নন্দনকানন এলাকার দি ইষ্টার্ণ প্রেস নামের ছাপাখানার সুভাষ দত্ত তাদের ভরসা দেন।

সুদীপ দেওয়ানজী বলেন, “সুভাষ দত্ত অভয় দিয়ে বলেন, ‘একরাতেই সম্ভব’। তিনি সব সহযোগিতা করবেন।

“সারারাত ধরে ছাপা হলো। পুরো রাত কাটলো ছাপাখানায়। ভোর হতেই সংকলনটি হাতে নিয়ে ছুটে যাই চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।”

তিনশ কপি ছাপা হওয়া সংকলনটির মূল্য রাখা হয়েছিল ত্রিশ পয়সা। সংকলন প্রকাশনাকারী সংগঠন হিসেবে ছাপা হয় ‘আমরা ক’জন’ এর নাম।

অমর বিন্দু চৌধুরী বলেন, “শহীদ মিনারে আসা লোকজনের কাছে সেটি বিক্রি করেছি ঘুরে ঘুরে। কয়েকজন এক টাকাও দিয়েছিলেন। বিকেলের মধ্যে সব কপি বিক্রি হয়ে যায়।”

সংকলনের আরেক উদ্যোক্তা নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজী বর্তমানে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা দৈনিক আজাদীর ফিচার সম্পাদক।

তিনি বলেন, “সদ্য স্বাধীন দেশে একুশের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও নতুন যাত্রায় বায়ান্নর চেতনাকে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার তাগিদে এই সংকলন প্রকাশ করেছিলাম।  

“ওই সংকলনের সাথে যুক্ত থাকা ও সেখানে আমার একটি কবিতা ছাপা হওয়া খুবই মূল্যবান এবং অত্যন্ত গর্বের। এই গৌরব আমি সারাজীন ধারণ করব।

“বর্তমান প্রজন্ম বায়ান্ন ও একাত্তরের চেতনা ধারণ করে এগিয়ে গেলেই আমাদের স্বপ্ন সঠিক পথ খুঁজে পাবে।”