চট্টগ্রামে ফের আলোচনায় ‘হোল্ডিং ট্যাক্স’

চট্টগ্রাম নগরে ব্যক্তিমালিকানাধীন স্থাপনার কর বাড়ানোর উদ্যোগের ওপর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দেওয়া স্থগিতাদেশ চার বছর পর প্রত্যাহারের আবেদন করেছে সিটি করপোরেশন।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Jan 2022, 04:16 PM
Updated : 3 Jan 2022, 04:16 PM

চার বছর আগে সিটি করপোরেশন ব্যক্তিমালিকানাধীন স্থাপনার কর বাড়ানোর উদ্যোগ নিলে আন্দোলনের মুখে তা স্থগিত করেছিল মন্ত্রণালয়। সেই আন্দোলনকারীরা বলছেন, এখন আবার সেই হারে কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হলে ‘জনগণ’ আবারও আন্দোলনে নামবে।

সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, মন্ত্রণালয় কর পুনর্মূল্যায়নের ওপর থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করলে তারা ‘যৌক্তিক হার’ নির্ধারণ করবেন।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুল আলম রোববার স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবরে এ বিষয়ে চিঠি দেন।

ব্যক্তিমালিকানাধীন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের হোল্ডিং কর পুনর্মূল্যায়নের ওপর থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন করা হয় সেখানে।

১৯৮৬ সালের সিটি করপোরেশন (কর) বিধি অনুসারে পাঁচ বছর পর পর গৃহকর পুনর্মূল্যায়নের এখতিয়ার রাখে সিটি করপোরেশনগুলো।

সে অনুযায়ী ২০১৬-১৭ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ নিয়ে বিরোধিতার মুখে পড়ে।

আন্দোলনের মুখে ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগ তা স্থগিত করার নির্দেশনা দেয়। ফলে হোল্ডিং কর বাড়ানোর সেই চেষ্টা আর কার্যকর হয়নি।

সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের অনুমতি চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। মন্ত্রণালয় কী সিদ্ধান্ত দেয় তা জানার পর যেটা লজিক্যাল হবে মানুষের জন্য তাই করা হবে।”

বর্তমানে বন্দরনগরীতে ২০১০-১১ অর্থ বছরের র্মূল্যায়ন অনুসারে নির্ধারিত হারে কর আদায় করা হয়।

শহীদুল আলম বলেন, “এখন বিভিন্ন খাতে খরচ অনেক বেড়ে গেছে। ১০-১১ বছর আগের রেটে কর নিয়ে সেই খরচ নির্বাহ করা সম্ভব নয়।”

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, সিটি করপোরেশনের আয়ের মূল উৎস গৃহকর। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ, নগরীর আবর্জনা অপসারণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সড়ক আলোকায়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বহুমুখী কাজ গৃহকর ও রেট থেকে নির্বাহ করা হয়।

বর্তমান আয়ে ৬০ লাখ মানুষের নগরীতে ‘নাগরিক সেবা ও বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের’ ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে চিঠিতে জানানো হয়।

২০১৬ সালের মার্চে ‘পঞ্চবার্ষিকী কর মূল্যায়ন কর্মসূচি’র মধ্য দিয়ে নতুন করে হোল্ডিং এর কর নির্ধারণের কাজ শুরু করেছিলেন তখনকার মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। মূল্যায়ন শেষে ওই বছরের ৩১ অগাস্ট তা প্রকাশ করা হয়।

সেই মূল্যায়নে ১ লাখ ৮৫ হাজার ২৪৮টি স্থাপনার বিপরীতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮৫১ কোটি ৩০ লাখ ৬৪ হাজার টাকা গৃহকর নির্ধারণ করেন নাছির।

এরপর এ বিষয়ে আপিল করতে সময় বেঁধে দেয় সিটি করপোরেশন। নতুন কর মূল্যায়নের পর থেকেই নগরবাসী অতিরিক্ত হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলে।

পাশাপাশি ‘করদাতা সুরক্ষা পরিষদ’ নামের একটি সংগঠন নতুন পদ্ধতিতে ভাড়ার ভিত্তিতে হোল্ডিং ট্যাক্সের পরিবর্তে আগের নিয়মে স্থাপনার আয়তন হিসেবে হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ ও আদায়ের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে।

প্রয়াত নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ দলীয় নেতারাও তখন নাছিরের ওই উদ্যোগের বিরোধিতা করেন।

পরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে ওই উদ্যোগ আটকে যায়। পাশাপাশি মন্ত্রণালয় হোল্ডিং ট্যাক্স কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় এনে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কর পুনর্মূল্যায়ন স্থগিত রাখতে এবং আগের হারে গৃহকর আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়।

করদাতা সুরক্ষা পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক ও মুখপাত্র হাসান মারুফ রুমী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশে বিভিন্ন প্রকল্পের ব্যয় বিশ্বের অন্য দেশগুলোর তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। সরকারি অনেক প্রকল্পে মানুষ নানা রকম লুটপাটও দেখছে।

“এসবের সাথে জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ১৯৮৭ সালে স্বৈরশাসকের আমলে এই গৃহকর আইন হলেও তারা নিজেরাই সেটা বাস্তবায়ন করেনি। ৩০ বছর পর এসে সেটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয় ২০১৭ সালে।”

হাসান মারুফ রুমী বলেন, “সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনও বলেছিলেন আপিল করলে গৃহকর কমানো হবে। কিন্তু আপিলেও তা হয়নি। ৫-১০ গুণ পর্যন্ত বেড়েছিল গৃহকর। আবেদন-নিবেদন করেও কাজ হয়নি তখন। তারপর মানুষ আন্দোলনে নেমেছিল।

“এখন নতুন মেয়র যদি আবার সেটা করতে চান, নগরবাসী এর উপযুক্ত জবাব দেবে। নগরীর আদি বাসিন্দাদের হয়ত এক টুকরো জমি আছে। কয়েক ভাই-বোনের সেই জমি মাথা পিছু হিসেবে মাত্র কয়েকশ ফুট। শুধু মাথা গোঁজার ঠাঁই। আগের ২১০০ টাকা কর ২০১৭ সালের মূল্যায়নে বেড়ে হয়েছিল ২১ হাজার টাকা। এসব অবাস্তব।”

সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুল আলম বলেন, “মন্ত্রণালয় যদি স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে তারপর আমরা সবার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। অবশ্যই যৌক্তিক হার নির্ধারণ করা হবে। অযৌক্তিক কোনো কিছু করা হবে, এমন নয়।”

২০১৭ সালে হওয়া নতুন কর মূল্যায়নের আগে স্থাপনার আয়তনের (বর্গফুট) ভিত্তিতে হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধ করতে হত। সিটি করপোরেশন ২০১৭ সালে নতুন করে যে ১৭ শতাংশ হারে কর নির্ধারণ করেছিল, তার মধ্যে ৭ শতাংশ হোল্ডিং বাবদ, ৩ শতাংশ বিদ্যুতায়ন বাবাদ এবং আর্বজনা অপসারণের জন্য ৭ শতাংশ।

সেই পুনর্মূল্যায়ন অনুসারে যে কোনো বহুতল স্থাপনার সবগুলো ফ্ল্যাটের মোট বার্ষিক ভাড়া থেকে দুই মাসের ভাড়া বাদ যাবে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ হিসেবে।

ভবন মালিক যদি ঘর ভাড়া না দিয়ে শুধু নিজেই বসবাস করেন, সেক্ষেত্রে এ থেকে আরও ৪০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হবে।

এরপর বার্ষিক ভাড়ার যে মোট অঙ্ক বাকি থাকবে, তার উপর ১৭ শতাংশ কর দিতে হবে।

পুরনো নিয়মে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে সিটি করপোরেশন হোল্ডিং ট্যাক্স বাবদ ৩৪৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল। যদিও ওই অর্থ বছরে আদায় হয়েছিল ১০৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।

২০১৭ সালে হওয়া কর পুনর্মূল্যায়ন অনুসারে নগরীতে মোট হোল্ডিং আছে এক লাখ ৮৫ হাজার ২৪৮টি, যা আগের মূল্যায়নের হোল্ডিংয়ের চেয়ে ২৮ হাজার ৭০২টি বেশি।

আরও পড়ুন: