চট্টগ্রামের প্রায় শতবর্ষী, ঝুঁকিপূর্ণ কালুরঘাট সেতু দিয়ে প্রতিদিন পার হচ্ছে রেলসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন।
Published : 30 Jul 2019, 09:44 PM
স্থানীয়রা বলছেন, ৮৯ বছরের পুরনো সেতুটি আর বইতে পারছে না তার বার্ধক্যের ভার।
নতুন সেতু নির্মাণে এলাকাবাসীর দাবিতে আশ্বাস মিললেও তা বাস্তবে রূপ পায়নি বছরের পর বছর ধরে। এই কারণে
স্থানীয় সংসদ সদস্য পদত্যাগের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম নগরীর সঙ্গে বোয়ালখালী ও পটিয়া উপজেলার একাংশের যোগাযোগের মাধ্যম এই সেতু বন্দর নগরীর সঙ্গে কক্সবাজারের রেল যোগাযোগেরও অন্যতম সংযোগ।
১৯৩০ সালে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত হয় ৭০০ গজ দীর্ঘ কালুরঘাট রেল সেতু। ১৯৫৮ সালে এ সেতুটি সব ধরনের যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার।
সেতুটি এখন ভরে আছে নানা খানাখন্দে। জোড়াতালি দিয়ে সেতুর উপর দিয়ে প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে চলছে কয়েক হাজার যানবাহন ও কয়েক জোড়া ট্রেন।
সেতুটি নগরী লাগোয়া বোয়ালখালী উপজেলার মানুষের চলাচলের একমাত্র ভরসা। এই সেতু দিয়ে প্রতিদিন অন্তত ৫০ হাজার লোক পারাপার হয়।
চট্টগ্রাম শহর থেকে বোয়ালখালী উপজেলায় পৌঁছাতে যেখানে সময় লাগার কথা ৩০ থেকে ৪০ মিনিট, সেখানে একমুখী এ সেতু দিয়ে চলাচলে সময় লাগছে তিন থেকে চার ঘণ্টা।
এই সেতু দিয়ে প্রতিদিন চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারি রুটে চলাচল করে দুই জোড়া ট্রেন। দোহাজারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ফার্নেস ওয়েল আনা-নেওয়ার জন্যও ট্রেন চলে এই সেতু দিয়ে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল যোগাযোগ চালু হলে তারও পথ হবে এই সেতু।
৯০’র দশকে চট্টগ্রাম দোহাজারী রুটে ট্রেন চলাচল সীমিত হয়ে পড়লে কালুরঘাট সেতুতে যান চলাচলে চাপ বাড়ে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে দ্বিতীয় কর্ণফুলী সেতু ভেঙে গেলে কালুরঘাট সেতু হয়ে পড়ে নগরীর সাথে দক্ষিণ চট্টগ্রামের ছয়টি উপজেলা ও কক্সবাজার, বান্দরবান জেলার যোগাযোগের অন্যতম রাস্তা।
স্থানীয়দের দাবি, ২০১০ সালে তৃতীয় শাহ আমানত সেতুর উদ্বোধনের আগ পর্যন্ত কালুরঘাট সেতু দিয়ে ভারী যান চলাচলের কারণ সেতুটি আরও নাজুক হয়ে পড়ে।
২০০১ সালে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করার পর ২০০৪ ও ২০১২ সালে দুই দফায় এ সেতুটি বন্ধ রেখে সংস্কার কাজ করেছিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সেতুটিতে ছোটখাট সংস্কার কাজ করে যান চলাচলের উপযোগী করে রাখা হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সেতুর কালুরঘাট অংশ থেকে গোমদণ্ডী অংশের বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় শতাধিক গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। কিছু কিছু গর্ত ইট, বালু দিয়ে জোড়াতালি দেওয়া হলেও বাকি গর্তগুলোর উপর দিয়েই চলছে প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন।
রেল লাইনও বিভিন্ন স্থানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেতুর ২৯টি স্থানে রেলিংয়ের নিচে প্রায় ১৯৮ ফুট কাঠের পাতাটন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
বড় বড় ইট বালু দিয়ে গর্তগুলো ভরাট করে দেওয়া হলেও পুরো সেতু জুড়ে অসংখ্য গর্ত। এরমধ্যে ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন।
কালুরঘাট সেতু দিয়ে চলাচলকারী অটোরিকশা চালক মো. কালাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রতিদিন সেতুর গর্তে পড়ে কোন না কোন গাড়ি নষ্ট হচ্ছে। বৃষ্টি পড়লে এসব গর্ত আরও বিপজ্জনক হয়ে যায়।
তিনি জানান, গর্তে বৃষ্টির পানি জমে গেলে চালকরা বুঝতে পারেন না। গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় চাকা গর্তে পড়ে গিয়ে যন্ত্রাংশ ভেঙে যাচ্ছে। এছাড়াও বাইরের জেলার বড় ট্রাক এসে নিয়মিত দুর্ঘটনায় পড়ছে।
সেতুর বাঁকা রেলিংগুলো গাড়ির আরও ধাক্কায় বাঁকা হয়ে আরও ঝুঁকির সৃষ্টি করেছে বলেও জানান সেতুতে চলাচলকারী চালকরা।
সংকীর্ণ এই সেতু দিয়ে একসঙ্গে দুই দিকে যানবাহন চলাচল করতে পারে না। এক দিকের যানবাহন আটকে রেখে অন্যপাশের গাড়ি ছাড়া হয়। একমুখী চলাচলের এই ব্যবস্থার ফলে প্রতিদিনই যানজটে ভুগতে হয় চলতি পথের যাত্রীদের।
বোয়ালখালী উপজেলার বাসিন্দা সাংবাদিক রমেন দাশ গুপ্ত বলেন, “এখন ভয় লাগে এ সেতু দিয়ে চলাচল করতে। কিন্তু উপায় নেই… এটার বিকল্প কোনো ব্যবস্থাও নেই।
“এ সেতু পারাপারের সময় মনে হয় প্রাণ হাতে নিয়ে পার হচ্ছি। আমার মতো প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ঝুঁকি নিয়ে এ সেতু দিয়ে পারাপার করে। একটি মাত্র সেতুর কারণে নগরীর নিকটবর্তী বোয়ালখালী উপজেলা ও পটিয়ার একাংশকে মনে হয় বিচ্ছিন্ন।”
চট্টগ্রামের যে এলাকায় কালুরঘাট সেতু সেটি সংসদীয় আসন চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী)। এ আসনের টানা তিন বারের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক জাসদের নেতা মইনুদ্দীন খান বাদল।
গত ২৬ জুন জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে প্রবীণ এ সাংসদ সেতুর বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া না হলে আগামী ডিসেম্বরে সংসদ থেকে পদত্যাগেরও হুমকি দিয়েছেন।
বাদল মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার যতটুকু জানা, এখানে একটা দ্বিমুখী রেল সেতুর ডিজাইন সম্পন্ন হয়েছে। সেখানে সড়ক অংশের কোনো কথা নাই।”
সড়ক ও সেতুমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের দাবি রেল কাম সড়ক সেতু। তাই আমি মন্ত্রীকে একটা ডিও লেটার দিয়েছি।”
এই সেতু যাদের অধীনস্ত তাদের কার্যক্রম সরকারের সুনাম ক্ষুন্ন করছে কি না, তা খতিয়ে দেখার দাবিও জানান তিনি।
সেতুটির জীর্ণ দশা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বাদল বলেন, “ব্রিজে প্রতিদিন গাড়ি নষ্ট হচ্ছে, খবর হচ্ছে না। যদি কোনো গাড়ি নদীতে পড়ে যায়, তাহলে সবার খবর হবে। এই ব্রিজ থেকে যদি কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়, এটা তো কেউ কাঁধে নেবে না… তা শেখ হাসিনার কাঁধে উঠবে।”
কালুরঘাট সেতু নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে ‘বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদ’।
পরিষদের আহবায়ক আব্দুল মোমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সেতুতে যানজটে আটকে থেকে অনেক সময় অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে যাওয়া রোগীর প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটেছে।
তিনি বলেন, “১৯৯৬ সাল থেকে কালুরঘাটে সেতুর দাবি করে আসছিল বোয়ালখালীবাসী। আমরা ২০১৪ সাল থেকে রাজপথে আন্দোলন করে আসছি।
“গত বছর রেল কাম সড়ক সেতুর বিষয়টি একনেকে উঠেছিল। এতে আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম। কিন্তু অধিকতর সমীক্ষার কথা বলে প্রকল্পটি ফেরত পাঠানো হয়।”
সেতু আন্দোলনের নেতা মোমিন বলেন, “সম্প্রতি রেলমন্ত্রী বলেছে কালুঘাটে বিশেষায়িত রেল সেতু নির্মাণের কথা। কিন্তু আমাদের দাবি রেল কাম সড়ক সেতুর। শুধু রেল সেতু হলে দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসীর কোন উপকৃত হবে না। যদি সড়ক কাম রেল সেতু না হয় আমরা বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলব।”