মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে যে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন মুসলিম লীগ নেতার ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর সেই চট্টগ্রামের রাউজানেই তার কবর হয়েছে।
Published : 22 Nov 2015, 09:24 AM
রোববার সকালে রাউজানের গহিরা গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে ভাই সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরীর কবরের পাশে সাকা চৌধুরীকে দাফন করার আগে স্থানীয় একটি মসজিদে তার জানাজা হয়।
সাবেক মন্ত্রী ও ছয়বারের এমপি এই বিএনপি নেতার জানাজায় অংশ নেন শ’ খানেক মানুষ। ইমামতি করেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর মহিবুল্লা বাবুনগরী।
প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হয়ে যাওয়ার পর রোববার প্রথম প্রহরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও একাত্তরের বদর নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
এরপর রাত ২টা ৫৫ মিনিটে তাদের মৃতদেহ নিয়ে চট্টগ্রাম ও ফরিদপুরের পথে রওনা হয় অ্যাম্বুলেন্স।
পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সকাল ৯টার দিকে সাকা চৌধুরীদের বাড়ি ‘বাইতুল বিলাল'- এ পৌঁছায় তার লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি। সাকার ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার মাজহারুল ইসলামের কাছ থেকে লাশ বুঝে নেন।
সাকার স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী ও তাদের দুই ছেলে হুম্মাম ও ফাইয়াজ কাদের চৌধুরীসহ পরিবারের সদস্যরা লাশের গাড়ির আগে আগেই গ্রামের বাড়িতে পৌঁছান।
প্রথমে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় মূল ঘরে, যা এক সময় সাকার বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর ঘর ছিল। পরে বাড়ি থেকে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় বকশ আলী চৌধুরী বাড়ি মসজিদে। সেখানে সোয়া ৯টার দিকে সাকার জানাজা হয়।
জানাজার পর সকালে ৯টা ৫৫ মিনিটে পারিবারিক কবরস্থানের সম্প্রসারিত অংশে দাফন করা হয় সাকা চৌধুরীকে।
পরে গ্রামের বাড়িতে এক সংবাদ সম্মেলনে সাকার ছেলে হুম্মাম বলেন, “বাবার অবৈধ রায় কার্যকর করা হয়েছে। নিজেদের ভাগ্যবান মনে করি। আজকাল বাংলাদেশে এতো গুমখুন হচ্ছে… আল্লাহর মেহেরবানিতে আমরা তাকে সম্মানের সাথে দাফন করতে পেরেছি।”
গত দুই দশকে চটকদার,‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ এবং কখনো কখনো ‘অশালীন’ মন্তব্যের কারণে বার বার সংবাদপত্রের শিরোনামে আসা সালাউদ্দিন কাদেরের জন্ম এই গহিরা গ্রামেই। বাবা মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী এক সময় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকারও হয়েছিলেন।
সালাউদ্দিন কাদেরের রাজনীতির শুরুও মুসলিম লীগ থেকে। পরে জাতীয় পার্টি ও এনডিপি হয়ে তিনি বিএনপিতে আসেন।
একাত্তরের অপরাধের জন্য বিতর্কিত এই রাজনীতিবিদ ১৯৭৯ সালে মুসলিম লীগ থেকে রাউজানের সাংসদ নির্বাচিত হন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময়ে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং কার্যত এর মধ্যে দিয়েই মূল ধারার রাজনীতিতে তার পুনর্বাসন ঘটে।
এর কিছুদিন পর এনডিপি বিএনপির সঙ্গে একীভূত হয় এবং ১৯৯৬ সালে বিএনপির টিকেটে সাংসদ নির্বাচিত হন সালাউদ্দিন। পরের নির্বাচনে ২০০১ সালে তিনি সাংসদ নির্বাচিত হন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে।
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্বও তিনি পালন করেন।
এর আগে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের শাসনামলে ত্রাণ ও পুনর্বাসন, গৃহায়ণ ওগণপূর্ত এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন সা কা চৌধুরী।
সর্বশেষ ২০০৮ সালের র্নিবাচনে রাঙ্গুনিয়া ও ফটিকছড়ি থেকে অংশ নেন সাকা। রাঙ্গুনিয়াতে হেরে গেলেও ফটিকছড়ি, অর্থাৎ চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে বিএনপির সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি।
সাকা সাংসদ থাকা অবস্থায় ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে তার ফাঁসির রায় আসে; আপিলেও তা বহাল থাকে।
এই রাউজানেই কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, সুলতানপুর ওঊনসত্তরপাড়ায় হিন্দু বসতিতে গণহত্যা এবং হাটহাজারীর এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তারছেলেকে অপহরণ করে খুনের দায়ে রোববার প্রথম প্রহরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
সংবাদ সম্মেলন করে এ বিচারকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ আখ্যায়িত করেন তারা। এর প্রতিবিধান চেয়ে সাকা চৌধুরীর ছেলে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন নিয়ে গেলেও তা গ্রহণ করা হয়নি।
রাতে ফাঁসি কার্যকরের আগে কারাগারে সাকা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে এসে হুম্মাম সাংবাদিকদের বলেন, “বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি কি মার্সি পিটিশন করেছ? তিনি বলেছেন, ‘এরকম বাজে কথা কে বলেছে?”
“আমাদের বারবার বলা হয়েছে- সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছে। যাকে বাংলার মানুষ বাঘ হিসেবে চেনে তিনি মাথা নত করতে পারেন না। কাল যখন বাবার সাথে কথা হয়। তখন তিনি বলেন, ‘তোমার ৬ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা বাবা বাঘ, তিনি মাথা নত করতে পারে না’।”
একদিন এর ‘বিচার হবে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “চট্টগ্রামের মানুষ এ রায় মেনে নেবে না।”