মিতুর বাবাকে জেরায় ‘বনজ-বাবুল দ্বন্দ্ব’ নিয়ে প্রশ্ন

বাবুলের আইনজীবীর দাবি, পুলিশের ‘অন্তঃকোন্দলের’ কারণে বাবুল আক্তারকে এ মামলায় ‘জড়ানো হয়েছে’। তবে রাষ্ট্রপক্ষের দাবি, কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব ছিল না, ‘প্রেমঘটিত কারণে’ বাবুল তার স্ত্রীকে খুন করিয়েছেন।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 May 2023, 03:16 PM
Updated : 10 May 2023, 03:16 PM

চট্টগ্রামের মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যা মামলায় তার বাবা মোশাররফ হোসেনকে দ্বিতীয় দিনের মত জেরা করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী, যেখানে মিতুর স্বামী পুলিশের সাবেক এসপি বাবুল আক্তারের সঙ্গে তার ঊর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তার কথিত দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গও এসেছে।

এ মামলার প্রথম সাক্ষী মোশাররফ হোসেন জবাবে বলেছেন, এমন কোনো বিষয় তার জানা নেই।

বাবুলের আইনজীবীর দাবি, পুলিশের ‘অন্তঃকোন্দলের’ কারণে বাবুল আক্তারকে এ মামলায় ‘জড়ানো হয়েছে’। তবে রাষ্ট্রপক্ষের দাবি, কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব ছিল না, ‘প্রেমঘটিত কারণে’ বাবুল তার স্ত্রীকে খুন করিয়েছেন।

চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে বুধবার মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেনকে জেরা করেন বাবুলের আইনজীবীরা। তবে জেরা অসমাপ্ত রেখেই দিনের শুনানি শেষ হয়। ১৬ মে শুনানির পরবর্তী দিন রেখেছে আদালত।

বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন জেরায় মোশাররফ হোসেনকে প্রশ্ন করেন, “২০১৬ সালের ২৪ জুন রাতে আপনার ঢাকার বাড়ি থেকে বাবুল আক্তারকে বেআইনিভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আটক করে নিয়ে জোরপূর্বক চাকরি থেকে অব্যাহতির আবেদনে সাক্ষর নেওয়া হয়?”

উত্তরে মোশাররফ হোসেন বলেন, “সত্য নয়।”

আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, “আপনার ঘর থেকে বাবুলকে জোরপূর্বক নিয়ে, ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের নামে যারা অত্যাচার করেছিল, তারা কেউ মিতু হত্যা মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল না। সেটা অবৈধ কর্মকাণ্ড থাকায় আজ পর্যন্ত ওই টিমের সদস্যরা নিজেদের পরিচয় গোপন রেখেছে?”

জবাবে মোশাররফ বলেন, “কারা এসেছিল, তা জানি না।”

পরের প্রশ্নে আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, “ওই অবৈধ টিমের প্রধান ছিলেন পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার?”

উত্তরের মোশাররফ বলেন, “সত্য নয়।”

এরপর আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, “বনজ কুমার ও বাবুল আক্তারের দ্বন্দ্ব চট্টগ্রামে চাকরি করার সময় থেকে ছিল। চট্টগ্রামে সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাদের একটা সিন্ডিকেট ছিল, বাবুল ছিল এর বাইরে। বাবুল সরাসরি পুলিশ কমিশনার ও আইজিকে বিভিন্ন বিষয় জানাত এবং বনজ কুমারের বিরুদ্ধেও অভিযোগ দেয়। তাতে বনজ কুমার ও কিছু সিনিয়র অফিসারের স্বার্থের হানি হয়।”

মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন এসব বিষয়ে “জানেন না” বলে উত্তর দেন।

জেরা শেষে জানতে চাইলে আইনজীবী কফিল উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “আমি একজন আইনজীবী। যা কিছু ডকুমেন্ট পাই, এটার উপরই আমার বক্তব্য্। আসামি কর্তৃক আমাকে সরবরাহকৃত পত্রপত্রিকায় বড় করে নিউজ দেখেছি যে, ঘটনাটায় বাবুলকে জড়ানোর বিষয় হলো পুলিশের অন্তঃকোন্দলের কারণে।

“ঢাকার একটা পত্রিকায় রেড হেডিং এ বিষয়টা প্রচার হয়েছে। সেখানে লেখা আছে যে, বিষয়টায় পিবিআই প্রধান জড়িত এবং উনার কাছে মিতুর ফোন আছে। যদিও এটা উনি অস্বীকার করেছেন।.... কিন্তু প্রশ্নটা করেছিল উনাকে...।”

কফিল উদ্দিন বলেন, “এটা আরও বেশি প্রতিষ্ঠিত হল- একজন ব্যক্তি যে কারো বিষয়ে বলতে পারে, প্রত্যেক কথায় কি মামলা হচ্ছে? তাহলে এদের সম্পর্কটা কত খারাপ- বাবুল জেলে আছে, পিবিআই প্রধান আবার তার বিরুদ্ধে, তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে, বৃদ্ধ বাবার বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা করেছেন।

“আবার পিবিআই চট্টগ্রামের এসপি সাহেব এখানে একই আসামিদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা করেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, যে কোনো কারণে হোক এদের সম্পর্কটা খুবই অহি-নকুল। একজন আরেক জনকে সহ্য করতে পারে না।”

আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, “আমাদের বক্তব্য হল, আসামির বক্তব্য হল- সেই দ্বন্দ্বের ফলে তাকে এই ষড়যন্ত্রে ফেলা হয়েছে। তার স্ত্রী হত্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সে। তার সন্তানরা মা হারিয়েছে, সে স্ত্রী হারিয়েছে।

“এ অবস্থায় আবার তাকেও ভিকটিম করে এক গুলিতে দুইটা পাখি মারার মত এভাবে ষড়যন্ত্রটা হয়েছে। আমরা আমাদের মামলাটাকে সেদিকে নেওয়ার চেষ্টা করছি।”

এর আগে জেরায় কফিল উদ্দিন সাক্ষী মোশাররফকে প্রশ্ন করেন, বাবুল আক্তার বাদী হয়ে বনজ ও তার সঙ্গীদের আসামি করে হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইনে একটি মামলা করেছিলেন। বাবুলের সাথে বনজ কুমারের সেই ‘সাপে-নেউলে সম্পর্ক’ এখনো বিদ্যমান কি না। 

জবাবে মোশাররফ হোসেন বলেন, তিনি মামলার বিষয়টি শুনেছেন, তবে অন্য কিছু জানেন না।

জেরা শেষে আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, ‘হেফাজতে নিয়ে বেআইনিভাবে আটকে রাখা এবং রিমান্ডের নামে নিয়ে নির্যাতন করে জোরপূর্বক বিভিন্ন কাগজে সাক্ষর নেওয়ার’ অভিযোগে হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইনে মহানগর দায়রা জজ আদালতে ওই মামলার আবেদন করেছিলেন বাবুল আক্তার।

“সে মামলাটি এখানে রিজেক্ট হওয়ায় হাই কোর্টে যায়। হাই কোর্ট সেই রিজেক্ট করাটা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না মর্মে রুল জারি করেছে। ওই মামলাটা পেন্ডিং আছে।”

জেরা শেষে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পিপি আবদুর রশিদ বলেন, “জেরা গত পরশু শুরু হয়েছে। এখনো শেষ হয়নি। উনি জবানবন্দির মধ্যে যে সকল তথ্য দিয়েছেন, আসামিপক্ষ সেটার ডিনায়াল নিয়েছেন জেরায়।

“বারবার চাইছে ওরা যে, পুলিশের অন্তঃকোন্দলের কারণে বাবুল আক্তারকে আসামি করা হয়েছে এ কথাটা তারা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আনতে। এদের মূল বক্তব্য এটা। সাক্ষ্য প্রমাণই প্রমাণ করবে এটা কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। প্রেমঘটিত কারণে বাবুল আক্তার তার স্ত্রীকে খুন করিয়েছে।”

‘আসামিদের মুখোমুখি করা হয় বাবুলকে’

জেরায় মোশাররফের সাক্ষ্য উদ্ধৃত করে বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, “আপনি বলেছেন, ‘আগেরদিন রাতে নিয়ে যাওয়ার পর ২০১৬ সালের ২৫ জুন সন্ধ্যার পর বাবুলকে বাসায় পৌঁছে দেয়। তখন বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারি, বাবুল মিতু হত্যার কথা স্বীকার করেছে। সে মূল পরিকল্পনাকারী।’ আপনি কি ডিবি অফিসে গিয়েছিলেন?”

জবাবে মোশাররফ বলেন, তিনি ডিবি অফিসে যাননি।

এরপর কফিল উদ্দিন প্রশ্ন করেন, “এ কথাগুলো সেদিন কার কাছ থেকে শুনেছেন?”

উত্তরে মোশাররফ বলেন, “বলতে পারব না।”

আইনজীবী কফিল উদ্দিন প্রশ্ন করেন, “সেসময় বাবুলকে অন্য আসামিদের মুখোমুখি করা হয় বলে সাক্ষ্যে বলেছেন। কোন কোন আসামির মুখোমুখি করা হয়? দুয়েকজনের নাম বলবেন।”

জবাবে মোশাররফ হোসেন বলেন, “শুনেছি- ওয়াসিম, আনোয়ার, শাহজাহানসহ আরও আসামিরা ছিল।”

এরপর আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, “২০১৬ সালের ২৬ জুন দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনে আপনাকে ‍উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘বাবুল এ হত্যার সাথে জড়িত নয়। তাকে পেশাগত হয়রানির শিকার করছে।’ এ ঘটনায় আপনি নিজেও আতঙ্কে রয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ।”

উত্তরে মোশাররফ বলেন, “সত্য নয়”।

এরপর বাবুলের আইনজীবী জানতে চান, ওই সময় (২০১৬ সালের ২৪ জুন থেকে ৩০ জুনের মধ্যে) মিতু হত্যায় ‘বাবুল জড়িত’– এমন তথ্য দিয়ে কোনো পত্রিকায় সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন কিনা।

জবাবে মোশাররফ বলেন, “সাংবাদিকদের বলেছি, হত্যায় জড়িত স্বীকার করে বাবুল চাকরি ছেড়েছে। কোনো পত্রিকায় ছাপা হয়েছে কিনা জানি না।”

মিতু হত্যার দিন টেলিফোনে যেসব পুলিশ কর্মকর্তার সাথে কথা হয়েছে বলে সাক্ষ্যে জানিয়েছেন মোশাররফ, তাদের নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, “স্মরণে নেই।”

জেরার জবাবে তিনি বলেন, মিতু হত্যার দিন ঢাকার মেরাদিয়ার তার বাড়িতে বাবুল আক্তার সন্তানদের নিয়ে অবস্থান নেন এবং একনাগাড়ে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন।

২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় সড়কে খুন হন এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু। এরপর ঢাকা থেকে গিয়ে পরদিন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন তিনি।

হত্যাকাণ্ডের পর জামাতা বাবুলের পক্ষেই ছিলেন তার শ্বশুর অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ। বাবুলও তার ছোট দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে উঠেছিলেন ঢাকায় তার শ্বশুরবাড়িতে।

এরমধ্যে ঢাকায় গোয়েন্দা পুলিশ বাবুলকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ এবং বাবুলের পুলিশের চাকরি ছাড়ার পরও তার পক্ষেই ছিলেন মোশাররফ।

পরের বছর বাবুল ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আলাদা বাসায় যাওয়ার পর জামাতাকে নিয়ে সন্দেহের কথা বলেন মোশাররফ। এরপর সরাসরি অভিযোগি করেন।

তখন তিনি বলেছিলেন, বাবুলের এক নারীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। তার পরিণতিতে মিতু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। নানা নাটকীয়তা শেষে পিবিআইয়ের তদন্তে এখন বাবুল আক্তারই এ মামলার আসামি।

২০২১ সালের মে মাসে পিবিআই জানায়, মিতুকে হত্যা করা হয়েছিল বাবুল আক্তারের ‘পরিকল্পনায়’। আর এজন্য খুনিদের লোক মারফত তিন লাখ ‘টাকাও দিয়েছিলেন’ বাবুল।

পিবিআই বাবুলের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পর মিতুর বাবা আরেকটি মামলা করেন। তবে আদালতের নির্দেশে সেই মামলার সমাপ্তি ঘটে এবং বাবুলের মামলাটিই পুনরুজ্জীবিত হয়।

এ বছরের ৯ এপ্রিল প্রথম সাক্ষী মিতুর বাবা মোশাররফের সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাবুলসহ সাত আসামির বিচার শুরু হয়।

মামলার বাকি আসামিরা হলেন- মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম, আনোয়ার হোসেন, এহতেশামুল হক ভোলা, শাহজাহান মিয়া, কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুছা ও খায়রুল ইসলাম। 

পুরনো খবর

হত্যাকাণ্ডের দিনই মুছার সঙ্গে বাবুলের কথোপকথনের বিষয়টি শুনি: জেরায় মিতুর বাবা

বাবার সাক্ষ্যে মিতু হত্যা মামলার বিচার শুরু

মামলায় যে অভিযোগ দিলেন বাবুল আক্তারের শ্বশুর

মিতু হত্যা: স্বামী বাবুল আক্তার আবার আলোচনায়

পিবিআই প্রধানের মামলায় বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র

বাবুলকেই সন্দেহ শ্বশুরের, দুই নারীকে জিজ্ঞাসাবাদের দাবি

শ্বশুরের সন্দেহের জবাব দিলেন বাবুল আক্তার

মিতু হত্যা: বাদী বাবুল আক্তার যেভাবে আসামি

‘পরকীয়ায় জড়িয়ে বাবুল খুন করান’ মিতুকে, মামলায় অভিযোগ বাবার