শিক্ষামন্ত্রীর ভাষ্য, এতদিন যে মূল্যায়ন পদ্ধতি চলে এসেছে, তা সবার উপযোগী ছিল না।
Published : 20 Jan 2024, 10:23 PM
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেছেন, ঝরে পড়া বন্ধ করে সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থীর মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত এবং তাদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতেই নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
শনিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “মূল বিষয় হল, আমরা সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থীকে মৌলিক শিক্ষা দিতে পারছি কিনা। বিশাল একটা শিক্ষার্থী কিন্তু আমার ঝরে পড়ছে। তারাই কিন্তু খাদ্য উৎপাদনের জন্য মাঠে কাজ করছে। তারাই বিদেশে রেমিটেন্স আয় করছে।
“তারাই কিন্তু মিল ফ্যাক্টরিতে ওয়ার্কার হিসেবে কাজ করছে। তাদেরকে যদি বেসিক স্কিলটা আমরা দিতে পারি। মৌলিক শিক্ষাটা দিতে পারি। তারা অদক্ষ শ্রমিকের বদলে দক্ষ শ্রমিক হতে পারবে।”
তিনি বলেন, দুই কোটি শিক্ষার্থী প্রাথমিক ধাপ শেষ করে। এসএসসি পর্যায়ে দাখিলসহ মিলিয়ে আসে ২০ লাখ। ১ কোটি ৮০ লাখ শিক্ষার্থী রিয়ে যাচ্ছে। তাদের শিক্ষা প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখার জন্যই কারিকুলামের পরিবর্তন।
পুরনো মূল্যায়ন পদ্ধতি সবার উপযোগী নয় মন্তব্য করে নওফেল বলেন, “শহুরে বাবা-মায়ের যে রিসোর্সটা আছে, তার পক্ষে সেই মূল্যায়নের জন্য শিক্ষার্থীকে প্রস্তুত করাটা সহজ। কিন্তু গ্রাম পর্যায়ে সেটা সহজ না। সেই ১ কোটি ৮০ লাখকে মনে রাখতে হবে।
“গণমাধ্যমে শহুরে বাবা-মায়ের অভিমতটা সবচেয়ে বেশি আসছে। কারণ তারাই সবচেয়ে বেশি প্রতিযোগিতা চায়। তারা বলতে চান, `আমার সন্তান জিপিএ এত হাই পেয়েছে, আমার সন্তান সবচেয়ে ভালো স্কুলে পড়ে’।
“কিন্তু যে কারিকুলাম স্ট্রাকচার এখন আমরা করছি, যে বিদ্যালয় কোথায় আমরা পড়াব সেটা তেমন বেশি ম্যাটার করবে না। একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত যেন শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি।”
এই প্রজন্মকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে অনেক স্বপ্ন, সে কথা তুলে ধরে নওফেল বলেন, তরুণদের দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও কর্মমুখী করাই সরকারের লক্ষ্য।
“আমাদের শিক্ষা জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে কর্ম জীবনের সমন্বয় থাকে না। সেটার যেন একটা ব্রিজ আমরা করতে পারি। শুধু ফল দিয়ে যেন আমাদের সন্তানদের জাজ না করি। তাদের মধ্যে যেন স্কিল ডেভেলপ করে।
“বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা শুধু পাঠে ন্যস্ত থাকলে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা নিতে পারবে না। মাঠে ঘাটে কাজ করা, আর্টিকেলশিপ, ইন্টার্নশিপ করতে হবে। এসব পরিবর্তন আমরা করতে চাই। শিক্ষার ফল মেলে একটু দেরিতে। বিগত ৫ বছরে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দৃশ্যমান ফল মিলবে ভবিষ্যতে।”
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “বেসিক সাক্ষরতা ৫০ শতাংশের নিচে ছিল আমাদের। এখন আমরা গুণগত শিক্ষার কথা বলছি। প্রধানমন্ত্রী এক সিদ্ধান্তে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা দ্বিগুণ করে দিয়েছেন। আগামীতে আমাদের অবকাঠামো খাতের বিনিয়োগগুলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে হবে।”
মন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন ছিল, নতুন কারিকুলামে পড়া শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষায় গিয়ে কোনো সমস্যায় পড়বে কিনা।
জবাবে নওফেল বলেন, “আমার কতটুকু অ্যানাটমি পড়ানো দরকার বায়োলজিতে? মেডিকেল স্টুডেন্ট হলে সেই স্ট্রিমে গিয়ে সেটা আমি পড়াব। সব শিক্ষার্থীকে সবকিছু পড়ানোর তো দরকার নেই। কিন্তু আমার বর্তমান প্রসেসটা সেটাই।
“সবাইকে ডিফারেন্সিয়েশন ইন্টিগ্রেশন শেখানোর প্রয়োজন নাই। যারা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নির্দিষ্ট স্ট্রিমে যাবে, তাদের জন্য ইন্টারমিডিয়েট পর্যায়ে তা কিন্তু রাখছি। সকলের জন্য নির্ধারিত মানদণ্ডে বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ভাষা, গণিত সেটা একটা বয়সসীমা পর্যন্ত থাকতে হবে। সেভাবেই স্ট্রাকচার করা। মান কি কমে যাচ্ছে কিনা, সেভাবে চিন্তা করার দরকার নেই।”
নওফেল বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে আমরা কাজ করছি। স্পেশালাইজড স্ট্রিমে যারা যাবে, তারা যাতে ইন্টারমিডিয়েট পর্যায়ে গিয়ে সেই স্ট্রিমগুলো চুজ করতে পারে। সেভাবে অ্যালাইন করা হয়েছে এই কারিকুলাম।
“তাই কম হয়েছে বলে অভিযোগ অপপ্রচারমূলক। শহরাঞ্চলের বাবা-মারাই সে অভিযোগ একটু বেশি করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের দায়িত্ব দিয়েছেন। শিক্ষাবিদ বিশেষজ্ঞরা মিলে যেটা নির্দিষ্ট করেছেন। দায়িত্বটা আমাদের নিতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব শুধু জনপ্রিয়তা খুঁজলে হবে না, অজনপ্রিয় হলেও সঠিক সিদ্ধান্তের জায়গায় আমাদের স্থির থাকতে হবে।”
শিক্ষা ক্ষেত্রে যেন দুর্নীতি না হয়, সে জন্যও সরকার কাজ করছে বলে মন্ত্রীর ভাষ্য।
তিনি বলেন, “এবারের নির্বাচনী ইশতেহারের যে দর্শন, তা হল, শিক্ষার্থীরা যেন কর্ম উপযোগী হয়। যে ধরনের কাজ বিশ্বে সৃষ্টি হচ্ছে, সে ধরনের দক্ষতা আমাদের শিক্ষার্থীদের দিতে হবে।
“নতুন দক্ষতা আর্জনের মানসিকতা তাদের দিতে হবে। শেখার মানসিকতা জরুরি। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি নতুন কিছু শিখতে চাওয়া। ‘বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’- এজন্য শিক্ষকদেরও প্রস্তুত করতে হবে।”
নতুন কারিকুলামে বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ কিনতে স্কুলগুলো বাধ্য করছে– এমন অভিযোগের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নওফেল বলেন, “শহরাঞ্চলে মধ্য ও উচ্চবিত্তের স্কুলে এটা বেশি। আমরা বলিনি এ ধরনের শিক্ষা উপকরণ নিয়ে আসতে হবে।
“এটা এমন একটা কারিকুলাম, শিক্ষার্থীরা পত্রিকা ব্যবহার করে তথ্য নিতে পারে। গুগল থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করে তথ্য নিতে হবে, তা নয়। বাস্তবায়ন পর্যায়ে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হচ্ছে। এজন্য আরো কিছু সুপারিশ করছি।”
নওফেল বলেন, “যে ন্যারেটিভটা সমাজে সৃষ্টি হয়েছে যে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার আর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাই হল ক্যারিয়ার, লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে– এই ধারণা থেকে আমাদের অবশ্যই বের হয়ে আসতে হবে।
“গাড়ি ঘোড়া চড়াই শুধু সমাজের উন্নয়নের লক্ষ্য নয়। ক্রীতদাসের সময় থেকেও অনেকে গাড়িঘোড়া চড়ত। সমাজে বৈষম্য সবসময় ছিল। কিন্তু শিক্ষাটাকে সেভাবে সাজাতে হবে যাতে বৈষম্যটা কম হয়।”
চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ও চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন (সিইউজে) যৌথভাবে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি সালাউদ্দিন মো. রেজার সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে সাবেক সভাপতি আবু সুফিয়ান, সাংবাদিক মোস্তাক আহমেদ, সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য কলিম সরওয়ার, সিইউজে সভাপতি তপন চক্রবর্তী, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক দেবদুলাল ভৌমিক, সিনিয়র সহ সভাপতি চৌধুরী ফরিদ ও সিইউজের সহ সভাপতি রুবেল খান বক্তব্য দেন।