প্রায় সাড়ে সাত হাজার শিক্ষার্থীর এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনের সড়কে র্যাম্প নামলে ‘চরম যানজটের সৃষ্টি হবে’ বলে মনে করছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
Published : 11 Jun 2024, 10:13 AM
চট্টগ্রামের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নিয়ে এবার আপত্তি জানাল বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ (বাওয়া) কর্তৃপক্ষ।
প্রায় সাড়ে সাত হাজার শিক্ষার্থীর এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনের সড়কের উপর র্যাম্পের পিলার নির্মাণ হলে সেখানে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে ‘বেশ অসুবিধা হবে এবং চরম যানজটের সৃষ্টি হবে’ বলে মনে করছে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকরা।
ইতোমধ্যে সেখানে র্যাম্প স্থাপন না করতে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান বরাবরে লিখিত আবেদন করেছেন স্কুল অধ্যক্ষ।
এর আগে গত মার্চের শেষে চট্টগ্রামের টাইগারপাস-সিআরবি অংশে দ্বিতল সড়কের মাঝের ঢালে পিয়ার বসিয়ে এবং ৪৪টি প্রাচীন গাছ কেটে র্যাম্প নির্মাণে সিডিএ উদ্যোগ নিলে পরিবেশবাদীরা আন্দোলনে নামে।
আন্দোলনকারীদের অনড় অবস্থানের মুখে এক মত বিনিময় সভায় র্যাম্প নির্মাণের পরিকল্পনা স্থগিত করার কথা জানিয়েছিল সিডিএ’র সে সময়ের চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ ডলফিন।
তখন সিডিএ কর্মকর্তারা জানান, র্যাম্পের জন্য নতুন করে নকশা প্রস্তাব তৈরি করে ঈদুল ফিতরের পর তারা নাগরিক সমাজের সাথে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। সে পর্যন্ত র্যাম্প নির্মাণের কাজ স্থগিত থাকবে।
এরপর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সেখানে গাছ কেটে কোনো র্যাম্প না করতে সিডিএকে নির্দেশ দেন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।
নগরীর লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে র্যাম্প থাকবে ১৪টি। এর মধ্যে জিইসি মোড়ে একটি, টাইগারপাসে দুটি, আগ্রাবাদে চারটি, ফকিরহাটে একটি, নিমতলায় দুটি, সিইপিজেডে দুটি এবং কেইপিজেড এলাকায় দুটি র্যাম্প থাকবে।
আর আগ্রাবাদ এলাকার চারটি র্যাম্পের মধ্যে জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর সড়কে একটি, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার সড়কে একটি এবং আগ্রাবাদ এক্সেস সড়কে হবে দুটি র্যাম্প।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নগরীর প্রান্তটি নিচের মূল সড়কের ওপর দিয়ে লালখান বাজার মোড় পেরিয়ে ওয়াসার মোড়ে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে গিয়ে মিলবে।
তবে একটি র্যাম্প ওয়াসার মোড়ের জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসিজদ সংলগ্ন অংশ থেকে শুরু হয়ে বাওয়া স্কুলের সামনে দিয়ে জিইসি মোড়ের কাছে গিয়ে নামবে।
এই র্যাম্পটির জন্য পিলার বসাতে মাটি খোড়ার কাজ শুরু হয়েছে। সেজন্য বাওয়া স্কুলের সামনের সড়কের একটি অংশ গত মাস থেকে টিন দিয়ে ঘেরা হয়েছে।
আপত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে বাওয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুহ: আরিফ উল হাছান চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের প্রায় সাড়ে সাত হাজার শিক্ষার্থী। পাশেই বাওয়া চিলড্রেন হোম এবং বাগমনিরাম স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এছাড়া সড়কের বিপরীত পাশে সিএমপি স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
“প্রতিদিন প্রায় দশ হাজার শিক্ষার্থী এই সড়কে যাতায়াত করে। এখানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে র্যাম্প স্থাপন করলে এই বিশাল শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে বেশ অসুবিধা এবং চরম যানজটের সৃষ্টি হবে। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানের মুখে এই ধরনের সমস্যা চলছে। তাই বাওয়া স্কুলের সামনে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নামার র্যাম্প স্থাপন না করলে ভালো হয়।”
অধ্যক্ষ হাছান চৌধুরী বলেন, “ইতোমধ্যে র্যাম্পের কিছু কাজ শুরু হওয়ায় সড়কের এক অংশ ঘিরে ফেলা হয়েছে। র্যাম্প হলে যানজট আরো চিরস্থায়ী হবে। সিডিএ চেয়ারম্যান বরাবরে আমরা চিঠি দিয়েছি। তবে এখনো কাজ চলমান আছে।”
ওই সড়কে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে ১৫ গজের মধ্যে একটি পিলার বসানোর জন্য গর্ত খোঁড়া হচ্ছে। সড়কের ওই অংশ টিনের ঘেরা দেওয়া। বাকি অংশ দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে ধীর গতিতে।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা কেউ কেউ ঘিরে রাখা সড়কের ভোগান্তি ও যানজট এড়াতে ফুট ওভার ব্রিজ দিয়ে সড়কের অপর পাশে চলে যাচ্ছেন।
বেদারুল আলম চৌধুরী বেদার নামের একজন অভিভাবক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্কুল শুরু এবং ছুটির সময় প্রচুর লোক সমাগম হয় স্কুল ঘিরে। তখন সড়কে এমনিতে যানজট হয় প্রতিদিন। এখন এলিভিটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্পের পিলার বসলে মূল সড়ক ছোট হয়ে যাবে।
“এতে করে প্রতিদিন দীর্ঘ সময় ধরে যানজট হবে। এটা নগরীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। এই যানজটের প্রভাব শহরের বড় অংশ জুড়ে পড়বে। বেশি যানজট হলে তা কোমলমতি শিশুদের জন্যও চরম ভোগান্তির হবে। আর সড়কে গাড়ির চাপের কারণে ঝুঁকিও বাড়বে। স্কুলের সামনে পিলার না করে অন্য কোথাও করলে ভালো হয়।”
জানতে চাইলে সিডিএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লিখিত আবেদনটি এখনো আমার হাতে আসেনি। আমি খোঁজ নিচ্ছি। স্কুল কর্তৃপক্ষের আপত্তির বিষয়টি জেনে, করণীয় ঠিক করতে আমি সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের সাথে কথা বলব।”
নগরীর লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ উড়াল সড়ক নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুনে শেষ করার সময় পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) বোর্ড সভায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটির নাম প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নামে করার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে।
২০১৭ সালে একনেকে অনুমোদন হওয়ার সময় ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি তিন বছরের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল।
২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে কাজ শুরু হলেও ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
পরে ২০২২ সালে নকশা ‘সংশোধন’ করে আরও এক হাজার ৪৮ কোটি টাকা (আগের ব্যয়ের চেয়ে ৩২ শতাংশ) ব্যয় বাড়িয়ে মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
‘চট্টগ্রাম শহরের লালখান বাজার হতে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ’ নামে প্রকল্পের কাজ শুরুর পর চট্টগ্রাম বন্দরের আপত্তি, জমি অধিগ্রহণের জন্য অপেক্ষা, ট্রাফিক বিভাগের অনুমতি না পাওয়া, লালখান বাজার অংশের নকশা নিয়ে আপত্তি, কোভিডের সময় কাজে ধীরগতি, বিকল্প সড়ক চালু করতে দেরি এবং সবশেষ বন্দর সংলগ্ন এলাকায় নকশা পরিবর্তনসহ নানা কারণে প্রকল্প কাজে বিলম্ব হয়।
সবশেষ ২০২২ সালের সংশোধিত প্রস্তাবে চট্টগ্রাম বন্দরে চলাচলকারী যানবাহনের জন্য রাস্তা উন্মুক্ত রাখতে প্রকল্পের অ্যালাইনমেন্টে পরিবর্তন করা হয়। এছাড়া বন্দরের গাড়ি সহজে চলাচলের জন্য যথাযথ ‘ফাউন্ডেশন, সাব স্ট্র্যাকচার ও সুপার স্ট্র্যাকচার’ তৈরি করে নতুন নকশায় অ্যালাইনমেন্ট করার প্রস্তাব করা হয়।
১৬ কিলোমিটার উড়াল সড়কটি বিমানবন্দর এলাকা থেকে শুরু হয়ে ইপিজেড-বন্দর-বারেকবিল্ডিং- চৌমুহনী হয়ে দেওয়ানহাট রেলসেতুর পশ্চিম পাশ দিয়ে পাহাড় ঘেষে টাইগার পাস মোড়ের পর মূল সড়কের ওপর দিয়ে লালখান বাজার মোড় পেরিয়ে ওয়াসার মোড়ে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে গিয়ে মিলবে।
ইতোমধ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল কাঠামোর কাজ শেষ হয়েছে। কয়েকটি র্যাম্প নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছে। বিদ্যুতায়নের কাজ শেষ হলে মাসখানেকের মধ্যে এটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে।
পুরনো খবর
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে: পতেঙ্গা প্রান্তে ‘উল্টো’ ফলের শঙ্কা ট্রাফিক বিভাগের
চট্টগ্রামে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হচ্ছে র্যাম্প ছাড়াই
টাইগারপাস-সিআরবি সড়কে গাছ কেটে র্যাম্প নয়: দুই মন্ত্রীর নির্দেশ
চট্টগ্রামের ‘আইকনিক’ সড়কে শতবর্ষী গাছ কেটে র্যাম্প নামাতে চায় সিডিএ