সংস্থাটি ঈদের পর আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বসবে।
Published : 03 Apr 2024, 12:21 AM
চট্টগ্রামের টাইগারপাস থেকে সিআরবিমুখী পাহাড়ি রাস্তার মাঝের ঢালে এলিভিটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণের যে প্রস্তাব করেছিল সিডিএ, আন্দোলনের মুখে তা সংশোধনের আশ্বাস দিয়েছে নগর উন্নয়ন সংস্থাটি।
মঙ্গলবার বিকালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সম্মেলন কক্ষে মতবিনিময় সভায় সিডিএ চেয়ারম্যান ও কর্মকর্তারা জানান, র্যাম্পের নতুন নকশার প্রস্তাব তৈরি শেষে ঈদের পর আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তারা বসবেন।
তবে আন্দোলনকারীরা সভায় জানিয়ে দেন, টাইগারপাস-সিআরবি এলাকার দ্বিতল সড়ক নষ্ট করে ও গাছ কেটে ওই স্থানে কোনো র্যাম্প তারা চান না।
চট্টগ্রামের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে নিউমার্কেট-কদমতলি এলাকা থেকে যেসব যানবহান উঠবে, সেগুলোর জন্য টাইগারপাস-সিআরবির দ্বিতল সড়কে একটি র্যাম্প নির্মাণ করার প্রস্তাব আছে সিডিএ’র প্রকল্প পরিকল্পনায়।
বিষয়টি জানার পর সোমবার থেকে আন্দোলনে নামে চট্টগ্রামের একাধিক নাগরিক সংগঠন। এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠন।
এর প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষের সাথে মতবিনিময় সভায় বসেন নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রাম এবং সম্মিলিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ।
সভার শুরুতে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেন বলেন, “সভ্যতার আগ্রাসনে চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সম্ভার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন তো দরকার। কিন্তু পরিবেশ বিঘ্নিত হলে সব উন্নয়নই ব্যর্থ হয়ে যাবে। টাইগারপাসের দ্বিতল সড়ক এক অপূর্ব সুন্দর জায়গা। সেখানে আমার মনে হয় না র্যাম্পের কোনো প্রয়োজন আছে। র্যাম্প হলে সেটা একটি কুৎসিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
“এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে এত র্যাম্পের দরকার কেন হবে? আমিও তো আরবান প্ল্যানিংয়ের ছাত্র। আরবান প্ল্যানিং হবে এমন যেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশ অবশ্যই বজায় রাখতে হবে এবং জঞ্জাল যেন সৃষ্টি না হয়। এলিভেটেড মানেই ওপর দিয়ে দূর দূরান্তের গাড়ি যাবে। সব রাস্তায় সেটাকে কেন নামাতে হবে?
নাগরিক সমাজ চট্টগ্রামের আহ্বায়ক ড. অনুপম সেন বলেন, “অতিরিক্ত র্যাম্পগুলো শহরে যানজটের সৃষ্টি করে। এর জন্য এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতেও যানজট হবে। চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন, আপাতত বন্ধ করে দিন। আমরা সবাই মিলে বসে সিদ্ধান্ত নিব এ বিষয়ে কি করা যায়। চট্টগ্রামের নাগরিকেরা নিজেদের মতামত জানাবেন।”
এরপর সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ ডলফিন বলেন, “এই প্রকল্প আমরা করিনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটা প্রকল্প। করার সময় অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। শুরুতে কেউ বলেছিল- বারেক বিল্ডিং, কেউ বলেছে দেওয়ানহাটে শেষ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন লালখান বাজার নামাতে।
“বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেওয়ানহাটে নামালে সুফল মিলবে না। ৩৫টা র্যাম্পের দাবি ছিল। আমরা কমিয়েছি। কিছু ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। শতবর্ষী গাছ কাটা হবে না। ছোট কিছু গাছ কাটা হবে। গাছ বন বিভাগ মার্কিং করেছে। আমরা করিনি। আপনারা ড্রইং দেখলে বুঝতে পারবেন। প্রয়োজনে র্যাম্পের সাইজ আরো ছোট করতে বলেছি।”
এরপর আন্দোলনকারীদের পক্ষে বর্ষীয়ান অধ্যাপক শফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, “এখানে কোনো র্যাম্প আমরা চাই না। বরং যত র্যাম্প হচ্ছে সেগুলোই অনেক বেশি।”
সিডিএ প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, “শতবর্ষী গাছ কাটা যাবে না। শুধু একটি শতবর্ষী গাছের ডাল কাটা যাবে। র্যাম্প যদি এখানে তুলতে চাই ডিজাইন আরেকটু মডিফাই করব। ঈদের পরে আপনাদের দেখাব। সবাই যদি মত দেন, তাহলে কাজ বাস্তবায়ন করা আমার দায়িত্ব। সেখানে র্যাম্প দরকার না হলে, করব না।”
সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, “র্যাম্পের বিষয়টি জনঘনত্ব অনুসারে ঠিক করা হয়। এখানে না করলে ২ নম্বর গেট থেকে উঠতে হবে। প্রতি বছর গাড়ি বাড়ছে। পোর্ট সিটি বলে ট্রাক লরির সংখ্যা বেশি। ৫০-১০০ বছর পরে গাড়ি যে বাড়বে তার উপর ডিজাইন।
“উঠানামা সহজ করব, এটা টার্গেট ছিল। এলাকার গুরত্ব বিবেচনা করে প্রস্তাব করা হয়। চট্টগ্রাম শহরে পরিবেশ বিধ্বংসী কিছু করব না। গাছ কেটে আমরা কোনো র্যাম্প করব না। নতুন ডিজাইন করে জানাব। দ্বিতল রাস্তা নষ্ট করব না।”
এসময় আন্দোলনকারীরা টাইগারপাস-সিআরবি অংশে র্যাম্পটি বাতিলের দাবি জানাতে থাকেন।
নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ও নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন বাবুল বলেন, “চট্টগ্রামের মানুষের সেন্টিমেন্টের বাইরে উনারা (সিডিএ) কিছু করবেন না। আমরা বিশেষজ্ঞদের নাম দিব। সবাই মিলে যেটা ঠিক করব, সেভাবে হবে।”
কবি-সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল বলেন, “চট্টগ্রামের জনগণ এটা চায় না। এখানে র্যাম্প করবেন না। এখানে টোল দিয়ে উঠতে হবে। সাধারণ মানুষ এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করতে পারবে না। এখানে কোনো র্যাম্প করবেন না।”
ডা. মনজুরুল করিম বিপ্লব বলেন, “আপনারা লালখান বাজারেও এলিভিটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য পাহাড় কেটেছেন। অনেক র্যাম্প করেছেন। যারা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করবে তারা জিইসি মোড় বা আগ্রাবাদ থেকে উঠতে পারবে। এই অনন্য সড়কটি নষ্ট করার কোনো প্রয়োজন নেই।”
শেষে সিডিএ চেয়ারম্যানের উদ্দেশ্যে ড. অনুপম সেন বলেন, “ঢাকা বা কোলকাতায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে এত র্যাম্প নেই। এটা ধনী লোকের জন্য। নিচের রাস্তা যদি বারবার খোড়েন সেটাও ছোট হয়ে যায়।
“আমার ৮৩ বছর বয়স। ৪৮ সালে এই দ্বিতল সড়ক দেখেছি। চমৎকার সুন্দর সেই অংশটি যেন কোনভাবে নষ্ট না হয়। দ্বিতল রাস্তা কোনভাবে নষ্ট করা যাবে না। এখানে র্যাম্প করা যাবে না। চট্টগ্রামের দেড় শতাব্দী প্রাচীন পরিবারের প্রতিনিধি আপনি। আপনি এটি চিন্তা করবেন।”
সবার বক্তব্য শুনে ঈদের পর আন্দোলনকারী ও বিশেষজ্ঞদের সাথে বসে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে বলে আশ্বাস দেন সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ।
সভায় উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, পিপল’স ভয়েস সভাপতি শরীফ চৌহান, বিএফইউজের যুগ্ম মহাসচিব মহসীন কাজী, প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি চৌধুরী ফরিদ, ন্যাপ নেতা মিটুল দাশগুপ্ত, সাংস্কৃতিক সংগঠক প্রণব চৌধুরী, রাজনীতিবিদ হাসান মারুফ রুফি, আন্দোলনকারী রিতু পারভি।
আন্দোলন ও পরিদর্শন
মঙ্গলবার সকালেও দ্বিতীয় দিনের মত দ্বিতল সড়করক্ষা ও শতবর্ষী গাছ না কাটার দাবিতে কর্মসূচি পালন করে সম্মিলিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন।
তারা শতবর্ষী গাছে লাল কাপড় জড়িয়ে এবং হাতে ব্যানার নিয়ে প্রতিবাদে শামিল হয়।
আন্দোলনের মুখে মঙ্গলবার দুপুরে র্যাম্পের জন্য নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিডিএ বোর্ড সদস্য, প্রকল্প পরিচালক ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
এসময় প্রকল্প পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “শতবর্ষী গাছ রক্ষা করে র্যাম্পের নকশা করা হয়। ঈদের পরে পাইলিংয়ের কাজ শুরু করার কথা ছিল। এই র্যাম্প নির্মাণ করতে বড় কোনো গাছ কাটা পড়বে না। ছোট ছোট ৪৪টি গাছ কাটা পড়বে। দ্বিতল সড়কে কাজ করা হবে না। নিচের রাস্তা থেকে র্যাম্পটি তোলা হবে।
“নাগরিক সমাজের আপত্তির বিষয়টি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি। এখন মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে কাজ করা হবে, না হলে অন্যভাবে করা হবে।”
তখন সঙ্গে থাকা সিডিএ বোর্ড মেম্বার ও নগর পরিকল্পনাবিদ আশিক ইমরান বলেন, “টাইগারপাসের এই দ্বিতল সড়ক এশিয়ার অন্যতম সুন্দর রাস্তা। ৪৪টি গাছের গুরুত্বপূর্ণ আবেদন আছে। র্যাম্পের প্রস্ত কমিয়ে সমাধান করা হলেও ৪৪টি গাছ থাকবে না। ফলে সেই আবেদন নষ্ট হবেই।
“অন্যদিকে র্যাম্প না হলে পলোগ্রাউন্ড টাইগারপাসের কানেকটিভিটি হচ্ছে না। তখন নিউমার্কেট থেকে আসা গাড়িগুলো জিইসি বা আগ্রাবাদ থেকে উঠতে হবে। যদি ক্ষতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা না যায়, তাহলে র্যাম্প করা না হোক। বিকল্প কোনো পথ বের করা যায় কি না, তা সিডিএকে অনুরোধ করব।”
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করেছিল চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ব্যুরো অব রিসার্চ টেস্টি অ্যান্ড কনসালটেশন।
সেই সমীক্ষা অনুযায়ী, টাইগারপাস থেকে আগ্রাবাদমুখী সড়কে সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ২ থেকে ৪ হাজার যানবাহন চলে করে। একই সময়ে লালখানবাজার থেকে টাইগারপাসমুখী যানবাহন চলাচল করে আড়াই হাজার।
বাকি দেড় হাজার যানবাহন নিউমার্কেট থেকে টাইগারপাস, আমবাগান থেকে টাইগারপাস, ডিটি রোড থেকে দেওয়ান হাট, কদমতলী থেকে দেওয়ানহাট, কদমতলী থেকে আগ্রাবাদ চৌমুহনী মোড় ও এক্সেস রোড থেকে আগ্রাবাদ চৌমুহনী মোড় হয়ে চলে।
নিউমার্কেট থেকে টাইগারপাসমুখী গাড়ির একাংশ যাতায়াত করে লালখানবাজার ও আমবাগানমুখী। বাকিগুলো যায় আগ্রাবাদের দিকে। এরমধ্যে অধিকাংশ গণপরিবহন।
পিপল’স ভয়েস সভাপতি শরীফ চৌহান বলেন, “সমীক্ষা অনুসারে, এই সড়কে যাতায়াতকারী যানবাহন চলাচলের সংখ্যা ঘণ্টায় ৩০০ থেকে ৫০০টি। এরমধ্যে ২০ শতাংশ গাড়ি হয়তো এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করবে।
“যেটার সংখ্যা ঘণ্টায় ১০০টির বেশি হওয়ার কথা নয়। এত অল্প সংখ্যক গাড়ির জন্য র্যাম্পের প্রয়োজন নেই। সেখানে র্যাম্প নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা ঘরে ফিরবে না।”