এবারের আইপিএলে চেন্নাইয়ের বাইরের মাঠে খরুচে হলেও ঘরের মাঠে দুর্দান্ত ছিলেন মুস্তাফিজ, কিন্তু মঙ্গলবার সেই চেন্নাইয়েও প্রথম ওভারের পর তার লেংথ ছিল এলেমেলো, বোলিং ছিল ধারহীন।
Published : 24 Apr 2024, 11:04 AM
পঞ্চম ওভারে আক্রমণে আনা হলো মুস্তাফিজুর রহমানকে। প্রথম ডেলিভারি অফ স্টাম্পের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া লেংথ বল। একটু জায়গা বানিয়ে দারুণ শটে চার মারলেন লোকেশ রাহুল। মুস্তাফিজ ভুল শুধরে নিলেন তাৎক্ষনিক। ওভার দা উইকেট থেকে রাউন্ড দা উইকেটে চলে গেলেন তাৎক্ষনিক। অ্যাঙ্গেলটা আটকে দিলেন রাহুলের জন্য। ফলও মিলল দ্রুত। টানা দুই বলে রান হলো না, ওভারের চতুর্থ বলে আউট হয়ে গেলেন রাহুল।
প্রথম বলে বাউন্ডারির পর ওই ওভারে আর রানই হলো না। ধারাভাষ্যে ইয়ান বিপশ, সাইমন ক্যাটিচরা তখন মুস্তাফিজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কে ভাবতে পেরেছিল, পরের ওভারগুলোয় বেদম মার খাবেন বাংলাদেশের এই বাঁহাতি পেসার এবং শেষ ওভারে তাকে বিধ্বস্ত করেই লাক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টসকে স্মরণীয় জয় এনে দেবেন মার্কাস স্টয়নিস!
প্রথম ওভারে স্রেফ চার রান দেওয়া মুস্তাফিজের বোলিং বিশ্লেষণ শেষ পর্যন্ত ৩.৩-০-৫১-১।
শেষের ওভারগুলোয় চেন্নাই সুপার কিংসের মূল ভরসা ছিলেন তিনিই। কিন্তু তিন ওভারে যখন লাক্ষ্নৌর প্রয়োজন ৪৭ রান, তখন ১৮তম ওভারে তার ওভার থেকে রান আসে ১৫। শেষ ওভারে প্রয়োজন পড়ে ১৭ রানের। স্টয়নিস খেলা শেষ করে দেন তিন বল বাকি রেখেই। একটি নো বলসহ তিন বলেই ১৯ রান দেন মুস্তাফিজ।
চেন্নাইয়ের এমএ চিদাম্বারাম স্টেডিয়ামে চলতি মৌসুমে চার ম্যাচ খেলে এই প্রথম ৩০ রানের বেশি দিলেন মুস্তাফিজ।
তার এই ম্যাচের পারফরম্যান্সের সবচেয়ে হতাশার দিক এটিই। এই ম্যাচের আগ পর্যন্ত এবারের আইপিএলে মুস্তাফিজের দুটি রূপ দেখা যাচ্ছিল। চিদাম্বারাম স্টেডিয়ামে তিনি ছিলেন ক্ষুরধার, চেন্নাইয়ের বাইরে অতি সাধারণ।
চেন্নাইয়ের মাঠে ২৯ রানে ৪ উইকেট নিয়ে তিনি শুরু করেন এবারের মৌসুম। একই মাঠে পরের ম্যাচে তার প্রাপ্তি ৩০ রানে ২ উইকেট। এই মাঠে আরেকটি ম্যাচ খেলেন তিনি গত ৮ এপ্রিল। সেদিনও দারুণ বোলিংয়ে ২ উইকেট নেন ২২ রানে।
ঠিক উল্টো চিত্র ছিল চেন্নাইয়ের বাইরে। বিশাখাপাত্নামে তার পারফরম্যান্স ছিল ৪৭ রানে ১ উইকেট, মুম্বাইয়ে ৫৫ রানে ১ উইকেট ও লাক্ষ্নৌতে ৪৩ রানে ১ উইকেট।
মৌসুমের শুরুর আগে চেন্নাই সুপার কিংসের প্রধান নির্বাহী বলেছিলেন, মূলত চিদাম্বারাম স্টেডিয়ামের উইকেটের সুবিধা কাজে লাগাতেই মুস্তাফিজকে দলে নিয়েছেন তারা। এখানকার উইকেটে সাধারণত বল একটু থমকে আসে, কিছুটা গ্রিপ করে। এই ধরনের উইকেটে মুস্তাফিজের কার্যকারিতা তো গোটা ক্রিকেট বিশ্বই জানে। সেটিই দেখা যাচ্ছিল ম্যাচের পর ম্যাচে। কিন্তু এবার সেই একই মাঠে তিনি হজম করলেন বেজায় পিটুনি।
শেষ দিকের বোলিংয়ে চেন্নাইয়ের আরেক ভরসা মাথিশা পাথিরানাও এ দিন খুব সুবিধা করতে পারেননি। ১৯তম ওভারে লঙ্কান এই স্লিঙ্গিং বোলার রান দেন ১৫।
ম্যাচ শেষে চেন্নাই অধিনায়ক রুতুরাজ গায়কোয়াড় অবশ্য মুস্তাফিজ-পাথিরানার দিকে আঙুল তোলেননি। তিনি বরং দায় দিয়েছেন মাঝের ওভারগুলোকে, রাতের শিশিরের জন্য যখন অকার্যকর ছিলেন দুই স্পিনার মইন আলি ও রবীন্দ্র জাদেজা।
“শিশির এখানে একটি ভূমিকা রেখেছে। আমার মনে হয়েছে, একটু বেশিই শিশির পড়েছে এবং তাতে আমাদের স্পিনাররা ম্যাচের বাইরে চলে গেছে। শিশির না পড়লে মাঝের ওভারগুলো আমরা আরও ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম ও খেলা আরও গভীরে নিতে পারতাম।”
“তবে এসবও ক্রিকেটের অংশ। যেসব ব্যাপার নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তা তো বদলানো যায় না। টুর্নামেন্টের অনেক পথ এখনও বাকি।”
রুতুরাজের কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে শিশির বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে মুস্তাফিজের জন্য। তার বোলিংয়ের মূল অস্ত্র যে স্লোয়ার ও কাটার, সেসব ডেলিভারির গ্রিপ অনেকটা স্পিনারদের মতোই। ভেজা বল গ্রিপ করা একটু কঠিনই বটে। মুস্তাফিজকেও বারবার দেখা গেছে রুমালে বল মুছতে। শিশির ভেজা উইকেটে তার স্লোয়ার বা কাটারও গ্রিপ করার কথা নয়।
প্রথম ওভারে চার রান দেওয়ার পর মুস্তাফিজকে আবার বোলিংয়ে আনা হয় পঞ্চদশ ওভারে। ওই ওভারে তাকে একটি চার মারেন নিকোলাস পুরান, ছক্কা মারেন স্টয়নিস। দুটি ডেলিভারিতেই বল উইকেটে পিচ করে সেভাবে থমকে আসেনি। বিশেষ করে, স্টয়নিস যে ছক্কাটি মেরেছেন, সেটি ছিল স্লোয়ার ডেলিভারিই। কিন্তু উইকেটে তা গ্রিপ করেনি একদমই।
এমনকি অষ্টাদশ ওভারেও মুস্তাফিজের অফ কাটারে ছক্কা মারেন স্টয়নিস। বলার অপেক্ষা রাখে না, সেটিও গ্রিপ করেনি উইকেটে।
তবে স্রেফ শিশির ভেজা বল আর উইকেটকে দায় দিয়ে পার পাওয়ার উপায়ও নেই। স্লোয়ার-কাটার উইকেটে না ধরলে মুস্তাফিজের বিকল্প অস্ত্র আর খুব একটা নেই, তা তো জানা কথাই। তবে আঁটসাঁট লেংথে বল করে ব্যাটসম্যানদের কাজ একটু কঠিন করে তোলার চেষ্টা নিশ্চয়ই করা যায়। অভিজ্ঞ এই পেসার সেখানে ছিলেন পুরো ব্যর্থ। বরং চাপে পড়ে বা আতঙ্কিত হয়েই হয়তো এলোমেলো লেংথে বল করতেই দেখা যায় তাকে শেষ দিকে।
অষ্টাদশ ওভারের শেষ বলটি যেমন, অতি নিরীহ এক শর্ট বল করেন তিনি। সেটিকে ছক্কায় ওড়াতে কোনো সমস্যাই হয়নি দিপক হুডার।
শেষ ওভারে তো তার লেংথ ছিল চরম হতাশাজনক। প্রথম দুই বলই করেন তিনি হাফ-ভলি। সেঞ্চুরি করে তখন ভয়ঙ্কর চেহারায় থাকা স্টয়নিসের সামনে এসব ডেলিভারি করা মানে নিজেরই কবর খোঁড়া। তৃতীয় বলটি তিনি হয়তো ওয়াইড ইয়র্কার করতে চেয়েছিলেন, হয়ে যায় ফুল টস। সেটি আবার ছিল নো বল। এরপর আরেকটি ধারহীন শর্ট বল এবং সেখানেই খেলার সমাপ্তি। ছক্কায় শুরুর পর টানা তিনটি চার।
৬৪ বলে ১২৪ রানে অপরাজিত স্টয়নিস। মৌসুমে দ্বিতীয়বার ও চেন্নাইয়ের মাঠে প্রথমবার রান দেওয়ার ফিফটি মুস্তাফিজের।
এবারের রান জোয়ারের আইপিএলে বিশ্ব ক্রিকেটের অনেক বড় বোলাররাও নিয়মিত রান বিলিয়ে দিচ্ছেন দেদার। সেখানে মুস্তাফিজের সামগ্রিক পারফরম্যান্স এই টুর্নামেন্টে এখনও পর্যন্ত খারাপ নয়, মূলত চেন্নাইয়ের মাঠের পারফরম্যান্সের কারণেই। এখনও টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২ উইকেট তার, রান দিয়েছেন যদিও ওভারপ্রতি দশের বেশি। চেন্নাইয়ের চার ম্যাচে উইকেট নিয়েছেন ৯টি। কিন্তু সেই মাঠেই এবার যে বোলিং তিনি করলেন এবং চাপের মধ্যে যেভাবে ভেঙে পড়লেন শেষ সময়ে, বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ দলের জন্যও তা খুব একটা সুখবর নয়!