স্টিভ ওয়াহর ক্যাচটা যদি নিতে পারতেন হার্শেল গিবস কিংবা পরের ম্যাচে অমন পাগলাটে দৌড় না দিতেন অ্যালান ডোনাল্ড, হয়তো বিশ্ব ক্রিকেটের মানচিত্রটা আজ অন্যরকম দেখাতো। যে দুই জয় দিয়ে বিশ্ব শাসনের পথে অস্ট্রেলিয়ার এগিয়ে চলার শুরু, সেই দুই ম্যাচেই জয়ের বাতিঘরের দোরগোড়ায় গিয়ে ফিরে দক্ষিণ আফ্রিকা। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ শ্রেষ্ঠত্ব শুরুর এই আসর দিয়ে বিশ্বকাপে অভিষেক হয় বাংলাদেশের।
Published : 24 May 2019, 05:16 PM
টুর্নামেন্টের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর দল পাকিস্তান সবচেয়ে প্রয়োজনের সময়ে দিশা হারিয়ে ফেলে। একপেশে ফাইনাল জিতে দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া। শিরোপা নির্ধারণী লড়াই শেষ হয়ে যায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের পর দ্বিতীয় দল হিসেবে টেস্টে সেরার আসনে থাকার পাশাপাশি ওয়ানডেতে বিশ্বকাপ জেতে অস্ট্রেলিয়া। শুনতে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, কাজটা মোটেও ততটা সহজ ছিল না। সত্যি হচ্ছে, আগেভাগেই বিদায় নেওয়ার শঙ্কায় ছিল অস্ট্রেলিয়া। সুপার সিক্সের শেষ ম্যাচ খেলার আগে দেশটির সাংবাদিক ও অফিসিয়ালরা দেশে ফিরে যাওয়ার বিমানের টিকেটের খোঁজ নিচ্ছিলেন। সেই দলই দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিতে যায় বিশ্বকাপ।
১৬ বছর পর আবারও বিশ্বকাপ বসে ইংল্যান্ডে। ১৪ মে থেকে ২০ জুন ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্টের সপ্তম আসরে ২১ ভেন্যুতে হয় ৪২ ম্যাচ। এর মধ্যে দুটি ম্যাচ হয় স্কটল্যান্ডে, একটি করে নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড ও ওয়েলসে।
অংশগ্রহণকারী দেশ সেই আগের বিশ্বকাপের মতোই ১২টি; টেস্ট খেলুড়ে ৯ দেশের সঙ্গে আইসিসি ট্রফি থেকে আসা বাংলাদেশ, কেনিয়া ও স্কটল্যান্ড। ১২ দলকে দুই গ্রুপে ভাগ করা পর্যন্ত ফরম্যাটটি পুরনো। এরপরই অদ্ভুত এক ফরম্যাট, দুই গ্রুপের সেরা তিনটি করে দল নিয়ে ‘সুপার সিক্স’।
সুপার সিক্স পর্ব কিন্তু দলগুলো শূন্য হাতে শুরু করেনি। সুপার সিক্সে নিজ গ্রুপ থেকে সঙ্গী হয়ে উঠেছে যে দুই দল, তাদের বিপক্ষে ম্যাচে পাওয়া পয়েন্ট নিয়ে এই পর্ব শুরু করে দলগুলো। এরপর অন্য গ্রুপ থেকে ওঠা তিন দলের বিপক্ষে ম্যাচ খেলতে হয়েছে তাদের। দুটি মিলিয়ে পয়েন্ট তালিকার সবার উপরে থাকা চার দল খেলে সেমি-ফাইনাল।
ইংল্যান্ডের কাছে এই আসর ছিল দেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা ফেরানোর মঞ্চ। কিন্তু গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিতে হয় স্বাগতিকদের!
শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জিতে সুপার সিক্সের পথেই ছিল ইংল্যান্ড। সেখান থেকে বাদ পড়াটা ছিল বেশ কঠিন। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার হারতে হতো জিম্বাবুয়ের কাছে আর ভারতের কাছে বাজেভাবে হারতে হতো ইংল্যান্ডকে। অভাবনীয়ভাবে সব সমীকরণ মিলে যায়। রান রেটে পিছিয়ে থেকে গ্রুপ পর্বেই থমকে যায় ইংলিশরা।
এই বিশ্বকাপের সুপার সিক্সের ম্যাচগুলোয় ছিল ‘স্পিড গান’। স্বাভাবিকভাবে পেসাররা মুখিয়ে ছিলেন সামর্থ্যের পরীক্ষা দিতে। অনুমিতভাবে সবচেয়ে দ্রুত গতির বলগুলো ছিল পেসার শোয়েব আখতারের।
১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় হয়ে যাওয়া আইসিসি ট্রফির ফাইনালে ওঠার মধ্যে দিয়ে অবসান হয় বাংলাদেশের দীর্ঘ অপেক্ষার। শেষ চারের লড়াইয়ে স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে নিশ্চিত করে বিশ্বকাপ। ফাইনালে কেনিয়াকে হারিয়ে শেষটাও রাঙায় তারা।
নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপও বাংলাদেশ স্মরণীয় করে রাখে চমক জাগানিয়া পারফরম্যান্সে। স্কটল্যান্ডের সঙ্গে প্রত্যাশিত জয়টির পর হারিয়ে দেয় তখনও টুর্নামেন্টে অপরাজিত পাকিস্তানকে!
গ্রুপ পর্বের সেটি শেষ দিন। বাংলাদেশের শেষ ম্যাচ, তাই সেরা দল না খেলিয়ে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল বাইরে থাকাদের। সেই দলই গড়ে ইতিহাস। নর্থ্যাম্পটনে ২২৩ রানের পুঁজি নিয়ে পাকিস্তানকে ১৬১ রানে গুটিয়ে দেয় বাংলাদেশ। ব্যাট হাতে গুরুত্বপূর্ণ ২৭ রানের পর বোলিংয়ে দুর্দান্ত স্পেলে ৩ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হন খালেদ মাহমুদ।
১৯৯৯ বিশ্বকাপের বিজ্ঞাপন হয়ে আছেন ল্যান্স ক্লুজনার। পেস বোলিংয়ে ৯ ম্যাচে ১৭ উইকেট নেন তিনি। তবে সেটি ছাপিয়ে যায় ইনিংসের শেষ দিকে নেমে তার ঝড়ো গতির ম্যাচ জেতানো ইনিংসগুলো। দুই অর্ধশতকসহ ২৮১ রান হয়তো এমন কিছু মনে হচ্ছে না। কিন্তু ১৪০.৫০ গড়, ১২২.১৭ স্ট্রাইক রেট এবং ম্যাচ জেতানোয় প্রভাব বিবেচনায় ক্লুজনার ছিলেন অতুলনীয়। বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক টুর্নামেন্টে এমন অলরাউন্ড পারফরম্যান্স দেখাতে পারেননি আর কেউ। তবে তিনিও দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিশ্বকাপ জেতাতে পারেননি।
অদ্ভুতুড়ে ফরম্যাটের কারণে সুপার সিক্স শুরুর সময় পয়েন্ট টেবিলে সবার ওপরে ছিল জিম্বাবুয়ে! ‘এ’ গ্রুপ থেকে তাদের সঙ্গী হিসেবে সুপার সিক্সে আসা দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতের বিপক্ষে জয়ের কারণে সবার ওপরে থাকে জিম্বাবুয়ে। অবশ্য সেখানে টানা তিন ম্যাচ হেরে আর সেমি-ফাইনাল খেলা হয়নি তাদের। ভারত পয়েন্টশূন্য অবস্থায় ওঠে সুপার সিক্সে। সেখানে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে হারালেও তাই শেষ চারে ওঠা হয়নি তাদের।
‘বি’ গ্রুপ থেকে সুপার সিক্সে যায় পাকিস্তান-অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ড। রান রেটে পিছিয়ে বিদায় নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ইংল্যান্ডে আগের তিন আসরের ফাইনালে খেলা ক্যারিবিয়ানদের সঙ্গে বাংলাদেশ ও স্কটল্যান্ড বিদায় নেয় গ্রুপ পর্ব থেকে।
সুপার সিক্সে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটিমাত্র ম্যাচ জিতলেও শীর্ষে থেকে সেমি-ফাইনালে ওঠে পাকিস্তান। এই পর্বের এক জয় নিউ জিল্যান্ডকে তোলে শেষ চারে। আর দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গী হয়ে অস্ট্রেলিয়ার উত্তরণ ছিল সবচেয়ে চমকপ্রদ। শেষ চারে খেলতে হলে অসিদের প্রয়োজন ছিল শেষ ম্যাচে প্রোটিয়াদের হারানো।
হার্শেল গিবসের সেঞ্চুরিতে দক্ষিণ আফ্রিকা তোলে ৭ উইকেটে ২৭১ রান। রান তাড়ায় ৪৮ রানে ৩ উইকেট হারায় অস্ট্রেলিয়া। সেই বিপর্যয় থেকে দলকে টেনে তুলছিলেন রিকি পন্টিং ও স্টিভ ওয়াহ। দক্ষিণ আফ্রিকা সুযোগ পেল ওয়াহকে থামানোর। ৫৬ রানে ল্যান্স ক্লুজনারের বলে ক্যাচ দিলেন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক। মিড উইকেটে গিবস ক্যাচটি নিয়েছিলেন বটে। তবে বল হাতে ভালোভাবে জমানোর আগেই অতি উচ্ছ্বাসে ছুঁড়ে মারতে গিয়ে ফেলে দেন। সেটির চড়া মূল্য দিতে হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস খেলে (১১০ বলে অপরাজিত ১২০) ওয়াহ জিতিয়ে দেন অস্ট্রেলিয়াকে।
চার দিন পর সেমি-ফাইনালে মঞ্চস্থ হয় এই দুই দলের ধ্রুপদী দ্বৈরথ। যেখানে ম্যাচের বাঁকবদল হয় মুহূর্তে মুহূর্তে। অস্ট্রেলিয়া আগে ব্যাটিং করে ২১৩ রানের বেশি করতে পারেনি। শন পোলকের পাঁচ উইকেটে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ তখন দক্ষিণ আফ্রিকার হাতে। ব্যাটিংয়ের অনেকটা সময় জুড়েও তাই ছিল। শেন ওয়ার্নের দুর্দান্ত বোলিংয়ে (১০ ওভারে ২৯ রান দিয়ে চার উইকেট) আবার ফেরে উত্তেজনা।
কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার ক্লুজনার ছিলেন যে! ১৪ বলে ৩১ রানের টর্নেডো ইনিংসে দলকে জিতিয়েই ফেলেছিলেন প্রায়। ডেমিয়েন ফ্লেমিংয়ের করা শেষ ওভারে তাদের প্রয়োজন ছিল ৯ রান। প্রথম দুই বলে চার মেরে প্রয়োজনীয়তাটা মামুলি বানিয়ে ফেলেন ক্লুজনার। চার বলে চাই মোটে এক রান। তৃতীয় বলে রানআউট হতে হতেও বেঁচে যাওয়া, চতুর্থ বলে রক্ষা হয়নি আর। ডোনাল্ডের বোকার মতো দৌড়ে দক্ষিণ আফ্রিকাও অলআউট ২১৩ রানে। ম্যাচ টাই। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী সুপার সিক্সে এগিয়ে থাকায় প্রোটিয়াদের কাঁদিয়ে ফাইনালে ওঠে অসিরা। আর ক্লুজনারের আসনটা হয়ে যায় ট্র্যাজেডির মহানায়কের।
সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ওয়ানডের বিপরীতে অন্য সেমি-ফাইনাল ছিল ম্যাড়মেড়ে। সাঈদ আনোয়ারের সেঞ্চুরিতে নিউ জিল্যান্ডকে সহজেই ৯ উইকেটে হারিয়ে দেয় পাকিস্তান।
লর্ডসের ফাইনালে ঠিক উল্টো অভিজ্ঞতা হয় ওয়াসিম আকরামের দলের। ৩৯.১ ওভার ব্যাটিং করে মাত্র ১৩২ রানে গুটিয়ে যায় পাকিস্তান। অস্ট্রেলিয়া সেই লক্ষ্য ছুঁয়ে ফেলে ২০.১ ওভারে, মাত্র দুই উইকেট হারিয়ে। সেমি-ফাইনালের মতো ফাইনালেও চার উইকেট নিয়ে নায়ক ওয়ার্ন।
অস্ট্রেলিয়ার হ্যাটট্রিক বিশ্বকাপ জয়ের অবিশ্বাস কীর্তির পথে সেটি ছিল প্রথম অধ্যায়।
সবচেয়ে বেশি রান:
ব্যাটসম্যান/দেশ | ম্যাচ | রান | সেরা | গড় | ১০০/৫০ |
রাহুল দ্রাবিড়/ভারত | ৮ | ৪৬১ | ১৪৫ | ৬৫.৮৫ | ২/৩ |
স্টিভ ওয়াহ/অস্ট্রেলিয়া | ১০ | ৩৯৮ | ১২০* | ৭৯.৬০ | ১/২ |
সৌরভ গাঙ্গুলী/ভারত | ৭ | ৩৭৯ | ১৮৩ | ৫৪.১৪ | ১/১ |
মার্ক ওয়াহ/অস্ট্রেলিয়া | ১০ | ৩৭৫ | ১০৪ | ৪১.৬৬ | ১/২ |
সাঈদ আনোয়ার/পাকিস্তান | ১০ | ৩৬৮ | ১১৩* | ৪০.৮৮ | ২/০ |
সবচেয়ে বেশি উইকেট:
বোলার/দেশ | ম্যাচ | উইকেট | সেরা | গড় | ইকোনমি |
জিওফ অ্যালট/নিউ জিল্যান্ড | ৯ | ২০ | ৪/৩৭ | ১৬.২৫ | ৩.৭০ |
শেন ওয়ার্ন/অস্ট্রেলিয়া | ১০ | ২০ | ৪/২৯ | ১৮.০৫ | ৩.৮২ |
গ্লেন ম্যাকগ্রা/অস্ট্রেলিয়া | ১০ | ১৮ | ৫/১৪ | ২০.৩৮ | ৩.৮৩ |
ল্যান্স ক্লুজনার/দক্ষিণ আফ্রিকা | ৯ | ১৭ | ৫/২১ | ২০.৫৮ | ৪.৬১ |
সাকলাইন মুশতাক/পাকিস্তান | ১০ | ১৭ | ৫/৩৫ | ২১.২৯ | ৪.৫২ |