কথায় বলা হয়, প্রেম ও যুদ্ধে সবই ন্যায্য। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে এটিই ছিল সাকিব আল হাসানের দর্শন। অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসকে ‘টাইমড আউট’ করা নিয়ে তার ব্যাখ্যাতেও ফুটে উঠল তা। ভুল-ঠিকের বিচার তিনি করেননি। যুদ্ধের ময়দানের জয়ের প্রবল তাড়নাই এই আউটের সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করেছে বলে জানালেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
দিল্লিতে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচের তুমুল আলোচিত ঘটনা এটি। ম্যাচের ২৫তম ওভারে বাংলাদেশ দল ‘টাইমড আউট’ করে দেয় ম্যাথিউসকে। কোনো বল না খেলেই আউট হন শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৪৬ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো ব্যাটসম্যান ‘টাইমড আউট’ হন।
টিভি ধারাভাষ্যকারদের কাছ থেকে জানা যায়, আম্পায়ার মারাইস ইরাসমাস দুই দফায় সাকিবকে জিজ্ঞেস করেন যে তিনি আবেদন তুলে নিতে চান কি না। সাকিব তুলে নেননি।
ম্যাচের পর পুরস্কার বিতরণী আয়োজনে স্বাভাবিকভাবেই এই প্রসঙ্গ ওঠে। সঞ্চালক ও সাবেক ভারতীয় ব্যাটসম্যান সাঞ্জায় মাঞ্জরেকারের প্রশ্নে সাকিব শোনান তার সিদ্ধান্তের পেছনের প্রেক্ষাপট।
“আমাদের দলের একজন ফিল্ডার এসে আমাকে বলেছিল যে ‘এখন যদি আপনি আবেদন করেন, তাহলে আউট হবে।’ এরপর আমি আবেদন করি। আম্পায়ার আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি সিরিয়াস কি না, আমি আবেদন তুলে নিতে চাই কি না। আমি বলেছি, ‘না, যদি এটা নিয়মে থাকে এবং যদি আউট হয়, আমি (আবেদন) ফিরিয়ে নেব না।”
মাঞ্জরেকার পরে সাকিবকে জিজ্ঞেস করেন, এরকম আউটের ভাবনা তার সবসময়ই ছিল কি না। সাকিব সেটির গভীরে না গিয়ে থাকতে চাইলেন এই ম্যাচের ঘটনাতেই।
“এটা যদি নিয়মে থাকে… আমি জানি না এটা ঠিক নাকি ভুল। আমার মনে হয়েছে, যুদ্ধে আছি এবং আমার দলের জয় নিশ্চিত করার জন্য সিদ্ধান্ত নিতে হতো আমাকে। সেটার জন্য যা করা দরকার, করতে হবে আমাকে। ঠিক নাকি ভুল, এ বিতর্ক থাকবে। তবে যদি এটা নিয়মে থাকে, তাহলে সেই সুযোগ নেওয়ায় আপত্তির কিছু দেখি না।”
বল হাতে এই ম্যাচে ২ উইকেট নেন সাকিব। এরপর ব্যাটিংয়ে চার নম্বরে নামেন চাপের মুখে। তার দিকে লঙ্কানদের স্লেজিং ছুটে যাচ্ছিল অনেক। শর্ট বলে ঘায়েল করার চেষ্টা তো ছিলই। তবে সাকিব তাতে নুইয়ে পড়েননি। এই বিশ্বকাপে আগের ৬ ইনিংস মিলিয়ে ১০৪ রান করা ব্যাটসম্যান এই ম্যাচেই জ্বলে ওঠেন। ১২ চার ও ২ ছক্কায় উপহার দেন ৬৫ বলে ৮২ রানের দুর্দান্ত ইনিংস।
ম্যাথিউসের ঘটনাই তাকে তাতিয়ে দিয়েছিল কি না, এই প্রশ্নে রাখঢাক না রেখেই সরাসরি উত্তরটা জানিয়ে দিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
“এসব ব্যাপার সবসময়ই সহায়তা করে… আরেকটু বেশি লড়াই করতে। আমার বয়স এখন ৩৬, সাধারণত সবসময় লড়াইয়ের তাড়না আসে না। তবে আজকে এটা সহায়তা করেছে একদিক থেকে।”
ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনেও অনুমিতভাবে প্রচুর প্রশ্ন হলো এই ঘটনা নিয়ে। প্রথম প্রশ্নটিই ছিল, এই আউট করা নিয়ে কোনো আক্ষেপ বা আফসোস আছে কি না। সাকিবের অকপট উত্তর, “একটুও নয়।”
ঘটনার বর্ণনা জানতে চাওয়া হলে হাসিমুখে আবার বিবরণ দেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
“আমাদের একজন ফিল্ডার এসে বলে যে, ‘এখন যদি আবেদন করেন, তাহলে আইন অনুযায়ী সে আউট। কারণ সে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গার্ড নেয়নি।’ আমি এরপর আপিল করি। আম্পায়ার আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে, আবেদন তুলে নিতে চাই কি না। কারণ, আউট দিয়ে দেওয়ার পর ফিরিয়ে আনা ভালো দেখায় না। আমি বলি যে, ‘আমি ফেরাব না।”
“অ্যাঞ্জেলোকে (ম্যাথিউস) আমি অনেক বছর ধরে চিনি, সেই ২০০৬ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের সময় থেকে। তো… দুর্ভাগ্যজনক, তবে নিয়মেই মধ্যেই।”
নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ব্যাটসম্যান ক্রিজ ছেড়ে যাওয়ার পর পরবর্তী ব্যাটসম্যানকে পরের বল খেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে ২ মিনিটের মধ্যে।
ম্যাথিউস উইকেটে যাওয়ার পর গার্ড নিয়ে ফেলেছিলেন। এরপর হেলমেট আঁটসাঁট করার চেষ্টায় স্ট্র্যাপ ছিড়ে যায়। তখন নতুন হেলমেটের জন্য ড্রেসিং রুমের দিকে ইশারা করেন তিনি। বাংলাদেশ আউটের আবেদন করে তখনই।
ম্যাচের মাঝ বিরতিতে চতুর্থ আম্পায়ার এড্রিয়ান হোল্ডস্টক জানান, স্ট্র্যাপ ছেড়ার ঘটনার আগেই ২ মিনিট পেরিয়ে গেছে। তবে টিভিতে পরে দেখা যায়, ১ মিনিট ৫২ সেকেন্ডের সময়ই গার্ড নিয়ে নেন ম্যাথিউস। ১ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডে স্ট্র্যাপ ছেড়ার ঘটনা ঘটে।
এই আউটের আবেদন নিয়ে সাকিবের সঙ্গেও তখন কিছু একটা বলেন ম্যাথিউস। সংবাদ সম্মেলনে সেটিও শোনালেন সাকিব।
"আগেই যেটি বললাম যে, আমরা ২০০৬ থেকে একসঙ্গে খেলছি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও আমরা অনেক খেলেছি। আমি তাকে ভালোভাবে চিনি, সেও আমাকে ভালোভাবে চেনে। সে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে যে আমি আবেদন তুলে নেব কি না। আমি তাকে বলি যে, 'আমি তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি, এটা দুর্ভাগ্যজনক। তবে আমি আবেদন তুলে নেব না।"
ম্যাথিউস দেরি করার কারণে বাংলাদেশের মন্থর ওভার রেটের ঝুঁকি থাকতে পারে, এরকম ভাবনা অবশ্য উড়িয়ে দিলেন সাকিব। জানিয়ে দিলেন, বাংলাদেশের ওভাররেট ভালোই ছিল।
অবধারিতভাবে ‘স্পিরিট অব ক্রিকেট’-এর প্রসঙ্গও এলো। সাকিব মুচকি হাসিতে আবারও উত্তর দিলেন সরাসরি, “তাহলে তো আইসিসির উচিত এই ব্যাপারটি দেখা ও নিয়ম বদলানো।”
দল এরকম দুঃসময়ে না থাকলে বা জয়ের জন্য এতটা মরিয়া না থাকলে এই আউটের সিদ্ধান্ত নিতেন কি না, এমন প্রশ্নও হলো। সাকিব আবারও বললেন সেই যুদ্ধ-পরিস্থিতির কথাই।
"করতাম কি না জানি না ( দলের এরকম অবস্থা না থাকলে)... তবে আজকের ম্যাচে আমাদের জিততেই হতো। আমরা যদি যুদ্ধে নামি, তাহলে যুদ্ধে আপনার দলকে বা দেশকে জেতাতে সবকিছু করতে রাজি থাকা উচিত বলে মনে করি। আমি সেটাই করেছি।"
অনেক সময় লোকে নিজে যখন কোনো কিছুর ভেতর দিয়ে যায় বা নিজের কোনো তেতো অভিজ্ঞতা হয়, তাহলে সত্যিকারের অনুভূতি হয়। সাকিবের কাছেও প্রশ্ন ছিল, ম্যাথিউসের জায়গায় তিনি নিজে এভাবে আউট হলে কী একইরকম ভাবতেন? উত্তরে সাকিবও পাল্টা গোলা ছুড়লেন।
“আমি হলে আরও সতর্ক থাকব… আমার এসব হয় না।”