ম্যাচ শেষে পুরষ্কার বিতরণী আয়োজনে সাঞ্জায় মাঞ্জরেকারের সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ে খানিকটা হাসি ফুটে উঠল কেন উইলিয়ামসনের মুখে। তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ঝুলে রইল পরে সংবাদ সম্মেলনেও। একজন প্রশ্ন করলেন, “সেমি-ফাইনালে হারের পর হতাশ থাকারই কথা, তার পরও আপনার মুখে হাসি… আপনি এত চমৎকার একজন মানুষ…।” উইলিয়ামসন হাসিমুখেই বললেন, “জিততে পারলে হাসি আরও চওড়া হতো…!”
এটাই উইলিয়ামসন। কিংবা নিউ জিল্যান্ডের বেশির ভাগ ক্রিকেটার। পেশাদারিত্ব দিয়েই পরাজয়ের ধাক্কা সামলান তারা। দল হিসেবে, একেকজন মানুষ হিসেবে তারা এত ভালো যে, হারের তাৎক্ষণিক ব্যাথাকে চাপা দিয়ে হাসিমুখে কথা বলতে পারেন খেলার স্পিরিটকে সবার ওপরে জায়গা দিয়ে।
কষ্ট নিশ্চয়ই তাদেরও লাগে, হতাশায় মন ছেয়ে যায়, যন্ত্রণায় হৃদয় বিদ্ধ হয়। উইলিয়ামসনের যে হাসি, ভালো করে খেয়াল করলে সেখানে কি বেদনার ছাপও কি চোখে পড়ে না? কিংবা তার চোখে-মুখে শূন্যতার ছাপ?
তাদেরও মনে হতে পারে, আর কত! এ নিয়ে টানা পাঁচটি ওয়ানডে বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনাল খেলল নিউ জিল্যান্ড। উইলিয়ামসন সঙ্গী গত চার বিশ্বকাপ অভিযানে। কিন্তু একটি শিরোপার আশা তাদের পূরণ হলো না। গত পাঁচ আসরের সবচেয়ে ধারাবাহিক দল হয়েও বিশ্বকাপ ট্রফি পায়নি তারা। তাদের ইতিহাসেই নেই একটিও।
২০০৭ ও ২০১১ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে তারা আটকে যায় শ্রীলঙ্কার কাছে। নিজ দেশে ২০১৫ বিশ্বকাপে ব্রেন্ডন ম্যাককালামের নেতৃত্বে আগ্রাসী ও আকর্ষণীয় ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলে তারা দারুণ নজর কাড়ে। দুর্দান্ত ধারাবাহিকতাও দেখায়। কিন্ত ফাইনালে তাদের স্বপ্ন পিষ্ট হয়ে যায় অস্ট্রেলিয়ার নির্মম পেশদারিত্বের কাছে।
সেখান থেকে ২০১৯ বিশ্বকাপে আরেকটু এগিয়ে যায় তারা। অসাধারণ পারফরম্যান্সে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন উইলিয়ামসন। স্বাগতিক ইংল্যান্ডের সঙ্গে লর্ডসে সমান তালেই লড়ে যায় তারা। ক্রিকেটের কোনো চিরায়ত নিয়মেই তারা হারেনি। কিন্তু তবু ট্রফি ছোঁয়া হয়নি ওই বিশ্বকাপের উদ্ভট নিয়মের খাড়ায় কাটা পড়ে। স্রেফ বাউন্ডারি কম মারায় আবারও রানার্স আপ হয়েই শেষ করতে হয় আসর।
এটা নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। সেই নিয়মও পরে বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু ফাইনাল শেষে সংবাদ সম্মেলনে বারংবার প্রশ্নেও কোনো অভিযোগ-আপত্তির আভাস মাত্র ফুটে ওঠেনি উইলিয়ামসনের কণ্ঠে। কখনোই নিজেকে বা নিজেদের খেলাটার চেয়ে বড় করে তোলেননি তিনি।
এবার বিশ্বকাপের আগে তাদের সম্ভাবনা খুব বেশি উজ্জ্বল দেখেননি অনেকেই। উইলিয়ামসন নিজে চোট নিয়ে বিশ্বকাপে আসেন, তার খেলা ছিল অনিশ্চিত। দলে চোট সমস্যা ছিল আরও। উপমহাদেশের কন্ডিশনের কতটা উপযোগী স্কোয়াড তাদের, এই সংশয়ও ছিল। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ঠিকই তারা শেষ চারে পৌঁছে যায়। কিন্তু এবার আর ফাইনালে ওঠার হ্যাটট্রিকও হলো না!
আক্ষেপ-হতাশা তারও আছে তাতে। তবে প্রতিপক্ষ যখন এতটা দুর্দান্ত খেলে, তাদেরকে প্রাপ্য কৃতিত্বটুকু দিতেও জানেন তিনি।
“ভারত সিরিয়াস রকমের ভালো ক্রিকেট খেলছে। তারা খুবই মানসম্পন্ন একটা দল, যারা নিজেদের খেলার চূড়ায় আছে। টুর্নামেন্টজুড়ে তারা যা করে আসছে, সেমি-ফাইনালে সেটির পুনরাবৃত্তি করাটাও বুঝিয়ে দেয়, দল হিসেবে তারা এখন কোথায় আছে। ম্যাচের প্রথম ভাগেই তারা আমাদের প্রবল চাপে ফেলে দেয় এবং তা ছিল খুবই কঠিন। ভারত আজকে অসাধারণ ছিল, এটার প্রশংসা করতেই হবে।”
সেমি-ফাইনালের উইকেট বদলে ফেলা নিয়ে ম্যাচের আগে যে তোলপাড়, সেটিকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো তো বহুদূর, এই প্রসঙ্গকেই তিনি পাত্তা দিলেন না।
“হ্যাঁ, আগে ব্যবহৃত উইকেটে খেলা হয়েছে। তবে সত্যি বলতে, বেশ ভালো উইকেট ছিল, সবাই দেখেছি আমরা। ম্যাচের প্রথম ভাগে ওরা দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছে। আর ম্যাচের পরের ভাগে কৃত্রিম আলোয় কন্ডিশন বদলে যাওয়ার যে ব্যাপারটি, সেটি তো টুর্নামেন্টজুড়েই দেখা গেছে।”
“এসবে তাই সমস্যা নেই। বরং প্রত্যাশিতই ছিল আমাদের। ওরা দারুণ খেলেছে। এই পর্যায়ে থমক যাওয়াটা হতাশার। তবে আমরা শ্রেয়তর দলের কাছেই হেরেছি।”
আরও একটি নক আউট ম্যাচ হারের হতাশাটা তার আছে। তবে তিনি দেখছেন বৃহত্তর ছবিটা। সেখানে দলকে নিয়ে গর্ব করার উপলক্ষও পাচ্ছেন কিউই অধিনায়ক।
“আমরা চেষ্টা করি নিজেদের ক্রিকেটে মনোযোগ দেওয়ার… ব্যাপারটি স্রেফ এক দিনের নয়। আমরা লম্বা সময় দেখি, এখানে আমাদের পুরো সময়টায় ফিরে তাকাই। জানি, পরাজয়টা এখনও তাৎক্ষণিক এবং পরের ধাপে যেতে না পারাটা হতাশার। তবে দল হিসেবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে এবং সঠিক সময়ে ঠিক কাজগুলি করার পথে আমরা অনেক কিছুই ভালো করেছি এই আসরে।”
“খেলাটা স্রেফ এক দিনের নয়, সাত সপ্তাহের ক্রিকেট ছিল। আমার মনে হয়, দল হিসেবে আমরা গর্বিত হতে এই টুর্নামেন্টে যা করেছি। আজকের দিনটায় আমাদের স্রেফ হয়ে ওঠেনি।”
এভাবেই সেমি-ফাইনাল বা ফাইনালে তাদের হয় না। শুধু ওয়ানডে বিশ্বকাপই তো নয়, টি-টোয়েন্টিতেও সবশেষ তিন বিশ্বকাপে সেমি-ফাইনালে খেলেছে তারা, এর মধ্যে একবার খেলেছে ফাইনালে। কিন্তু ওই হয়ে, তাদের এখানে হয় না। কোনোভাবেই হয় না।
দল নিয়ে গর্বের কথা বলার সময় এবং নানা সময়েই তার মুখে এক চিলতে হাসি থাকলই। তবে সেই হাসির অর্থও হয়তো সবার জানা।
সব হাসিতে তো আর খুশি থাকে না!