হাত ভেঙে যাওয়ায় ছিটকে যান তিনি, তারপরও তাকে বিশ্বকাপ দলে রাখে অস্ট্রেলিয়া, চোটের কারণে খেলতে পারেননি বিশ্বকাপে দলের প্রথম ৫ ম্যাচ, শেষ পর্যন্ত তিনিই সেমি-ফাইনাল ও ফাইনালের নায়ক।
Published : 19 Nov 2023, 11:57 PM
কারও কি মনে আছে, ট্রাভিস হেড বিশ্বকাপ খেলতে ভারতে পা রেখেছেন ফাইনালের স্রেফ এক মাস আগে! হ্যাঁ, গত ১৯ অক্টোবর দলের সঙ্গে যোগ দেন তিনি। অস্ট্রেলিয়া ততদিনে বিশ্বকাপে ৩টি ম্যাচ খেলে ফেলেছে। ভারতে আসার পরও দুটি ম্যাচ তাকে বসে থাকতে হয় ডাগ আউটে। তখন কি একজনও ভাবতে পেরেছিলেন, এই তিনিই হবেন অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ব জয়ের নায়ক!
তার নিজের মনের কোণে নিশ্চয়ই ছিল। বড় মঞ্চ মানেই তো হেডের মাথা উঁচু!
বিশ্বকাপ ফাইনালের নায়ক তিনি, ভারতীয় বোলিং গুঁড়িয়ে দিয়েছেন আগ্রাসী সেঞ্চুরিতে। তবে স্রেফ এক ম্যাচের জন্যই তো আর তাকে এত বড় স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। একটু পেছনে ফেরা যাক।
২০২১-২২ অ্যাশেজের ব্রিজবেন টেস্ট। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দেশের মাঠে তার প্রথম টেস্ট। হেড কী করলেন? ১৫২ রানের ইনিংস খেললেন স্রেফ ১৪৮ বলে।
এবার একটু ‘ফাস্ট-ফরোয়ার্ড’ করে চলে আসা যাক এই বছরের জুনে। ইংল্যান্ডে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল। এবার ভারতীয় বোলিং বিধ্বস্ত করে হেড খেললেন ১৭৪ বলে ১৬৩ রানের ইনিংস।
টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম শিরোপা জয়ে ম্যান অব দা ফাইনাল হেড।
এরপর বিশ্বকাপের পথে এগিয়ে চলা। দারুণ ফর্মে ছিলেন তিনি। ওপেনিংয়ে উড়ন্ত সূচনা এনে দেওয়ায় অস্ট্রেলিয়ার ভরসা। বিশ্বকাপেও তিনি দলীয় পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গড়বড় হয়ে গেল বিশ্বকাপ শুরুর স্রেফ সপ্তাহ তিনেক আগে।
দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে চতুর্থ ওয়ানডেতে জেরল্ড কুটসিয়ার একটি শর্ট বল ছোবল দিল তার বাঁহাতে। মাঠেই কিছুটা চিকিৎসা নিয়ে তিনি খেলা চালাতে চাইলেন। কিন্তু একটু পরই মাঠ ছাড়তে হলো ব্যথা নিয়ে। পরে স্ক্যানে ধরা পড়ল, চিড় ধরেছে হাতে।
হেডের তখন মাথায় হাত, অস্ট্রেলিয়ার ম্যানেজমেন্টেরও।
বিশ্বকাপ দল ঘোষণায় অনেক আলোচনা হলো তাকে নিয়ে। শেষ পর্যন্ত তার ওপর ভরসা রাখল দল। যদিও বিশ্বকাপের প্রথম কয়েকটি ম্যাচ, এমনকি প্রাথমিক পর্বের অর্ধেকের বেশি ম্যাচেই তাকে না পাওয়ার শঙ্কা ছিল। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ছিল তার ওপর সবার ভরসা। যখনই তিনি ফিরবেন, দলের কাজে লাগবে।
দল চলে আসে বিশ্বকাপ খেলতে। তিনি দেশে অপেক্ষায় থাকেন সুস্থ হওয়ার। চোট পাওয়ার পর প্রথমবার নেটে ব্যাট করতে নামেন তিনি গত ১৫ অক্টোবর। ততদিনে অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে দুটি ম্যাচ খেলে দুটিতেই হেরেছে, পরদিনই তাদের শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ।
নেটে দিন তিনেক ব্যাট করে গত ১৯ অক্টোবর তিনি দলের সঙ্গে যোগ দেন ভারতে। ২৫ অক্টোবর নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে তাকে ফেরানোর লক্ষ্য ঠিক করা হয়। কিন্তু তখনও শতভাগ প্রস্তুত নন তিনি। শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক পর্বের ৯ ম্যাচের ৫টি চলে যাওয়ার পর তিনি প্রথমবার মাঠে নামতে পারেন। ২৯ বছর বয়সে তার বিশ্বকাপ অভিষেক। বড় এক উপলক্ষ বটে!
আর বড় কিছু মানেই তো তার জ্বলে ওঠা! নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সেদিন ৬৭ বলে ১০৯ রানের ইনিংস খেলে জিতে নিলেন ম্যাচ সেরার খেতাব।
এরপর টানা তিন ম্যাচে তিনি ম্রিয়মান। হয়তো উপযুক্ত উপলক্ষ পাচ্ছিলেন না নিজেকে তাতিয়ে তুলতে!
সেমি-ফাইনাল তাকে জাগিয়ে তুলল। শুরুতে বল হাতে শিকার করলেন মহাগুরুত্বপূর্ণ দুটি উইকেট। দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসের মোড় ঘুরিয়ে দিল যা। এরপর ব্যাট হাতে তুললেন ঝড়। ব্যাটিং প্রতিকূল উইকেটে, যেভানে ধুকছিলেন বেশিরভাগ ব্যাটসম্যান ও তার সতীর্থরা, সেখানে তিনি খেললেন ৪৮ বলে ৬২ রানের ইনিংস। ছোট কিন্তু চ্যালেঞ্জিং রান তাড়ায় সেই ইনিংসই গড়ে দিল বড় পার্থক্য। আবার তিনি ম্যাচ সেরা।
এরপর ফাইনাল। এখনও পর্যন্ত তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় মঞ্চ। তাকে তো জ্বলে উঠতেই হবে। শুরুতে ঝলক দেখালেন ফিল্ডিংয়ে। রোহিত শার্মা যখন খুনে ব্যাটিংয়ে অস্ট্রেলিয়ার মাথাব্যথা হয়ে উঠছেন, তখন হেডের অসাধারণ এক ক্যাচে মাথা নিচু করে ফিরতে হয় ভারতীয় অধিনায়ককে। দুর্দান্ত ফিল্ডিং করেন তিনি ইনিংসজুড়েই।
এরপর আসল কাজ। ব্যাট হাতে নামলেন রান তাড়ায় দলকে ভালো শুরু এনে দেওয়ার লক্ষ্যে। প্রথম ওভারে দুটি চার মারলেন। আরেক প্রান্তে দল একে একে তিন উইকেট হারাল। হেড খোলসে ঢুকে গেলেন। বিপর্যয় এড়ালেন নিজের সহজাত সত্ত্বা আড়াল রেখে। এরপর সময়ের সঙ্গে আবার আবির্ভূত হলেন আপন চেহারায়।
ঝলমলে সব স্ট্রোকের দীপ্তি ছড়িয়ে ভারতের উৎসবের আয়োজন ম্লান করে যখন তিনি ফিরছেন, অস্ট্রেলিয়ার জয় স্রেফ সময়ের ব্যাপার।
১৫ চার ও ৪ ছক্কায় ১২০ বলে ১৩৭। ওয়ানডেতে এর চেয়ে বড় ইনিংস তার আছে। টেস্টে তো আছেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার সেরা ইনিংস বললে, নিজের প্রিয় ইনিংস বললেও নিশ্চয়ই এখন চোখ বন্ধ করে বেছে নেবেন এটিকেই!
যথারীতি আরেকটি ম্যান অব দা ফাইনাল পুরস্কারও উঠল তার হাতেই।
দারুণ কিছু পারফরম্যান্সের পরও কিছুটা আড়ালেই পড়ে থাকতেন তিনি। ঠিক তারকার মর্যাদা তিনি পাননি। এবার তিনি আলোকিত করলেন সবচেয়ে বড় মঞ্চ। তারকার কাতারেও নিশ্চয়ই থাকবেন এখন থেকে!
একই বিশ্বকাপে সেমি-ফাইনাল ও ফাইনালে ম্যাচ সেরা হয়েছেন এর আগে ১৯৮৩ বিশ্বকাপে মহিন্দার আমারনাথ, ১৯৯৬ বিশ্বকাপে আরাভিন্দা ডি সিলভা ও ১৯৯৯ বিশ্বকাপে শেন ওয়ার্ন। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে বিশ্বকাপের ফাইনালে সেঞ্চুরি করেছেন আগে রিকি পন্টিং ও অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। এই কিংবদন্তিদের পাশেই এখন তার নাম।
তার ক্যারিয়ারের যা বয়স আর যেমন চিত্র, কিংবদন্তি হয়ে উঠতে এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে তাকে। তবে বড় উপলক্ষ যেভাবে রাঙিয়ে চলেছেন তিনি, যেভাবে প্রভাববিস্তারি পারফরম্যান্সে ভূমিকা রাখছেন দলে, সতীর্থদের কাছে তিনি এখনই ওই উচ্চতায় উঠে গেছেন!
ফাইনাল শেষে অধিনায়ক প্যাট কামিন্সের উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়ায় ফুটে উঠল তা।
“ওর (হেড) হাত ভেঙে যাওয়ার পরও নির্বাচকরা ওর পাশে থেকেছে এবং সাহস দিয়ে গেছে। বড় একটা ঝুঁকি নেওয়া হয়েছিল, তা কাজে লেগেছে। ওকে দেখা কত আনন্দময়, তাই না? ও আমাদের সত্যিকারের লেজেন্ড, আমরা ওকে ভালোবাসি।”
হেডের নিজের কাছে অবশ্য নিজের কীর্তির চেয়ে বেশি ভালো লাগছে দলের এমন সাফল্যের অংশ হতে পেরে।
“কী অসাধারণ একটা দিন! এই দিনের অংশ হতে পেরে আমি রোমাঞ্চিত। বাড়িতে সোফায় বসে বিশ্বকাপ দেখার চেয়ে এখানে থাকা নিশ্চয়ই বেশি ভালো!”
“(রান তাড়ায়) কিছুটা নার্ভাস ছিলাম আমি। তবে মার্নাস দারুণ খেলেছে এবং সব চাপ শুষে নিয়েছে। শুরুতে মিচ (মিচেল মার্শ) যেভাবে পাল্টা আক্রমণ করেছে, সেটাও জরুরি ছিল। এই প্রাণশক্তিই আমাদের প্রয়োজন ছিল।”
হেডকে দারুণ তৃপ্তি দিয়েছে রোহিত শার্মার ক্যাচটি। এই সুখস্মৃতি তিনি বয়ে বেড়াবেন আজীবন।
“সে (রোহিত) সম্ভবত আজকে দুনিয়ার সবচেয়ে দুর্ভাগা লোক! এসব নিয়ে আমি আসলে কঠোর পরিশ্রম করি। ভাবতে পারিনি ফাইনালে সেঞ্চুরি করব, ভাবতে পারিনি ওই ক্যাচ হাতে জমাতে পারব। সবারই চাওয়া থাকে দলে অবদান রাখা। এত বড় মঞ্চে, ঠাসা গ্যালারির সামনে এতটা চাপের মধ্যে এমন কিছু করতে পেরে ভালো লাগছে এবং আজীবন আমি ফিরে তাকাব এই দিনটিতে।”
তার এই দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট ইতিহাসেও। হাত ভেঙে যাওয়ার পরও তার ওপর ভরসা রেখেছিল দল, তার হাত ধরেই বিশ্বকাপ ট্রফি যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ায়। তাকে তো মনে রাখতেই হবে!