কুমিল্লাকে প্রথম ফাইনাল হারের স্বাদ দিয়ে বরিশালের প্রথম শিরোপা

রেকর্ড চারবারের চ্যাম্পিয়নদের উড়িয়ে বিপিএলের শিরোপা জিতে নিল তামিম ইকবালের ফরচুন বরিশাল।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 March 2024, 04:17 PM
Updated : 1 March 2024, 04:17 PM

ডেভিড মিলারের বাউন্ডারিতে ম্যাচ শেষ হতেই যেন দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। বরিশালের ডাগ আউট থেকে কে আগে পৌঁছবে মাঠের মাঝে! সেখানে কে জয়ী হলেন, বলা কঠিন। বেশ কজন যে একসঙ্গেই পৌঁছে গেলেন! ক্রিজে থাকা মাহমুদউল্লাহ তখন সিজদা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সুযোগটি পেলেন না, তাকে ওপরে তুলে নিলেন সতীর্থরা। বাকিরাও মেতে উঠেছেন বাঁধনহারা উদযাপনে। প্রথম শিরোপার উল্লাস! 

বিপিএলের ফাইনালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সকে ৬ উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন ফরচুন বরিশাল। 

রেকর্ড চারবারের চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লা ফাইনালে হারের স্বাদ পেল এই প্রথম। বরিশালের কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি চারবার ফাইনাল খেলে শিরোপা জিতল এই প্রথম।

মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে বরিশালকে জয়ের পথে অনেকটা এগিয়ে দেয় বোলারদের দারুণ নিয়ন্ত্রিত পারফরম্যান্স। কুমিল্লার বিস্ফোরক ব্যাটিং লাইন আপকে তারা আটকে রাখে ২০ ওভারে ১৫৪ রানে। 

সেই রান তাড়ায় জিততে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি বরিশালকে। তামিম ইকবালের দারুণ এক ক্যামিও আর পরে কাইল মেয়ার্সের আরও একটি কার্যকর ইনিংসে তারা ম্যাচ শেষ করে এক ওভার বাকি রেখে। 

অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে ম্যাচের সেরা কাইল মেয়ার্স। আসরের সর্বোচ্চ রান করে টুর্নামেন্ট সেরা তামিম। তবে অভিজ্ঞ এই ওপেনারের প্রাপ্তির শেষ নয় এখানেই। তার যদিও এটি দ্বিতীয় বিপিএল শিরোপা, তবে অধিনায়ক হিসেবে ট্রফি জিতলেন এই প্রথম।

প্রথম প্রাপ্তির ছোঁয়ার উদ্ভাসিত হয়েছেন মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহও। দেশের ক্রিকেটের অভিজ্ঞ দুই সেনানী প্রথমবার জিতলেন বিপিএলের ট্রফি। 

কুমিল্লার ইনিংসের শুরুটা ছিল নাটকীয়। ম্যাচের দ্বিতীয় বলে কাইল মেয়ার্সকে দারুণ শটে চার মারেন সুনিল নারাইন। পরের বলেই থার্ডম্যানে তার ক্যাচ ছাড়েন ওবেড ম্যাককয়। তবে পুষিয়ে দিতে সময় খুব একটা নেননি তিনি। ওই ওভারেই শর্ট ফাইন লেগে তার অসাধারণ এক রিফ্লেক্স ক্যাচে ৫ রানে বিদায় নেন নারাইন।

তাতে দমে না গিয়ে পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করেন লিটন কুমার দাস ও তাওহিদ হৃদয়। দ্বিতীয় ওভারে দুজন মিলে তিনটি চার মারেন সাইফ উদ্দিনকে। তবে কারও প্রচেষ্টাই সফল হয়নি। দুজনই আউট হন জেমস ফুলারের বলে থার্ড ম্যানে ক্যাচ দিয়ে, দুটিই মুঠোয় জমান মাহমুদউল্লাহ। 

গত বিপিএলের ফাইনালের নায়ক জনসন চার্লস এবারও সেরকম কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। ক্রিজে যাওয়ার পরপরই দুটি ছক্কা মারেন তিনি ফুলার ও তাইজুল ইসলামকে। তবে বাকি সময়টায় আঁটসাঁট বোলিংয়ে তাকে আটকে রাখেন বরিশালের বোলাররা। এতেই ধৈর্য হারিয়ে ওবেড ম্যাককয়কে উড়িয়ে মারার চেষ্টায় তার ইনিংস থামে ১৭ বলে ১৫ রান করে। 

কুমিল্লার রানের গতি ওই সময়টায় কমে যায় বেশ। মইন আলিকেও শুরুতেই থামায় পয়েন্ট থেকে মেহেদী হাসান মিরাজের বুলেট গতির থ্রো। আরেকপ্রান্তে টাইমিং করতে ভুগছিলেন মাহিদুল ইসলাম অঙ্কন। এক পর্যায়ে তার রান ছিল ১৯ বলে ১২। 

আন্দ্রে রাসেলকে বাইরে রেখে জাকের আলিকে আগে নামায় কুমিল্লা। মাহিদুলের সঙ্গে তার জুটি টিকে থাকে বেশ অনেকটা সময়। তবে রানের গতিতে দম দিতে ব্যর্থ হন দুজনই। ফুলারের স্লোয়ার লেংথ বলে মাহিদুল একটি ছক্কা মারেন বটে। তবে ইনিংসকে গতিময় করতে পারছিলেন না। পরিস্থিতির দাবি মেটাতে পারছিলেন না জাকেরও।

পরে সাইফউদ্দিনকে একটি ছক্কার পরও মাহিদুলের ইনিংস থামে ৩৫ বলে ৩৮ রান করে। রাসেল ক্রিজে নামেন সপ্তদশ ওভারে। ম্যাককয়ের শর্ট বলে একটি ছক্কার পর ফুলারের ওভারে মারেন তিনি তিনটি ছক্কা। এর মধ্যে একটি ছিল ৯৮ মিটার লম্বা, এবারের বিপিএলের যা সবচেয়ে বড় ছয়। 

শেষ দুই ওভারে চার দফায় সিঙ্গেল নেওয়ার সুযোগ থাকলেও জাকেরের ওপর ভরসা না করে নিজে স্ট্রাইক রাখেন রাসেল। তবে শেষ ওভারে তাকে একদমই সুবিধা করতে দেননি সাইফউদ্দিন। লেগ-মিডলে ইয়র্কার ও ওয়াইড ইয়র্কার মিলিয়ে অসাধারণ একটি ওভার করেন এই পেসার। সেই চেষ্টার পথে তিনটি ওয়াইড ও একটি নো বল করেন তিনি। তার পরও ওভার থেকে আসে কেবল ৭ রান। 

রাসেলের ১৪ বলের ইনিংসে ৪টি ছক্কা ছাড়া বাকি ১০ বলে আসে ৩ রান। এবারের বিপিএলে ঝড়ো ব্যাটিংয়ে আলোচনার জন্ম দেওয়া জাকের ২০ রানে অপরাজিত থাকেন ২৩ বল খেলে। দেড়শ পেরিয়েই আটকে যায় কুমিল্লা। 

রান তাড়ায় বরিশাল পায় উদন্ত সূচনা। কুমিল্লার ইনিংসের শুরুতে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারেননি তানভির ইসলাম। তরুণ পেসার রোহানাত দৌলাহ বর্ষণ হয়তো ফাইনালের নতুন বলের দায়িত্বের চাপ নিতে পারেননি। সম্প্রতি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে নজর কাড়া এই পেসারকে টানা দুই বলে চার ও ছক্কা মারেন মেহেদী হাসান মিরাজ। তার বলেই বাউন্ডারির পর তানভিরকে টানা দুটি ছক্কায় ওড়ান তামিম। 

৩ ওভারেই ৪১ রান তোলে বরিশাল। পরে নিস্তরঙ্গ দুটি ওভারের পর নারাইনকে স্লগ সুইপে ছক্কা মারেন মিরাজ। পাওয়ার প্লেতে ৫৯ রান তোলে বরিশাল।

মইন আলি আক্রমণে আসার পর তেতে ওঠেন তামিম। ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে বোলারের মাথার ওপর দিয়ে বিশাল এক ছক্কার পর টানা দুটি বাউন্ডারি মারেন পুল ও লেট কাট করে। 

তবে অতি আত্মবিশ্বাস কাল হয় বরিশাল অধিনায়কের জন্য। ওই ওভারেই আবার ক্রিজ ছেড়ে মারার চেষ্টায় বোল্ড হয়ে যান তিনি ২৬ বলে ৩৯ রান করে। 

আসরের রানের তালিকায় অবশ্য ততক্ষণে হৃদয়কে (৪৬২) ছাপিয়ে নিজেকে সবার ওপরে নিয়ে গেছেন তিনি (৪৯২)। 

উদ্বোধনী জুটিতে ৮ ওভারে আসে ৭৬। 

মইনের পরের ওভারেই ছক্কার চেষ্টায় মিরাজ ২৯ রানে ধরা পড়েন লং অফ সীমানায়। 

তবে বরিশালকে চাপে পড়তে দেননি মুশফিকুর রহিম ও কাইল মেয়ার্স। তাদেরকে চাপে ফেলার সুযোগ হাতছাড়া করে কুমিল্লাও। ৯ রানে লং অনে মেয়ার্সের ক্যাচ নিতে পারেননি বদলি ফিল্ডার রিশাদ হোসেন, ২০ রানে চার্লস। মেয়ার্স সেই খেসারত বুঝিয়ে দেন টাইমিং আর গায়ের জোর মিলিয়ে দুর্দান্ত সব শটের পসরা সাজিয়ে।

৭ ওভারে ৫৯ রানের এই জুটিতেই জয় একরকম নিশ্চিত করে ফেলে বরিশাল। দুজনের কেউ অবশ্য কাজ শেষ করে ফিরতে পারেননি। মাথায় বলের আঘাতের পর প্রথম ম্যাচ খেলতে নামা মুস্তাফিজকে ওড়ানোর চেষ্টায় মেয়ার্স ফেরেন ৩০ বলে ৪৬ রান করে। ঠাণ্ডা মাথায় এগোতে থাকা মুশফিক হুট করে মুস্তাফিজকেই হুক করে বিদায় নেন ১৮ বলে ১৩ করে। 

তাতে পরাজয়ের ব্যবধান একটু কমেছে, ম্যাচ আরেকটু দীর্ঘায়িতই হয়েছে কেবল। 

সংক্ষিপ্ত স্কোর: 

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স: ২০ ওভারে ১৫৪/৬ (নারাইন ৫, লিটন ১৬, হৃদয় ১৫, চার্লস ১৫, মাহিদুল ৩৮, মইন ৩, জাকের ২০*, রাসেল ২৭*; মেয়ার্স ৪-০-২৬-১, সাইফ ৪-০-৩৭-১, ফুলার ৪-০-৪৩-২, তাইজুল ৪-০-২০-০, ম্যাককয় ৪-০-২৪-১)। 

ফরচুন বরিশাল: ১৯ ওভারে ১৫৭/৪ (তামিম ৩৯, মিরাজ ২৯, মেয়ার্স ৪৬, মুশফিক ১৩, মাহমুদউল্লাহ ৭*, মিলার ৮*; তানভির ৩-০-২৪-০, রোহানাত ১-০-১৫-০, নারাইন ৪-০-২১-০, মুস্তাফিজ ৪-০-৩১-২, মইন ৪-০-২৮-২, রাসেল ৩-০-৩৩-০)। 

ফল: ফরচুন বরিশাল ৬ উইকেটে জয়ী।

ম্যান অব দা ম্যাচ: কাইল মেয়ার্স।